রোহিঙ্গা গণহত্যার বিচার শুরু আইসিসিতে

রোহিঙ্গা গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে মিয়ানমারকে বিভিন্নভাবে দায়ী করা হলেও সম্প্রতি দেশটির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা ও তদন্ত শুরুর ঘটনায় বেশ চাপে পড়েছে দেশটি।

আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়ার মামলা এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) অভিযোগ তদন্তের সিদ্ধান্তে গণহত্যার দায় যে মিয়ানমারের এড়ানোর সুযোগ নেই, সেটা বেশ স্পষ্ট।

জাতিসংঘের শীর্ষ আদালতে দায়ের করা মামলায় মিয়ানমার প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিতে যাচ্ছেন দেশটির রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা অং সান সু চি।

কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, দেশটির এ সিদ্ধান্তই প্রমাণ করে বৈশ্বিকভাবে কতটা চাপে পড়েছে মিয়ানমার। আগামী ১০ থেকে ১২ ডিসেম্বর এ শুনানি অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। গাম্বিয়া ও মিয়ানমার দুই দফা শুনানি ও পাল্টা-শুনানিতে অংশ নেবে।

এদিকে আন্তর্জাতিক মামলার মুখোমুখি হয়ে হঠাৎ করে বাংলাদেশে প্রতিনিধি পাঠানোর প্রস্তাব দিয়েছে দেশটি। বাংলাদেশের কূটনীতিকরা বলছেন, বৈশ্বিক চাপ থেকে বাঁচতে মিয়ানমারের এটা আরও একটি কৌশল ছাড়া কিছু নয়। এর আগেও তারা নানা চাপের মুখে বাংলাদেশে প্রতিনিধি পাঠিয়ে বিশ্বকে দেখাতে চেয়েছিল যে, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে তারা অত্যন্ত আন্তরিক।

তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, ‘দেখুন, এটা মিয়ানমারের কৌশল। এর আগেও তারা এ ধরনের আচরণ করেছে।’ তবে এ প্রতিনিধিদলটির সফরের তারিখ এখনও চূড়ান্ত হয়নি বলেও জানান তিনি।

এ বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, মিয়ানমারের প্রতিনিধিরা মূলত রোহিঙ্গাদের সঙ্গেই আলোচনায় বসতে চায়। কারণ, রোহিঙ্গাদেরকেই প্রত্যাবাসনে রাজি করাতে হবে দেশটির কর্তৃপক্ষকে। তারা যদি তাদের সঙ্গে আলোচনা করতে চায়, বাংলাদেশের কোনো আপত্তি নেই।

এদিকে আইনি অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও অং সান সু চি দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে লড়বেন- এমন খবরে হতবাক হয়েছেন পর্যবেক্ষকরা। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বলছেন, একটি দেশের সর্বোচ্চপর্যায়ের একজন নেতার এ পর্যায়ে লড়াই বিশ্ববাসীকে বিভ্রান্ত করবে।

এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমান বলেন, ‘অতীত অভিজ্ঞতা বলছে, কোনো সরকারপ্রধান এ ধরনের আদালতের শুনানিতে অংশ নেননি। অং সান সু চি এ আদালতে অংশ নিয়ে বিশ্ববাসীকে বার্তা দিতে চাইবেন যে, তিনি নিজে উপস্থিত থেকে এ সমস্যার সমাধান করতে চান।’

তিনি বলেন, ‘মূল বিষয় হলো, আন্তর্জাতিকভাবে এটা স্বীকৃত যে, সেখানে গণহত্যা হয়েছে। এটা তদন্তেও প্রমাণিত হয়েছে। ফলে এখন তিনি যেভাবেই যান না কেন, তিনি বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করবেন। তার কোনো আইনি অভিজ্ঞতা নেই। তিনি আইন জানেন বা আন্তর্জাতিক আইন নিয়ে পড়াশোনা করছেন, এমনটিও নয়। ফলে তিনি কেন যাবেন, আদালতে এটা একটা বড় প্রশ্ন।’

‘মিয়ানমার সরকার আন্তরিক থাকলে কফি আনানের সুপারিশগুলো মেনে নিত। তাদের (রোহিঙ্গা) নাগরিকত্ব দিয়ে নিজ দেশে, পৈতৃক ভিটায় নিরাপত্তার সঙ্গে বসবাসের সুযোগ করে দিত। কিন্তু তারা সেটা করেনি। এখন তারা আদালতের মুখোমুখি হচ্ছে। এটা লোক দেখানো ছাড়া কিছুই নয়’- বলেন তারেক শামসুর রেহমান।

‘বাংলাদেশে প্রতিনিধি পাঠানোর আগ্রহও লোক দেখানো’- উল্লেখ করে ড. রেহমান বলেন, ‘এর মাধ্যমে আরও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে চায় মিয়ানমার। এর আগেও তাদের বহু মন্ত্রী, প্রতিনিধিরা বাংলাদেশে এসেছেন। তারা বলেছেন, রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে। কিন্তু আসলে অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি।’

সম্প্রতি আর্জেন্টিনার আদালতে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর হুমকি সৃষ্টির অভিযোগে মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি, সেনাপ্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইংসহ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো। এর মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংসতার অভিযোগে প্রথমবারের মতো সু চিকে কাঠগড়ায় উঠতে হচ্ছে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক পরিসরে মিয়ানমারের রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভাবমূর্তিও প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।

তবে কূটনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বলছেন, আন্তর্জাতিক এসব মামলায় মিয়ানমার চাপে পড়ে যাওয়ায় রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের সামনে নতুন সুযোগ তৈরি হয়েছে। এ চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে বাংলাদেশকে।

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনে নিরাপত্তা বাহিনীর বেশকিছু চৌকিতে সন্ত্রাসীদের হামলার অভিযোগে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্মম নির্যাতন শুরু করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। [জাতিসংঘ এ নৃশংসতাকে গণহত্যা হিসেবে অভিহিত করেছে][ জাতিসংঘ এ নৃশংসতাকে গণহত্যা হিসেবে অভিহিত করেছে।]। প্রাণ বাঁচাতে সেসময় রোহিঙ্গাদের ঢল শুরু হয় বাংলাদেশে।

কক্সবাজারে এখন নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১১ লাখ ১৮ হাজার ৫৭৬। এর মধ্যে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশে এসেছেন ৭ লাখ ২ হাজার জন। ২০১৬ সালের অক্টোবরের পরের কয়েক মাসে এসেছিলেন ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা। অন্যরা আগে থেকেই বাংলাদেশে অবস্থান করছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *