রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বিক্রি করে দিচ্ছে মিসর

স্টাফ রিপোর্টার

রাষ্ট্রীয় ৩২টি প্রতিষ্ঠান বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছে মিসর। ২০২৪ সালের মার্চ নাগাদ এসব প্রতিষ্ঠান বিক্রির কাজ সম্পন্ন হবে। কয়েক বছর ধরে চলা আর্থিক সংকট মোকাবেলায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে সম্প্রতি দেশটির প্রধানমন্ত্রী মুস্তাফা মাদবোলি জানিয়েছেন।

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এক মন্ত্রিপরিষদ বৈঠক শেষে মিসরীয় প্রধানমন্ত্রী জানান, মোট ১৮টি অর্থনৈতিক খাতের ৩২টি প্রতিষ্ঠানকে বিক্রির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে দেশটির সামরিক বাহিনীর মালিকানাধীন দুটি প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে কয়েকটিকে বিরাষ্ট্রীয়করণের প্রক্রিয়া বেশ কয়েক বছর ধরেই চলমান রয়েছে।

মিসরের ব্যাংক খাতের বৃহৎ প্রতিষ্ঠান ব্যাংক দ্যু কায়রো, ইউনাইটেড ব্যাংক অব ইজিপ্ট এবং আরব-আফ্রিকান ইন্টারন্যাশনাল ব্যাংক এ বিক্রয় পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে। এছাড়া বীমা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, হোটেল ও শিল্প খাতের বেশকিছু প্রতিষ্ঠান এ তালিকায় রয়েছে। আগামী এক বছরের মধ্যে কৌশলগত বিনিয়োগকারীদের কাছে সরাসরি এবং ইজিপশিয়ান এক্সচেঞ্জে (ইজিএক্স) তালিকাভুক্তির মাধ্যমে এসব প্রতিষ্ঠানের শেয়ার বিক্রি করা হবে। দীর্ঘদিন ধরেই দেশটির সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত বেশকিছু প্রতিষ্ঠান বিরাষ্ট্রীয়করণের প্রয়াস চালাচ্ছে। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে তা ঝিমিয়ে পড়েছিল। বর্তমান উদ্যোগ এ প্রয়াস আবারো গতিশীল করে তুলবে বলে প্রত্যাশা করছে মিসর সরকার।

মিসরে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় অর্থনৈতিক সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। শ্রীলংকা বা পাকিস্তানের মতো যেকোনো মুহূর্তে দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে দেশটি। সম্প্রতি দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড গভর্নমেন্ট সামিটে মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল সিসি বলেন, প্রতি বছর মিসরের বাজেট প্রয়োজন পড়ে লাখ কোটি ডলারের। আমাদের কি এ অর্থ আছে? না। এর অর্ধেক বা এক-চতুর্থাংশ আছে? তা-ও না। তাহলে এ অর্থ আসবে কোত্থেকে? আমাদের এখন সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব ও কুয়েতের মতো মিত্রদের সহায়তা প্রয়োজন।

সংকট মোকাবেলায় সিসি সরকার বর্তমানে বেশকিছু অর্থনৈতিক সংস্কার শুরু করেছে। মিসরের প্রেসিডেন্ট ঘোষণা দিয়েছেন, ২০২৫ সালের মধ্যেই দেশটির অর্থনীতিতে ব্যক্তি খাতের অবদানকে ৩০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৬৫ শতাংশে তোলা হবে। এজন্য রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি, ব্যাংক ও জ্বালানি খাতের প্রতিষ্ঠান বিক্রি করে দেয়ার পাশাপাশি সরকারি ব্যয় সংকোচনের পথেও হাঁটতে যাচ্ছে মিসর।

মিসর সরকার বলছে, তীব্র অর্থনৈতিক ও তারল্য সংকটের মুখে দেশে বিদেশী বিনিয়োগের প্রবাহও বাড়াতে চায় তারা। এছাড়া গত ডিসেম্বরে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সঙ্গে ৩০০ কোটি ডলারের একটি ঋণ চুক্তি করেছে মিসর। ওই চুক্তিতেও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বেসরকারীকরণের বিষয়টিকে এগিয়ে নেয়ার শর্ত রয়েছে।

বেসরকারীকরণ পরিকল্পনার মধ্যে থাকা কোম্পানিগুলোর মধ্যে পাঁচটিকে গত সেপ্টেম্বরে সভরেন ফান্ড অব ইজিপ্টের প্রাক-আইপিও সাবফান্ড সেটের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো ব্যাংক দ্যু কায়রো, ইজিপশিয়ান লিনিয়ার অ্যালকাইল বেনজেন, মিসর লাইফ ইন্স্যুরেন্স, সেনা মালিকানাধীন বোতল কোম্পানি সাফি ও ওয়াতানিয়া পেট্রোলিয়াম।

অন্য যে কোম্পানিগুলো বেসরকারীকরণের জন্য নির্বাচিত হয়েছে বা যেগুলোকে নিয়ে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ রয়েছে সেগুলোর মধ্যে পোর্ট সাঈদ কনটেইনার অ্যান্ড কার্গো হ্যান্ডলিং কোম্পানি, দামিয়েত্তা কনটেইনার অ্যান্ড কার্গো হ্যান্ডলিং কোম্পানির মতো পরিবহন কোম্পানিও রয়েছে। ইউনাইটেড ব্যাংক ও দ্য আরব আফ্রিকান ইন্টারন্যাশনাল ব্যাংক ছাড়াও হোটেল, নির্মাণ, পেট্রোকেমিক্যাল ও সার খাতের কয়েকটি কোম্পানিও এ তালিকায় রয়েছে।

মুস্তাফা মাদবোলি জানিয়েছেন, কিছু কোম্পানির মালিকানা বিক্রির কার্যক্রম আগামী তিন মাসের মধ্যেই সম্পন্ন হবে। কিছু হবে পাঁচ মাসের মধ্যে। কিছু কোম্পানির ক্ষেত্রে তা চলতি বছরের শেষ অথবা আগামী বছরের প্রথম প্রান্তিকও লেগে যেতে পারে। এ-সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য কেস টু কেস ভিত্তিতে প্রকাশ করা হবে।

মিসরের বেসরকারি খাতের থিংক ট্যাংক গ্লোবাল ট্রেড ম্যাটার্সের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আশরাফ নাগিব বলেন, ‘সরকার সম্ভবত দুই ধাপের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া অনুসরণ করবে। শুরুতে আমরা বেসরকারি খাতের স্থান নির্ণয়ের ক্ষেত্রে ভারসাম্য আনার প্রক্রিয়া দেখব। শেয়ারের ছোট ছোট অংশ আইপিও হিসেবে নয় বরং কিছু স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার স্থানে বসবে।’

নাগিব আরো বলেন, ‘শুরুতেই এসব সম্পদ কোনগুলো তা নির্ধারণ করতে হবে। প্রথমে কোম্পানিগুলোর ছোট অংশ নিয়ে কাজ করতে হবে। এরপর সেগুলোকে বেসরকারীকরণ, পুনর্বিন্যাস ও পুনঃউন্নয়ন করতে হবে। এরপর সেগুলোকে সঠিক আইপিওর জন্য বাজার উপযোগী করতে হবে।’

কিছু আগেই আইএমএফের সঙ্গে চুক্তি চূড়ান্ত করে মিসর। সেখানেও বেসরকারি খাতের উন্নয়ন বৃদ্ধি ও অর্থনীতিতে রাষ্ট্রীয় অবদান কমানোর বিষয় উঠে এসেছে।

সরকারের এ সিদ্ধান্তের বিষয়ে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আমলাতন্ত্রের ধীরগতি এবং সরকারের মধ্যেই একটি শ্রেণীর বিরোধিতাকারীরা বেসরকারীকরণ পরিকল্পনাকে বাধাগ্রস্ত করছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে মিসরের বাজার থেকে বিদেশী বিনিয়োগের পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে কমেছে। যার কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় দেশটির জন্য এখন রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিক্রি জরুরি হয়ে পড়েছে।

অর্থনীতিবিদ চার্লস রবার্টসন মনে করেন, দেনার দায়ে ডুবে যাওয়ার আগেই সরকারি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান বিক্রির সিদ্ধান্ত সরকারের পক্ষ থেকে অতিগুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। গত কয়েক বছরে শ্রীলংকা ও ঘানা যে সংকটে পড়েছে তার পুনরাবৃত্তি চায় না মিসর। তবে এক্ষেত্রে সংকট হলো মিসরে কেউ সস্তায় সম্পত্তি বিক্রি করতে চায় না। কিন্তু দ্বিমুখী ঘাটতি ও ঋণের কারণে মিসরের সম্পদগুলোর বাজারদর কম।

অবশ্য মিসর সরকার আগেও এ ধরনের পদক্ষেপের ঘোষণা দিয়েও পিছিয়ে এসেছিল। তাই সরকারের নতুন পদক্ষেপ নিয়ে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। যদিও এবার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন নিয়ে সরকারের অবস্থান শক্তিশালী বলেই মত দিচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *