রমজানে এলপি গ্যাস সংকট তীব্র হতে পারে

স্টাফ রিপোর্টার

রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) সরবরাহ সংকট দেখা দিয়েছে। বাজারে বেশির ভাগ এলপিজি কোম্পানির গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না। বিষয়টি স্বীকারও করেছেন এলপিজি অপারেটররা। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এলপিজির কাঁচামাল আমদানিতে ঋণপত্র বা এলসি খুলতে না পারায় এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ঋণপত্র জটিলতা না কমলে আসন্ন রমজানে পরিস্থিতি আরো তীব্র হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।

এদিকে এলপিজি সিলিন্ডার সংকটে বাজারে পণ্যটির দামও অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। বিভিন্ন কোম্পানির ১২ কেজির এলপিজি সিলিন্ডার এখন ১ হাজার ৪০০ থেকে দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। খুচরা বিক্রেতারা জানিয়েছেন, বেশি দামে তারা বিভিন্ন কোম্পানির কাছ থেকে এলপি গ্যাস কিনছেন। তবে গ্রাহকরা চাহিদা মোতাবেক বেশি দাম দিয়েও এলপি গ্যাস পাচ্ছেন না। দু-তিনটি কোম্পানির সিলিন্ডার পাওয়া গেলেও তা ২০০-৩০০ টাকা বেশি দামে কিনতে হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন ক্রেতারা।

রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে এলপি গ্যাস সংকটের সত্যতা মিলেছে। কারওয়ান বাজার, মগবাজার, কুড়িল, মোহাম্মদপুর, বাড্ডা, শ্যামলীসহ ২০টির বেশি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, পরিবেশক ও খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে দু-একটি কোম্পানির বাইরে কোনো এলপি গ্যাস সিলিন্ডার নেই। আগে যেখানে তারা ছয়-সাতটি কোম্পানির এলপি গ্যাস রাখতেন, এখন তারা দু-তিনটি কোম্পানির কাছ থেকে সিলিন্ডার গ্যাস পাচ্ছেন। খালি সিলিন্ডার পড়ে আছে অনেক বিক্রেতার দোকানে।

এলপি গ্যাস সিলিন্ডারে বড় সংকট তৈরি হলে জ্বালানি হিসেবে কাঠের ব্যবহার বেড়ে যেতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। একই সঙ্গে গ্যাস না মিললে বৈদ্যুতিক চুলার ব্যবহার বাড়লে তাতেও বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে যেতে পারে।

রাজধানীর কালশী এলাকায় জননী সুপার শপ (ছদ্মনাম) নামের একটি মাঝারি আকারের এলপি গ্যাসবিক্রেতা জহিরুল ইসলাম। প্রতি মাসে ছয়টি অপারেটরের প্রায় ২০০টি এলপিজি সিলিন্ডার বিক্রি করেন তিনি। অপারেটরদের কাছ থেকে সরবরাহ না পাওয়ায় গত মাসে তার ৪০ শতাংশ ব্যবসা কমেছে।  তিনি জানান, বেশি দাম দিয়েও এলপি গ্যাস দোকানে তুলতে পারছেন না তিনি। স্বাভাবিক সরবরাহ দেয়া কোম্পানিগুলো এখন সরবরাহ করতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে। অগ্রিম টাকা দিয়েও পাবেন কিনা সে আশা পাচ্ছেন না তিনি।

একই কথা জানান যশোরের মুদি ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম। প্রতি মাসে দুটি এলপিজি কোম্পানি অন্তত ৩০টি গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি করলেও এখন ঠিকমতো পণ্য পাচ্ছেন না তিনি। গ্যাসের সংকট জানিয়ে সরবরাহকারীরা পণ্য ডেলিভারি দিচ্ছেন না। তবে বেশি দাম অফার করলে গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

সারা দেশে এলপি গ্যাসের গ্রাহক রয়েছে প্রায় ৫০ লাখ। ২৬টি বেসরকারি কোম্পানি এসব গ্যাস বাজারজাত করে। ডলার সংকটে পণ্য আমদানিতে চাহিদা অনুযায়ী ব্যাংকে ঋণপত্র (এলসি) খুলতে না পারায় বেশির ভাগ কোম্পানি ব্যবসায়িকভাবে লোকসানে পড়েছে। এরই মধ্যে সব কোম্পানির বিপণন ৪০-৫০ শতাংশ কমে গেছে।

দেশের বাজারে এলপি গ্যাস মার্কেট শেয়ার সবচেয়ে বেশি বসুন্ধরা এলপি গ্যাসের। ঋণপত্র খুলতে জটিলতা হওয়ায় বৃহৎ বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানটির বিপণন কার্যক্রম কমেছে।

বসুন্ধরা এলপি গ্যাসের চিফ অপারেটিং অফিসার (ব্র্যান্ড অ্যান্ড মার্কেটিং) এমএম জসিম উদ্দিন বলেন, ‘বাজারে এলপি গ্যাসের সংকট চলছে এটা সত্য। কারণ এলসি খুলতে না পারায় কাঁচামাল আমদানি করা যাচ্ছে না। বসুন্ধরার সেলস ভলিউম এরই মধ্যে ৪০-৫০ শতাংশ কমে গেছে। এলসি সহযোগিতা না পেলে সামনে এ পরিস্থিতি আরো তীব্র হতে পারে।’

দেশের বাজারে প্রতি মাসে এলপি গ্যাসের দাম বেঁধে দিচ্ছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। চলতি মাসের জন্য ১২ কেজি এলপি গ্যাসের দাম ১ হাজার ২৩২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা গত ডিসেম্বরে ছিল ১ হাজার ২৯৭ টাকা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে এলপি গ্যাসের কাঁচামাল প্রোপেন ও বিউটেনের দাম প্রতি মাসে কমছে। গত মাসেও পণ্য দুটির টনপ্রতি দাম কমেছে গড়ে ৬০ ডলারের মতো। অপারেটররা জানিয়েছেন, বিশ্ববাজারে এলপি গ্যাসের কাঁচামালের দাম পড়তির দিকে, পণ্যও পর্যাপ্ত। শুধু এলসি জটিলতার কারণে বাংলাদেশী আমদানিকারকরা এটি আমদানি করতে পারছেন না।

নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানিয়েছে, এলপিজি আমদানিতে এলসি জটিলতায় অপারেটর থেকে শুরু করে ডিলাররা মজুদ বাড়াচ্ছেন। আসন্ন রমজানে পণ্যটি পাওয়া যাবে কিনা এমন অনিশ্চয়তা থেকে তারা মজুদ করছেন।

ওরিয়ন গ্যাস লিমিটেডের চিফ অপারেটিং অফিসার (সিওও) প্রকৌশলী অনুপ কুমার সেন বলেন, এলসি জটিলতায় সরবরাহ চেইনে সংকট তৈরি হচ্ছে। অনেকের ভলিউম ছোট হয়ে আসছে। ব্যবসা ভালো না হওয়ায় ব্যাংকঋণ পরিশোধে জটিলতায় পড়ছেন। এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে এলপি ব্যবসা মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে।

দেশের বাজারে ৩২ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে এলপি গ্যাস ব্যবসায়ীদের। প্রতি বছর ১৪ লাখ টনের মতো এলপি গ্যাসের চাহিদা রয়েছে। পাইপলাইনের গ্যাস সংকটে বাসাবাড়িতে জনপ্রিয় হওয়া এ পণ্য এখন গাড়িতেও ব্যবহূত হচ্ছে। শিল্পমালিকরা বিকল্প জ্বালানি হিসেবে এলপি গ্যাস ব্যবহার শুরু করেছেন। বৃহৎ এ বাজার ধরে রাখার জন্য সরকারের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়ার কথা জানান ব্যবসায়ীরা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *