রাজস্ব ঘাটতি বেড়েই চলেছে বেনাপোল স্থলবন্দরে
রাজস্ব ঘাটতি বেড়েই চলেছে বেনাপোল স্থলবন্দরে। চলতি অর্থবছরের (২০১৮-১৯) প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) স্থলবন্দরটি থেকে মোট ৩ হাজার ৬১৭ কোটি টাকা রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
এর বিপরীতে আহরণ হয়েছে ২ হাজার ৯০৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ অর্থবছরের সাত মাসেই লক্ষ্যের তুলনায় ৭১১ কোটি টাকা রাজস্ব ঘাটতিতে পড়ে গেছে বেনাপোল স্থলবন্দর।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভারত থেকে পণ্য আমদানি-রফতানিতে বন্দর ও কাস্টমসের নানা অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা এবং প্রাশাসনিক কর্মকর্তাদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে স্থলবন্দরটির ওপর আস্থা হারাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। উপরন্তু বারবার ধর্মঘটে অচল হয়ে পড়ার কারণেও ব্যাহত হয়েছে বন্দরের বাণিজ্যিক কার্যক্রম।
এছাড়া সপ্তাহের সাতদিন ২৪ ঘণ্টার বাণিজ্যিক সেবাও এখন বন্ধ। এসব কারণেই স্থলবন্দরটি থেকে লক্ষ্য অনুযায়ী রাজস্ব আহরণ করা যাচ্ছে না বলে মনে করছেন তারা।
গত অর্থবছরেও (২০১৭-১৮) রাজস্ব আহরণে ঘাটতিতে ছিল বেনাপোল স্থলবন্দর। এ সময় স্থলবন্দরটি দিয়ে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য ছিল ৪ হাজার ১৯৫ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। এর বিপরীতে আহরণ হয়েছিল ৪ হাজার ১৬ কোটি ২৪ লাখ টাকা।
সব মিলিয়ে এ সময় ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় ১৭৯ কোটি ৬৪ লাখ টাকায়। চলতি অর্থবছরে এখান থেকে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ হাজার ৪৮৩ কোটি টাকা। কিন্তু অর্থবছরের প্রথম সাত মাসেই ঘাটতির পরিমাণ ৭১১ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, বন্দরের রাজস্ব আহরণে গতিশীলতা বাড়াতে হলে সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয় ফিরিয়ে আনা, বৈধ সুবিধা দেয়া ও প্রয়োজনীয় অবকাঠামো উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই। অন্যথায় এ ঘাটতি কাটানো অসম্ভব। অন্যদিকে প্রশাসনিক কর্মকর্তারা দাবি করছেন, অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করায় বেশ সচেষ্ট তারা।
বেনাপোলকে বলা হয় দেশের বৃহত্তম স্থলবন্দর বেনাপোল। স্থলবন্দরটি দিয়ে ভারতে পণ্য আমদানি-রফতানি চলছে ১৯৭২ সাল থেকে। বর্তমানে প্রতি বছর এখানে ভারত থেকে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকার পণ্য আমদানি হয়ে থাকে। এ থেকে রাজস্ব আহরণ হয় প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার মতো।
যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়ায় শুরু থেকেই স্থলবন্দরটি ব্যবহার করে পণ্য আমদানি-রফতানিতে ব্যবসায়ীদের মধ্যে বাড়তি আগ্রহ দেখা গেছে। কিন্তু গত কয়েক বছরে স্থলবন্দর সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতা দেখা যাচ্ছে। এছাড়া ব্যবসায়ীদেরও যেতে হচ্ছে বেশ হয়রানির মধ্য দিয়ে। এ কারণে স্থলবন্দরটি থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছেন তারা। ফলে এখান থেকে কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আহরণ করা যাচ্ছে না।
বন্দর সূত্রে জানা যায়, গত বছর (২০১৮) বেনাপোল বন্দরের সঙ্গে ভারতের পেট্রাপোল বন্দরের আমদানি-রফতানি কার্যক্রম বন্ধ ছিল ১৫২ দিন। এর মধ্যে বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কাস্টমসের সঙ্গে সীমান্তরক্ষী বিজিবির দ্বন্দ্ব, শ্রমিক ও ব্যবসায়ীদের আন্দোলন এবং অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এখান দিয়ে আমদানি-রফতানি বন্ধ ছিল ২৬ দিন। সরকারি ছুটিতে বন্ধ ছিল ১২৬ দিন।
এর মধ্যে সাপ্তাহিক ছুটিতে শনিবার আমদানি-রফতানি সচল থাকলেও কাস্টমস ও বন্দরের অধিকাংশ কর্মকর্তারা অনুপস্থিত এবং সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোয় নগদ অর্থের লেনদেন না হওয়ায় ব্যবসায়ীরা এখান থেকে চাহিদামতো পণ্য খালাস নিতে পারেননি। এসব প্রতিবন্ধকতার কারণেই সাত মাসে রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ ৭০০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
ভারত-বাংলাদেশ ল্যান্ডপোর্ট ইমপোর্ট-এক্সপোর্ট সাব-কমিটির চেয়ারম্যান মতিয়ার রহমান বলেন, অবকাঠামো সমস্যার কারণে স্থলবন্দরটি দিয়ে চার দেশের মধ্যে (বিবিআইএন—বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপাল) বাণিজ্যিক কার্যক্রমের উদ্বোধন হলেও এখনো এর পরবর্তী কার্যক্রম শুরু হয়নি। যেসব বন্দর দিয়ে বাণিজ্য করতে ব্যবসায়ীরা বেশি স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করে থাকেন, সেসব বন্দরের অবকাঠামো উন্নয়নের দিকে কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই মনোযোগ দিতে হবে।
বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মফিজুর রহমান সজন বলেন, সব বন্দরে আমদানি পণ্যের ওপর রাজস্ব পরিশোধের নিয়ম এক হতে হবে। চট্টগ্রাম বন্দরে যে পণ্যের শুল্ক ৪ ডলার, বেনাপোল স্থলবন্দরে ওই একই পণ্যের ওপর সাড়ে ৪ ডলার করে শুল্ক আদায় করা হচ্ছে। বন্দরের ধারণক্ষমতা ৩৮ হাজার টন, কিন্তু এখানে সবসময় পণ্য থাকে প্রায় দেড় লাখ টন।
সার্বিক বিষয় নিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বেনাপোল কাস্টম হাউজের কমিশনার বেলাল হুসাইন চৌধুরী বলেন, লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় না হওয়ার কিছু কারণ আমরা চিহ্নিত করেছি। আগামীতে সেসব বিষয়ের প্রতি বিশেষ লক্ষ থাকবে। আগামী মাসগুলোয় ঘাটতি পূরণ হয়ে যাবে। এজন্য সবার সহযোগিতা প্রয়োজন।