রুশ জ্বালানি আধিপত্যের মূল অস্ত্র যে দ্বীপ

মস্কো থেকে প্রায় দেড় হাজার মাইল দূরে জনবিচ্ছিন্ন এক আর্কটিক উপদ্বীপের ছোট্ট বন্দর সাবেতা। সোভিয়েত আমলের ভূতাত্ত্বিকদের প্রাচীন এ ঘাঁটি এখন রাশিয়ার সবচেয়ে উচ্চাভিলাষী তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) প্রকল্পভুক্ত অঞ্চল।

এলএনজির বাজারে প্রবেশের মাত্র এক বছর পরই নোভাটেক পিজেএসসির হাতে এ প্রকল্প পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয়। এখান থেকে উত্তোলিত গ্যাসের সুবাদে এক দশকের মধ্যে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ এলএনজি রফতানিকারক হয়ে ওঠার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে রাশিয়া। খবর ব্লুমবার্গ ও মস্কো টাইমস।

আর্কটিক সার্কেলের মধ্যে এটিই একমাত্র এলএনজি প্লান্ট নয়, তবে এখন পর্যন্ত তা সবচেয়ে বড়। যে প্লান্টটির বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে, তার নাম ইয়ামাল এলএনজি। এ প্লান্টটির প্রধান শেয়ারহোল্ডার নোভাটেক পিজেএসসির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এখানে আরো কিছু প্রকল্প চালুর পরিকল্পনা রয়েছে তাদের, যার সুবাদে এক দশকের মধ্যে রাশিয়াকে বিশ্বের বৃহত্তম এলএনজি রফতানিকারকদের কাতারে পৌঁছে দেবে।

প্রায় দুই বছর আগে ইয়ামাল উপদ্বীপে নিজেদের প্লান্টটি চালুর পর এটি রাশিয়ার শীর্ষ এলএনজি উৎপাদকে পরিণত হয়েছে। এ কোম্পানির শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে রুশ বিলিয়নেয়ার লিওনিড মিখেলসন ও গেনাডি টিমচেনকো, ফরাসি জায়ান্ট জ্বালানি কোম্পানি টোটাল এসএ উল্লেখযোগ্য।

গত বছরের শেষের দিকে ইয়ামাল এলএনজি প্লান্টটি তাদের সক্ষমতার পুরোটা ব্যবহার করে। এর সুবাদে বৈশ্বিক এলএনজি বাজারে রাশিয়ার শেয়ার দ্বিগুণ হয়ে ৮ শতাংশে পৌঁছে যায়। ২০৩০ সালের মধ্যে এ শেয়ার ১০ শতাংশে উন্নীত করার পরিকল্পনা নিয়েছে তারা। আর এটি সম্ভব হলে বিশ্বের বৃহৎ এলএনজি রফতানিকারক হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র, কাতার ও অস্ট্রেলিয়ার পাশাপাশি রাশিয়ার নামও উচ্চারিত হবে।

এরই মধ্যে বিশ্বের পাইপলাইন গ্যাসের শীর্ষ রফতানিকারক ও অপরিশোধিত জ্বালানির দ্বিতীয় বৃহত্তম রফতানিকারক হিসেবে অবস্থান করে নিয়েছে রাশিয়া। এর মধ্যে আর্কটিক অঞ্চল থেকে এলএনজি রফতানি প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে বিশ্ব অর্থনীতিতে দেশের অবস্থান আরো শক্তিশালী করে তোলার সুযোগ করে দেবে বলে আশা করা হচ্ছে।

নোভাটেকের প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা মার্ক গিয়েতভে সম্প্রতি লন্ডনে দেয়া এক সাক্ষাত্কারে জানিয়েছেন, ‘বিশ্বে শীর্ষ চার এলএনজি রফতানিকারকের মধ্যে জায়গা করে নেবে রাশিয়া।’ তিনি আরো জানিয়েছেন, বৈরী পরিবেশ থেকে সাধ্যের মধ্যে খরচে জ্বালানি উত্তোলন এবং তা তরলীকরণের পর হাজার হাজার মাইল দূরে ইউরোপ ও এশিয়ার বাজারে পৌঁছে দেয়া সম্ভব।

মূলত সপ্তাহের মধ্যে কয়েকবার এলএনজি ভর্তি একটি বিশালাকার ট্যাংকারের সহায়তায় এ প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ইউরোপ ও এশিয়ার ক্রেতাদের কাছে জ্বালানি পৌঁছে দেয়া হয়।

২০১৭ সালের শেষের দিকে ইয়ামাল এলএনজি প্রকল্পে যখন প্রথম উৎপাদন শুরু হয়, তখন প্রেসিডেন্ট পুতিন বলেছিলেন, এ অঞ্চল রাশিয়াকে সেই সুযোগ এনে দেবে, ‘ঠিক যে রকম জ্বালানি’ তাদের প্রাপ্য। সে সময় তিনি আরো বলেছিলেন, ‘আমরা সাহসের সঙ্গে বলতে চাই, এ শতাব্দী এবং এর পরবর্তী সময় এই আর্কটিকের কল্যাণেই রাশিয়া সামনে এগিয়ে যাবে।’

ইয়ামাল এলএনজির এগিয়ে চলা দেখে প্রেসিডেন্টের প্রত্যাশা বলা চলে বাস্তবায়িত হতে শুরু করেছে। ইয়ামাল এলএনজির তিনটি উৎপাদন ইউনিটের সমন্বিত বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা ১ কোটি ৭৫ লাখ টন, যার পুরোটাই ব্যবহূত হচ্ছে। নোভাটেক এখন এলএনজি ২ প্রকল্প নামে দ্বিতীয় প্লান্টের কাজ শুরু করতে সহযোগীদের আগ্রহী করে তোলার চেষ্টা করছে।

২০২২ সাল নাগাদ প্লান্টটির কাজ শুরু হবে বলে আশা করা হচ্ছে। তৃতীয় আরেকটি প্লান্টের বিষয়ে ভাবছে কোম্পানিটি। এর ওপর ভিত্তি করে ২০৩০ সাল নাগাদ এলএনজি উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ২০ শতাংশ বাড়িয়েছে, আর তখন বছরে সাত কোটি টন এলএনজি উৎপাদন সম্ভব হবে।

রাশিয়ার জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের অনুমান, এ অঞ্চলের মধ্যে প্রায় ২১০ ট্রিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস মজুদ রয়েছে, যা সমগ্র দেশে থাকা গ্যাসের ৭০ শতাংশ। ব্যাংক অব আমেরিকা মেরিল লিঞ্চের মস্কোভিত্তিক তেল ও গ্যাসের বাজার বিশ্লেষক কারেন কোস্তানিয়ান বলেন, ‘এলএনজি উৎপাদন সক্ষমতার দিক থেকে রাশিয়া চতুর্থ অথবা তৃতীয় অবস্থানে পৌঁছে যাবে বলে আমাদের বিশ্বাস।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *