শিল্প, জনমুখী ও বিনিয়োগবান্ধব বাজেট চান ব্যবসায়ীরা, এফবিসিসিআই

স্টাফ রিপোর্টার

ডলারের দাম বাড়ার পাশাপাশি চলছে এর সংকট। এতে কাঁচামাল আমদানিতে সংকটে পড়তে হচ্ছে উদ্যোক্তাদের। অন্যদিকে, ডাবল ডিজিটে পৌঁছেছে ব্যাংক ঋণের সুদহার। এই পটভূমিতে শিল্প-কারখানা রক্ষায় ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে ব্যবসায় ভ্যাট-ট্যাক্স কমানো জরুরি। একই সঙ্গে কমিয়ে আনতে হবে ব্যবসার খরচ। অন্যথায় ব্যবসা থেকে ছিটকে পড়বেন অনেক ব্যবসায়ী।

বৃহস্পতিবার রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁওয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও এফবিসিসিআই আয়োজিত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের পরামর্শক কমিটির ৪৪তম সভায় এসব কথা বলেন বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ী নেতারা।

এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমের সভাপতিত্বে সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। আরও উপস্থিত ছিলেন অর্থ প্রতিমন্ত্রী আয়শা ওয়াসিকা খান, এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম ও বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ী নেতারা।

সভায় অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেন, ‘ব্যবসা-বাণিজ্য ও দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে সরকার বেসরকারি খাতের সঙ্গে নিরলসভাবে কাজ করছে। আগামী বাজেটের জন্য ব্যবসায়ীদের প্রস্তাবনা গুরুত্বসহ বিবেচনা করা হবে।’

অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান বলেন, ‘বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে অর্থনীতি এগিয়ে চলেছে। তবে অর্থনীতিকে মজবুত করতে রপ্তানি বহুমুখীকরণের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। কর ন্যায়পাল নিয়োগের বিষয়টি ভেবে দেখা যেতে পারে।’ স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে সরকার ও ব্যবসায়ী সমাজ ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবে বলে আশা ব্যক্ত করেন তিনি।

এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, ‘বাজেট সামনে রেখে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর সঙ্গে একাধিক বৈঠক হয়েছে। তাদের যৌক্তিক প্রস্তাবনা বাজেটে তুলে ধরতে কাজ চলছে। ব্যবসায়ীদের মধ্যে কোনো অসন্তোষ থাকলে তা সমাধানে এনবিআর কাজ করবে। উন্নত, আধুনিক, সুখী-সমৃদ্ধ ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে রাজস্ব আহরণ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা চান তিনি।

সভায় এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, ‘করোনা-পরবর্তী বিরূপ প্রভাব, রাশিয়া- ইউক্রেন যুদ্ধ ও মধ্যপ্রাচ্য সংকটের মধ্যেও এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে হচ্ছে। এই পটভূমিতে ব্যবসা-বাণিজ্যের  পরিবেশ আরও সুদৃঢ় করতে হবে। বিনিয়োগ ও উৎপাদনশীল খাতকে দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।’ এফবিসিসিআই জনমুখী, ব্যবসা ও বিনিয়োগবান্ধব বাজেট চায় বলে উল্লেখ করেন তিনি।

লিখিত বক্তব্যে মাহবুবুল আলম বলেন, ‘ব্যবসায়ীদের ওপর থেকে করের বোঝা কমানো, কাঁচামাল আমদানি, মধ্যবর্তী পণ্যসহ শিল্প উপকরণের ওপর অগ্রিম আয়কর এবং আগাম কর প্রত্যাহার করতে হবে। ঋণের সুদহার হ্রাসসহ আমদানি পণ্যের যথাযথ শুল্কায়ন এবং পণ্য খালাসের জটিলতা দূর করতে রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় অটোমেশন বাস্তবায়ন করতে হবে। পাশাপাশি কর হার কমিয়ে আয়কর ও মূসকের আওতা বাড়িয়ে রাজস্ব আয় বাড়ানো এবং সক্ষম ব্যক্তিদের করের আওতায় আনা দরকার। রপ্তানিতে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াতে হবে। সেজন্য স্থানীয় বাজার থেকে সংগৃহীত পণ্য, কাঁচামাল ও সেবা ক্রয়কে ভ্যাটের আওতামুক্ত রাখতে হবে।‘

আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা ও সুশাসন নিশ্চিত করতে ব্যাংকিং কমিশন গঠন কিংবা ব্যাংক খাত সংস্কার কর্মসূচি হাতে নেওয়ার দাবি জানিয়ে এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি ও মানুষের প্রকৃত আয় বিবেচনায় রেখে আগামী জাতীয় বাজেটে ব্যক্তি শ্রেণির করমুক্ত আয়সীমা ৪ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৪ লাখ টাকা করা দরকার।’

মুক্ত আলোচনায় বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা ভালো নেই। তাদের অনেক সমস্যা মোকাবিলা করতে হচ্ছে। সিঙ্গেল ডিজিট থেকে ডাবল ডিজিট হয়েছে ব্যাংক ঋণের সুদ হার, যা এখন সাড়ে ১৩ শতাংশ। তা ছাড়া ডলারের তীব্র সংকটে কাঁচামাল আমদানি করা যাচ্ছে না। গ্যাস-বিদ্যুতের দামও দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছে। তবু গ্যাস-বিদ্যুতের তীব্র সংকটে ধুঁকছে শিল্পকারখানা।’

তিনি আরও বলেন, ‘যেসব ব্যবসায়ী রপ্তানির মাধ্যমে ডলার আয় করছেন, তাদের কেন সংকট মোকাবিলা করতে হবে। ব্যাংকগুলো এখন ইডিএফ ফান্ড থেকে ঋণ দিচ্ছে না।’

বিটিএমএ সভাপতি বলেন, ‘যারা ব্যাংকের অর্থ লুট করেছে, তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। যারা নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করছে, যারা ডলার আয় করছে তাদের কেন খেলাপিদের দায় নিতে হবে? সত্যিকারের ব্যবসায়ীদের কেন ঋণ পেতে সমস্যা হবে? যদি তাদের সহায়তা করা না হয়, তাহলে ব্যবসা থেকে বের হয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হোক। কারণ অনেক কারখানা এখন নিবু নিবু করছে।’

ব্যাংকগুলো উদ্যোক্তাদের ঋণ না দিয়ে ডলারের ব্যবসা করছে বলে অভিযোগ করেন নিট পোশাক মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম। তিনি বলেন, ‘কারখানায় মজুরি বেড়েছে। ব্যাংকে সুদহার বেড়েছে। এসব চাপে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। তাদের পুনরুদ্ধার করতে হবে।’

ফরেন চেম্বারের সভাপতি জাভেদ আখতার বলেন, ‘ব্যবসার খরচ অনেক বেড়ে গেছে। ব্যবসা-বাণিজ্য ঠিক রাখতে যাবতীয় খরচ কমানো জরুরি।‘

চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিতে নগদ সহায়তা আগের মতো বহাল রাখার দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশ ট্যানারি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ।

আবাসন খাতের সংগঠন রিহ্যাবের সভাপতি মো. ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় ফ্ল্যাট ও প্লট নিবন্ধন ফি কমাতে হবে। অন্যথায় অনেকেরই ফ্ল্যাট কেনার ইচ্ছা পূরণ হবে না।’

পুরোনো গাড়ি আমদানিকারকদের সংগঠন বারভিডার সভাপতি হাবিব উল্লাহ ডন বলেন, ‘ডলারের দাম বাড়ার কারণে গাড়ি আমদানিতে ব্যয় বেড়েছে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ। তাই গাড়ি আমদানিতে শুল্ক হার কমানো দরকার।’

দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা নানা সংকটে। এর মধ্যেও ভ্যাট-সংক্রান্ত নানা ঝামেলায় পড়তে হচ্ছে তাদের।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *