রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ব্যাংক খাতে সংকটের কারণ :ওয়েবিনারে বক্তারা
ব্যাংক খাতের ঋণের একটি বড় অংশ খেলাপি হয়ে গেছে। এ ছাড়া বেনামি ঋণ, পরিবারতন্ত্র, পুঁজি পাচারসহ বিভিন্ন সংকট রয়েছে। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় এসব সংকট তৈরি হয়েছে। প্রভাবশালীরা দেখিয়ে দিচ্ছেন, তারা চাইলে সবই পারেন। ব্যাংক খাতে লুটপাটের অর্থনীতি কায়েম হয়েছে। সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গীকার ছাড়া এ খাতের সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। গতকাল ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজ আয়োজিত ‘বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে সংকট কেন, সমাধান কীভাবে’ শীর্ষক বিশেষ ওয়েবিনারে আলোচকরা এমন মত দেন।
আলোচনায় অংশ নিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, ব্যাংকিং খাতের বড় সমস্যা খেলাপি ঋণ। খেলাপি ঋণের ৭৭ শতাংশ হয় রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায়। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় এ খাতে লুটপাটের অর্থনীতি কায়েম হয়েছে।
তিনি বলেন, খেলাপি ঋণগ্রহীতাদের বিষয়ে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি হলো, তাদের নানা ধরনের সুবিধা দেওয়া। বর্তমান অর্থমন্ত্রী দায়িত্ব নেওয়ার পর যা আরও শক্তিশালী হয়েছে। আইন সংশোধনের মাধ্যমে খেলাপিদের সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। সর্বশেষ ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন যার বড় উদাহরণ। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ ১৯৯৮ সালে শীর্ষ ১০ ঋণখেলাপির জন্য আলাদা ট্রাইব্যুনাল গঠনের সুপারিশ করেছিলেন। প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত আলাদা বেঞ্চ গঠনের প্রস্তাব করেন। এসব প্রস্তাব বাস্তবায়ন হয়নি।
মইনুল ইসলাম আরও বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণের যে হিসাব করে, তা একটা ভুয়া হিসাব। প্রকৃতপক্ষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ অনেক বেশি। তাঁর মতে, বর্তমানে ১৬ লাখ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে প্রকৃত খেলাপি ৪ লাখ কোটি টাকার বেশি। মোট ঋণের যা ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। তবে অবলোপনসহ ২ লাখ কোটি টাকা খেলাপি দেখানো হয়। এর বাইরে আদালতে ঝুলে থাকা এবং বারবার পুনঃতপশিলের মাধ্যমে নিয়মিত দেখানো হচ্ছে অনেক ঋণ। ব্যাংক খাতে এত লুটপাট হলেও আমানত সংকট না হওয়ার প্রধান কারণ প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ। কারণ হুন্ডিতে আসা প্রবাসীদের অর্থের একটি অংশ আমানত হিসেবে ব্যাংকে জমা হয়।
মইনুল ইসলাম বলেন, আমদানি, রপ্তানি এবং হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাচার হচ্ছে। প্রভাবশালীরা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বাইরে পাচার করছে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন থামাতে না পারার মূলে এই পুঁজি পাচার। ডলার সংকট, টাকার মান কমার পেছনেও পুঁজি পাচার।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, দেশের ১০ থেকে ১২টি ব্যাংকের বাইরে সবার অবস্থা নাজুক। এর পরও এসব ব্যাংক টিকে আছে কীভাবে, সেই প্রশ্ন আসছে। আমানতকারীরা জানতে চাচ্ছেন, ব্যাংকে টাকা রাখা নিরাপদ নাকি তুলে নিজের কাছে রাখবেন।
পিডব্লিউসির ব্যবস্থাপনা অংশীদার মামুন রশীদ বলেন, গুণগত মান বিবেচনায় দেশের ব্যাংক খাতের ২০ শতাংশের বেশি খেলাপি। তবে খেলাপি ঋণই বড় সমস্যা নয়। ব্যাংক খাতে সুশাসন ও জবাবদিহিতার অভাব রয়েছে। দেশের যেসব ব্যাংক একক গ্রুপের কর্তৃত্বে চলছে, এদের প্রধান সমস্যা বেনামি ঋণ। এসব ব্যাংকের ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ ঋণ বেনামি।
অনুষ্ঠানের সঞ্চালক ইন্ডিপেন্ডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জাহেদ উর রহমান বলেন, ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করে খেলাপিদের ঋণ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। পরিচালকদের মেয়াদ ৯ থেকে বাড়িয়ে ১২ বছর করা হয়েছে। ব্যাংকের মালিকরাও ভাবেননি, খেলাপিদের ঋণের সুযোগ দেওয়া হবে।
উন্নয়ন ও অর্থনীতি গবেষক জিয়া হাসান বলেন, ব্যাংক খাতের বর্তমান সংকটের সমাধানে রাজনৈতিক সদিচ্ছাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ওয়েবিনারে আরও উপস্থিত ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আলী রীয়াজ, সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ অনেকে।