রেমিট্যান্স ও রফতানি বেড়েছে প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলার
দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান দুই উৎস রেমিট্যান্স ও রফতানি আয়। চলতি অর্থবছরে এ দুই খাতেই বড় ধরনের প্রবৃদ্ধি পেয়েছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে রেমিট্যান্সে প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ২৭ শতাংশ। আর ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে রফতানি আয়ে। বৈদেশিক মুদ্রার প্রধান এ দুই উৎসের উচ্চ প্রবৃদ্ধিতেও রিজার্ভ বাড়ছে না দেশে। আট মাস ধরে রিজার্ভের পরিমাণ ওঠানামা করছে ১৯ থেকে ২১ বিলিয়ন ডলারের ঘরে।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বিপিএম৬ পদ্ধতির হিসাব অনুযায়ী, গত ১৩ মার্চ দেশের রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৯৭৩ কোটি বা ১৯ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলার। যদিও চলতি অর্থবছরের শুরুতে অর্থাৎ ২০২৪ সালের ১ জুলাই রিজার্ভের পরিমাণ ২১ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার ছিল। সে হিসাবে গত আট মাসে রিজার্ভ না বেড়ে উল্টো ১ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলার কমেছে। যদিও এ সময়ে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স ও রফতানি আয় এসেছে আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৬ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলার বেশি। এর মধ্যে গত অর্থবছরের তুলনায় রেমিট্যান্স বেশি এসেছে ৪ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার। আর রফতানি আয় বেশি এসেছে ২ দশমিক ৩৯ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা গেছে, রেমিট্যান্স ও রফতানি আয় বাড়লেও মূলত প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই), বিদেশী অনুদান এবং মাঝারি ও দীর্ঘমেয়াদি বিদেশী ঋণ কমে যাওয়ার প্রভাবেই দেশের রিজার্ভ চাপে পড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যালান্স অব পেমেন্ট (বিওপি) তথা দেশের সামগ্রিক লেনদেন ভারসাম্যের পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে, আগের অর্থবছরের তুলনায় চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) দেশে এফডিআই প্রবাহ কমেছে ৬৫ কোটি ডলার। একই সময়ে অনুদান (ফরেন এইড) আসা কমেছে ১ দশমিক ২২ বিলিয়ন বা ১২২ কোটি ডলার। আর মাঝারি ও দীর্ঘমেয়াদি বিদেশী ঋণ কম এসেছে ১২৭ কোটি ডলার। সব মিলিয়ে এ সময় দেশে এফডিআই প্রবাহ, বিদেশী অনুদান এবং মাঝারি ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ কম এসেছে ৩১৪ কোটি ৩ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলার। এছাড়া চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে দেশে আমদানি বেড়েছে ১ দশমিক ২২ বিলিয়ন বা ১২২ কোটি ডলারের।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, কেবল রেমিট্যান্স ও রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধি দিয়ে দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধির ধারায় এগিয়ে নেয়া যাবে না। নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে হলে অবশ্যই বিদেশী বিনিয়োগ নিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগও বাড়াতে হবে। যেকোনো দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধির প্রধান শর্ত আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। কিন্তু এ দুটি উপাদানই এ মুহূর্তে বাংলাদেশে অনুপস্থিত।
দেশের বিরাজমান পরিস্থিতিতে এফডিআইয়ের প্রত্যাশা করাও ঠিক হবে না বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তফা কে মুজেরী। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ও ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) এ নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক নেই। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা আরো গভীর হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে বিদেশীরা এখানে বিনিয়োগ করতে আসবে না। কোনো দেশেই আইন-শৃঙ্খলা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না থাকলে সেখানে বিদেশী বিনিয়োগ যায় না। বর্তমান পরিস্থিতিতে উন্নয়ন সহযোগীরাও বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন না। বিদেশী বিনিয়োগ, ঋণ ও অনুদান নিয়ে আসতে হলে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন লাগবে, যার মাধ্যমে দেশে দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ভিত রচিত হবে।’
কেবল রেমিট্যান্সের বড় প্রবৃদ্ধি দিয়ে দেশের অর্থনীতি ও রিজার্ভকে স্থিতিশীল করা যাবে না বলে মনে করছেন মুস্তফা কে মুজেরী। তিনি বলেন, ‘রেমিট্যান্সের বেশির ভাগই প্রবাসী পরিবারের ভোগে ব্যয় হয়ে যায়। যেটুকু উদ্বৃত্ত থাকে সেটি দিয়েও তারা বাড়ি নির্মাণ করে, জমি কেনে। গাড়ি-বাড়ি কেনা কখনো বিনিয়োগ নয়। কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। বিদেশীরা না হোক, অন্তত ওয়েজ আর্নার ডেভেলপমেন্ট বন্ডের মাধ্যমে প্রবাসীদের কাছে কিছু বিনিয়োগ নিয়ে আসতে পারলেও দেশের উপকার হতো। সমস্যা হলো প্রবাসীদের মধ্যে এ বন্ড নিয়ে তেমন কোনো প্রচারণা কিংবা সচেতনতা নেই। যেসব প্রবাসীর কাছে বিনিয়োগের মতো সঞ্চয় আছে, তারাও দেশে বিনিয়োগের কোনো খাত খুঁজে পায় না।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ১৯ মার্চ পর্যন্ত দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ২০ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ডলার। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে প্রবাসীরা ১৬ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন ডলার দেশে পাঠিয়েছিলেন। সে হিসাবে চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত ৪ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স বেশি এসেছে। এক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৬ দশমিক ৯২ শতাংশ। অন্যদিকে প্রায় ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে রফতানি খাত। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) দেশে ২৩ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন ডলারের রফতানি আয় এলেও চলতি অর্থবছরের একই সময়ে তা ২৬ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। সে হিসাবে অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে দেশে রফতানি আয় বেড়েছে ২ দশমিক ৩৯ বিলিয়ন ডলার।
অন্যদিকে পরপর দুই অর্থবছরে দেশের আমদানি খাত সংকুচিত হওয়ার পর চলতি অর্থবছরে আবারো প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরেছে। অর্থ পাচার ও ২০২১-২২ অর্থবছরে রেকর্ড ৮৯ বিলিয়ন ডলারের আমদানির ধাক্কায় দেশে ডলারের তীব্র সংকট সৃষ্টি হয়। এমন প্রেক্ষাপটে ২০২২-২৩ অর্থবছরের শুরু থেকেই আমদানিতে নানা শর্ত জুড়ে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে চলতি অর্থবছরে এসে সেসব শর্তের বেশির ভাগই শিথিল করা হয়েছে। এ কারণে অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) আমদানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪ দশমিক ২৬ শতাংশ। অর্থের পরিমাণে এ সময়ে ১২২ কোটি ডলারের পণ্য বেশি আমদানি হয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে ৩৮ দশমিক ৮৬ ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছিল। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে এ আমদানি ৪০ দশমিক ৫১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়।
বৈদেশিক মুদ্রা আয়-ব্যয়ের ব্যবধান কমে আসায় দেশের চলতি হিসাবের ঘাটতিও কমে এসেছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে এ হিসাবে ঘাটতি ছিল ৪ দশমিক ২৮ বিলিয়ন বা ৪২৮ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে এ ঘাটতি ৫৫ কোটি ডলারে নেমে এসেছে। তবে চলতি হিসাবের ঘাটতি কমে আসার সুফল ব্যালান্স অব পেমেন্টকে (বিওপি) ইতিবাচক ধারায় ফিরতে পারেনি। গত জানুয়ারি শেষে বিওপির ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১ দশমিক ১৭ বিলিয়ন (১১৭ কোটি) ডলার। বিওপির এ ঘাটতিই দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে পূরণ হয়।
রিজার্ভ বাড়তে হলে বিদেশী বিনিয়োগ আসতে হবে মনে করে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর ড. মো. হাবিবুর রহমান বলেন, ‘বিশ্বের কোনো দেশের পক্ষেই বিদেশী বিনিয়োগ ছাড়া রিজার্ভ বাড়ানো সম্ভব নয়। আর আমাদের মতো দেশের ক্ষেত্রে এটি আরো বেশি কঠিন। কারণ রেমিট্যান্স ও রফতানি থেকে আমাদের যে আয় হয়, সেটি আমদানি করতে গিয়েই শেষ হয়ে যায়। এ মুহূর্তে আমাদের বিদেশী মুদ্রার আয় যা হচ্ছে, তা দিয়ে অর্থনীতির অস্থিরতা দূর হয়েছে। এখন সমৃদ্ধির দিকে যেতে হলে বিদেশী বিনিয়োগের প্রয়োজন।’
বিদেশী বিনিয়োগ বাড়ানোর ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কী ধরনের ভূমিকা রাখছে—এ প্রশ্নের জবাবে হাবিবুর রহমান বলেন, ‘বিদেশী বিনিয়োগ আনার বিষয়টি সরকারের সামগ্রিক তৎপরতার সঙ্গেও সম্পৃক্ত। এক্ষেত্রে দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ব্যবসার জন্য বিদেশীদের কাছে বাংলাদেশ সবসময়ই আদর্শ জায়গা। বিনিয়োগ আনার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন উদ্যোগ আছে। বিদেশীরা ভরসা পেলে বিনিয়োগের অভাব হওয়ার কথা নয়।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) দেশে নিট প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ (নিট এফডিআই) এসেছিল ৯০ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে মাত্র ২৫ কোটি ডলার নিট এফডিআই এসেছে। সে হিসাবে এ সাত মাসে নিট এফডিআই প্রবাহ কমেছে ৬৫ কোটি ডলার। এফডিআইয়ের পাশাপাশি এ সময়ে বিদেশী অনুদানও হ্রাস পেয়েছে ১২২ কোটি ডলারের বেশি। গত অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে বিদেশী অনুদান এসেছিল ৩২৮ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে তা ২০৬ কোটি ডলারে নেমে এসেছে। সে হিসাবে গত অর্থবছরের প্রথম সাত মাসের তুলনায় অনুদান কমেছে ১২২ কোটি ডলারেরও বেশি। ২০২২ সাল-পরবর্তী সময় থেকেই দেশের সরকারি-বেসরকারি খাতে বিদেশী ঋণ প্রবাহ কমতে শুরু করে। তবে চলতি অর্থবছরে এসে এ ধারা আরো বেশি সংকুচিত হয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে মাঝারি ও দীর্ঘমেয়াদি বিদেশী ঋণের প্রবাহ কমেছে প্রায় ১২৭ কোটি ডলার।