রপ্তানি বিকাশে বড় বাধা বিশ্ববাজারের অপ্রতুল তথ্য

স্টাফ রিপোর্টার

মহামারি করোনাভাইরাস ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট বৈশ্বিক মন্দায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বৈদেশিক মুদ্রা সংকট দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশও এ নিয়ে বিপাকে পড়েছে। বৈদেশিক মুদ্রা সংকটে দেশের আমদানি ও রপ্তানি কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। পাশাপাশি জ্বালানি ঘাটতিতে ব্যবসা-বাণিজ্যও পড়েছে ক্ষতির মুখে। সমস্যা কাটিয়ে উঠতে বৈদেশিক আয় বাড়ানোর তাগিদ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। এক্ষেত্রে তারা রপ্তানি বাড়ানোর কথা বলছেন। সরকার ও উদ্যোক্তারা এ লক্ষ্যে কাজও শুরু করেছেন। তবে দেশের বাজার, পণ্য, রপ্তানি সক্ষমতাসহ বিভিন্ন তথ্য বিদেশি ক্রেতারা সহজে জানতে পারছেন না। আবার বাংলাদেশি ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারাও বিশ্ববাজারের ক্রেতা, বাজার পরিস্থিতি সম্পর্কে তথ্য পাচ্ছেন না। রপ্তানির বিকাশে তথ্যের এমন ঘাটতি বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের ৭২৯টি পণ্য বিশ্বের ১৬১টি দেশে রপ্তানি হয়। অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে বিশ্বের ৫০টিরও বেশি দেশ থেকে বাংলাদেশ প্রয়োজনীয় কাঁচামাল, ফিনিশড পণ্য, মূলধনী যন্ত্রপাতি ও খাদ্যপণ্য আমদানি করে থাকে।

প্রতিযোগিতামূলক বাজারে বাংলাদেশি ক্রেতাদের যেমন বিদেশের বাজারের তথ্য জানা দরকার। ঠিক একইভাবে বিদেশি ক্রেতাদেরও বাংলাদেশের পণ্য, বাজার সম্পর্কে তথ্য জানা দরকার। এক্ষেত্রে জটিলতা থাকলে দ্রুতই তা ঠিক করা উচিত। আমাদের রপ্তানি ৫০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। দ্রুতই সেটা ১০০ বিলিয়ন ডলার হয়ে যাবে। এসময়ে ওয়েবসাইটে তথ্য না থাকা ভালো কোনো খবর নয়বিজ্ঞাপন

নতুন বাজারের খোঁজ পেতে রপ্তানিকারকরা ব্যক্তিগত তৎপরতায় বায়ার বা ক্রেতার সন্ধান করে থাকেন। পাশাপাশি বিভিন্ন দেশে সরকার নিয়োজিত মিশন ও কমার্শিয়াল কাউন্সিল অফিসও দেশীয় উদ্যোক্তাদের জন্য ক্রেতা খুঁজে থাকে। বাংলাদেশের পণ্যের প্রচারে বিভিন্ন মেলা ও বিজনেস উইক হয়ে থাকে, যাতে বিভিন্ন দেশের ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদল অংশ নেন। তবে এটাই যথেষ্ট নয়।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাংলাদেশি পণ্যের বিষয়ে আমদানিকারক কিংবা দেশগুলোর ব্যবসায়ীদের এসব মিশন ও কমার্শিয়াল কাউন্সিল অফিসে যোগাযোগ কম। বাংলাদেশি পণ্যের মেলা হলেও তা প্রতি বছর হয় না। বিদেশি ক্রেতা বা বিক্রেতারা বাংলাদেশসহ আগ্রহের দেশ ও পণ্য সম্পর্কে জানতে খোঁজ করেন ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড সেন্টারের (আইটিসি) ওয়েবসাইটে।

বৈশ্বিক বিজনেস হাবখ্যাত এ ওয়েবসাইটটি বিভিন্ন দেশের তথ্যে ঠাসা থাকলেও তাতে বাংলাদেশ সম্পর্কিত হালনাগাদ তথ্য নেই। ফলে বিদেশি ক্রেতারা বাংলাদেশের রপ্তানি সক্ষমতা, রপ্তানিযোগ্য পণ্য, বাজার, উৎপাদন প্রক্রিয়া ও দাম সম্পর্কেও থাকছেন অন্ধকারে।

সম্প্রতি আইটিসির ওয়েবসাইট ঘুরে দেখা গেছে, ২০২১ ও ২০২২ সালের কিছু তথ্য রয়েছে। চলতি ২০২৩ সালের হালনাগাদ কোনো তথ্য এতে খুঁজে পাওয়া যায়নি।

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে আন্তর্জাতিক এ ওয়েবসাইটে আমদানি-রপ্তানির পূর্ণাঙ্গ তথ্য দিতে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) চিঠি দেওয়া হয়েছে। এনবিআর সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। যদিও এনবিআরের পক্ষ থেকে ইপিবিকে এখনো কিছু জানানো হয়নি।

রাজস্ব বোর্ডের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আমদানি-রপ্তানির তথ্য এনবিআরে কাছে থাকলেও আইটিসি ওয়েবসাইটে তথ্য দেওয়ার এখতিয়ার আমাদের আছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড সেন্টারের ওয়েবসাইট একটি নির্ভরযোগ্য সাইট। এ ওয়েবসাইট থেকে বিশ্বের সব আমদানি-রপ্তানির তথ্য পাওয়া যায়। এতে বাংলাদেশের কিছু আমদানিকারক দেশের তথ্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশি রপ্তানি পণ্যের ডাটা পাওয়া যায়। এ তথ্য ব্যবহার করে উদ্দেশ্য সফল হয় না।

এনবিআর চেয়ারম্যান বরাবর পাঠানো এ চিঠিতে আরও বলা হয়, আইটিসিতে বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানির তথ্য দেওয়া সম্ভব হলে, তা বিদেশি ক্রেতা মহলের কাছে সহজলভ্য হবে। এটি করতে পারলে বাংলাদেশের পণ্য সম্প্রসারণেও সহায়ক হতে পারে।

এনবিআর থেকে এখনো কিছু জানানো হয়নি। আপাতত কোনো আপডেট নেই বলে জানিয়েছেন ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান এ এইচ এম আহসান। তিনি বলেন, ‘বিশ্বের সব এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ডাটা (আমদানি-রপ্তানির তথ্য-উপাত্ত) ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড সেন্টারের (আইটিসি) ওয়েবসাইটে থাকে। সেখানে বাংলাদেশের পণ্য, বাজার, পণ্যের দাম সম্পর্কিত ডাটা (তথ্য-উপাত্ত) অনেক দিন ধরে আপডেট করা হচ্ছে না। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাছে এসব তথ্য থাকে। সেজন্য আমরা তাদের কাছে রিকোয়েস্ট (অনুরোধ) করেছি। যদি এটা এনবিআরের এখতিয়ারের মধ্যে থাকে, তাহলে যেন তারা এটা করার ব্যবস্থা করেন। এনবিআর যদি মনে করে ওই ওয়েবসাইটে আপলোড করার এখতিয়ার তাদের নেই, তাহলে যাদের এটা করা ক্ষমতা রয়েছে, তাদেরকে বলবেন তারা (এনবিআর)।’

এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘আইটিসিতে যদি তথ্য না থাকে, তাহলে বাংলাদেশের আমদানি চাহিদা ও রপ্তানি সম্ভাবনা সম্পর্কে ক্রেতারা জানতে পারবেন না।’ বিদেশিদের বাংলাদেশের বাজার চেনাতে ও জানাতে আইটিসিতে তথ্য আপডেট করা গুরুত্বপূর্ণ জানিয়ে এ ব্যবসায়ী নেতা বলেন, ‘এনবিআর কিংবা সংশ্লিষ্ট অথরিটি যারা আছে, তাদের দ্রুত কাজটা শুরু করা দরকার।’

বিশ্বের সব এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ডাটা (আমদানি-রপ্তানির তথ্য-উপাত্ত) ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড সেন্টারের (আইটিসি) ওয়েবসাইটে থাকে। সেখানে বাংলাদেশের পণ্য, বাজার, পণ্যের দাম সম্পর্কিত ডাটা (তথ্য-উপাত্ত) অনেক দিন ধরে আপডেট করা হচ্ছে না। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাছে এসব তথ্য থাকে। সেজন্য আমরা তাদের কাছে রিকোয়েস্ট করেছিইন্টারন্যাশনাল ট্রেড সেন্টারের ওয়েবসাইট

অন্যদিকে তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সহ-সভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, ‘প্রতিযোগিতামূলক বাজারে বাংলাদেশি ক্রেতাদের যেমন বিদেশের বাজারের তথ্য জানা দরকার। ঠিক একইভাবে বিদেশি ক্রেতাদেরও বাংলাদেশের পণ্য, বাজার সম্পর্কে তথ্য জানা দরকার। এক্ষেত্রে জটিলতা হলে দ্রুতই তা ঠিক করা উচিত। আমাদের রপ্তানি ৫০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। দ্রুতই সেটা ১০০ বিলিয়ন ডলার হয়ে যাবে। এ সময়ে ওয়েবসাইটে তথ্য না থাকা ভালো কোনো খবর নয়।’

আইটিসিতে তথ্য না থাকার দু’টি কারণের থাকতে পারে বলে জানিয়েছেন বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, ‘একটি কারণ হতে পারে- এনবিআর এ তথ্য দিতে চায় না। আরেকটি হলো- এ তথ্যের ভিত্তিতে কয়েক বছর ধরে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো অর্থপাচারের পরিসংখ্যান তৈরি করতে পারে। রপ্তানিবাণিজ্য সম্প্রসারণ ও বিকেন্দ্রিকরণের স্বার্থে বৈশ্বিক ওয়েবসাইটে আমদানি-রপ্তানির পরিপূর্ণ থাকা প্রয়োজন।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *