রপ্তানি বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ

স্টাফ রিপোর্টার

রপ্তানি আয় বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। তারা বলেছে, বিশ্বজুড়ে আর্থিক সংকট চলছে। এটা বিশ্ব অর্থনীতির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই রপ্তানি আয় বাড়ানোর উপায় খুঁজে বের করতে হবে। একই সঙ্গে রপ্তানি বহুমুখী করারও পরামর্শ দিয়েছে তারা।

মঙ্গলবার (২ মে) আইএমএফের প্রতিনিধিদল সচিবালয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সভায় এ পরামর্শ দেয়। বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষসহ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এ সময় উপস্থিত ছিলেন। আইএমএফের ১০ সদস্যের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন মিশন চিফ রাহুল আনন্দ।

সভায় প্রতিনিধিদলটি জানায়, রপ্তানির প্রধান গন্তব্য ইউরোপ-আমেরিকার মতো বাজারে মূল্যস্ফীতি বাড়ায় সেখানে রপ্তানি কমে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ অবস্থায় রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জ সামলে নিয়ে কিভাবে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা যায়, সে বিষয়ে করুণীয় নির্ধারণ ও তা বাস্তবায়নের ওপর জোর দিতে পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি। এছাড়া, আমদানি-রপ্তানিতে ডলার রেট একই হারে নির্ধারণের তাগিদ দিয়েছে তারা।

সভা সূত্র জানায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স সবচেয়ে বেশি অবদান রাখছে। কিন্তু, আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী এখনও নিট রিজার্ভ ৩ বিলিয়ন ডলার কম আছে। এ অবস্থায় আগামী জুনের মধ্যে কিভাবে এই রিজার্ভ সংগ্রহ করা সম্ভব হবে? এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়, এ বিষয়টি কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনিটরিং করছে।

সূত্র জানায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ ব্যাপারে তাদের মতো পদেক্ষপ গ্রহণ করেছে। গত কয়েক বছরের হিসেবে যদি পর্যবেক্ষণ করা হয়, তাহলে দেখা যাবে, বাংলাদেশের নিট রির্জাভ যথেষ্ট শক্তিশালী অবস্থানে ছিল। চলমান বৈশ্বিক সঙ্কট, বিশেষ করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং কোভিড-১৯ পরবর্তী ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে দেশের অর্থনীতিতে কিছুটা বাড়তি চাপ তৈরি করেছে। এই পরিস্থিতিতেও রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স সংগ্রহে সক্ষমতার পরিচয় দিচ্ছে সরকার। বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স বাড়ছে। আশা করা হচ্ছে, রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স বাড়বে। এছাড়া, আইএমএফের পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হয়, রপ্তানিকারকরা বিদেশে তাদের ডলার রেখে দিচ্ছেন, আন্ডার ইনভয়েসিং হয় এবং ডলার পাচার করার মতো ঘটনাও ঘটছে কি না? এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এসব তথ্য সঠিক নয়। এসব বিষয়ে সরকার কঠোর এবং কঠিন পদক্ষেপ নিয়েছে।

সভা সূত্র জানিয়েছে, আইএমএফ সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছে রপ্তানি বাণিজ্য বাড়ানোর ওপর। বিশেষ করে, ইউরোপ ও আমেরিকায় মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় ইতোমধ্যে রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। রপ্তানি আয় কমে গেলে বৈদেশিক মুদ্রা ডলার বিশেষ করে রিজার্ভের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হবে। এ অবস্থায় অপ্রয়োজনীয় ও বিলাসী পণ্যের আমদানি ব্যয় কমিয়ে ডলার সাশ্রয় করা যায় কি না, সে বিষয়েও জানতে চায় আইএমএফ। তবে, ইতোমধ্যে ডলার সাশ্রয়ে এসব বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানানো হয়েছে।

সভা শেষে এ বিষয়ে বাণিজ্য সচিব সাংবাদিকদের জানান, আইএমএফের জানার বিষয় ছিল মূলত রপ্তানি খাত নিয়ে। এছাড়া, আমদানি-রপ্তানিতে ডলার একই হারে নির্ধারণ করা যায় কি না, সে বিষয়েও তারা কথা বলেছে।

তিনি বলেন, চলমান বৈশ্বিক সঙ্কটের কারণে আগামীতে রপ্তানি আয় কিছুটা কমে যেতে পারে। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী হয়ত রপ্তানি হবে না। এ বিষয়টি আইএমএফকে অবহিত করা হয়েছে। তবে, রপ্তানি আয় বাড়াতে সরকারের পক্ষ থেকে যেসব উদ্যোগ ও পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে, সে বিষয়ে তাদের অবহিত করা হয়। ইউরোপ ও আমেরিকার বাইরে নতুন বাজার জাপান, ভারত, ল্যাটিন আমেরিকা ও আফ্রিকায় বাংলাদেশের রপ্তানি বাড়ছে।

বাণিজ্য সচিব জানান, দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান গন্তব্যস্থল আমেরিকা ও ইউরোপে এখন মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার কারণে সেখানকার মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যেতে পারে। এ কারণে সেখানে রপ্তানি কমে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। তবে, রপ্তানিকারকদের সরকারের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে নীতিগত সহায়তা ও সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হচ্ছে। ব্যবসায়ীদের লাইসেন্স পাঁচ বছরের জন্য নবায়ন, ফি কমানো, আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে শুল্ক ও ভ্যাটজনিত সুবিধা প্রদান, বন্দরের অবকাঠামো নির্মাণের মতো কাজ করা হচ্ছে। এর বাইরে রপ্তানি বাড়াতে বিভিন্ন প্রমোশনাল কাজ করছে সরকার।

বাণিজ্য সচিব বলেন, সরকারি এসব উদ্যোগের ফলে রপ্তানি আযের প্রবৃদ্ধি বছর শেষে ইতিবাচক ধারায় ফিরে আসবে।

সভা সূত্র জানায়, বৈঠকে স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উত্তরণে বাংলাদেশের প্রস্তুতি, উত্তরণ-পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় পদক্ষেপ, ট্যারিফ কাঠামো যৌক্তিকীকরণ, পণ্যের বহুমুখীকরণ ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা হয়। এলডিসি তালিকা থেকে উত্তরণের পর বাংলাদেশের পরিকল্পনা জানার চেষ্টা করেছে আইএমএফ। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে রপ্তানি সুবিধা অব্যাহত রাখতে, বিশেষ করে জিএসপি প্লাস পাওয়ার জন্য বাংলাদেশ কী পদক্ষেপ নিচ্ছে, সে বিষয়টি আলোচনায় তোলে আইএমএফ। বলা হয়, ওই সময়ে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) প্রদত্ত সুবিধা অনুযায়ী বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সংঘটিত দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে শুল্ক সুবিধা হারাবে বাংলাদেশ।

সূত্র জানায়, উত্তরণ-পরবর্তী সময়ে যাতে সুনির্দিষ্ট দেশের বাণিজ্যে শুল্ক সুবিধা বজায় থাকে, সেজন্য পিটিএ, এফটিএ ও আরটি করার প্রয়োজন হবে। বাংলাদেশ কোন কোন দেশ ও অঞ্চলের সঙ্গে কোন ধরনের চুক্তি করতে যাচ্ছে এবং তার আলোচনা ও সম্ভাব্য অগ্রগতি কতটুকু, তা জানতে চায় আইএমএফ। স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ উৎপাদকদের সুরক্ষা দিতে বিভিন্ন পণ্য আমদানিতে ডব্লিউটিওর বাউন্ড রেটের অতিরিক্ত ট্যারিফ আরোপ করেছে। এটি কমিয়ে আনার বিষয়ে সরকারের পরিকল্পনাও জানতে চায় আইএমএফ।

সভায় আইএমএফ প্রতিনিধিরা পর্যবেক্ষণ দিয়ে বলেন, বৈশ্বিক সংকটে মানুষের ভোগ ও ব্যবহার চাহিদা দুটোই কমতে শুরু করেছে। এটি দীর্ঘায়িত হতে পারে। আইএমএফ মনে করে, একক রপ্তানিপণ্য হিসেবে তৈরি পোশাকের ওপর রপ্তানি আয়ের অতিনির্ভরতা বাংলাদেশের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করছে। এ অবস্থায় রপ্তানি ঝুঁকি কমাতে তৈরি পোশাকের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে পণ্যের বহুমুখীকরণে সুনির্দিষ্ট পণ্যভিত্তিক পদক্ষেপ দরকার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *