যে বড় সংকটে পড়বে বৈশ্বিক অর্থনীতি
চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার বাণিজ্যযুদ্ধই ২০১৯ সালে বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে বড় সংকট হতে যাচ্ছে না। বরং এ সময় সবচেয়ে বড় সংকট হবে বৃহদায়তনের ব্যবসাগুলোর ব্যর্থতা। সম্ভবত এর সঙ্গে যুক্ত হতে যাচ্ছে ব্যাংক ধসও।
২০১৮ সালের বড় সংকট ছিল যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্যযুদ্ধ। এর ফলে বিশ্বায়নের চাকা উল্টো দিকে ঘোরার পাশাপাশি বৈশ্বিক অর্থনীতির একগুচ্ছ উচ্চমাত্রায় সংরক্ষিত জাতীয় বাজারে রূপান্তরের শঙ্কাও দেখা দিয়েছিল।
তবে আর্থিক বাজার ও বৈশ্বিক করপোরেশনগুলো ২০১৯ সালে সমঝোতার টেবিলে টেনে আনবে দুই পক্ষকেই। ঠিক যেমনটি তারা ঘটিয়েছিল কয়েক মাস আগে নাফটার ক্ষেত্রে।
ফলে ২০১৯ সালে বৈশ্বিক অর্থনীতির সবচেয়ে বড় সমস্যা হতে যাচ্ছে বৃহদায়তনের ব্যবসাগুলোর ব্যর্থতা, যার ধারাবাহিকতায় উদীয়মান বাজারগুলোয় দেখা দিতে পারে ব্যাংক ধসও।
উন্নততর জীবনমান বজায় রাখার জন্য এসব বাজার বহুলাংশেই বিদেশী বিনিয়োগের ওপর নির্ভরশীল।
এর কারণ কী? উত্তর হলো, ঊর্ধ্বমুখী সুদহার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকারদের তৈরি ইজি মানির পরিসমাপ্তি।
এর ব্যাখ্যা সহজ ও অকপট। বৈশ্বিক অর্থনীতিতে চাহিদা ও জোগান বাড়ানোর মাধ্যমে অনেকটা সুনামির মতো কাজ করেছে ইজি মানি। চাহিদার দিক থেকে দেখতে গেলে, এর কারণে ভোক্তাদের মধ্যে ঋণ গ্রহণের প্রবণতা বেড়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, চীনের ঋণ-জিডিপি অনুপাত ২০০৮ সালের ১৮ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০১৮ সালে দাঁড়িয়েছে ৫০ শতাংশেরও বেশি। দেশটির করপোরেট খাতও এখন বেশ বড় ধরনের দেনায় ডুবে রয়েছে, যার পরিমাণ অজানা।
অন্যদিকে জোগানের দিক থেকে দেখতে গেলে, এর কারণে করপোরেশন ও উদ্যোক্তারা কম মুনাফার ব্যবসার দিকে ঝুঁকেছেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ফেডারেল রিজার্ভ অব সেন্ট লুইয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের শিল্প খাতের সক্ষমতার প্রয়োগ ২০০৯ সালে ছিল প্রায় ৬৭ শতাংশ। ২০১১ সালের মধ্যেই ৮০ শতাংশের একটু দূরে। (২০১৮ সালে এটি দাঁড়ায় ৮০ শতাংশের কাছাকাছি)।
অন্যদিকে এনএফআইবি (যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সংগঠন ন্যাশনাল ফেডারেশন অব ইনডিপেনডেন্ট বিজনেস) স্মল বিজনেস অপটিমিজম ইনডেক্সের সূচকমান ২০০৯ সালে ছিল ৮০-এর কাছাকাছি। ২০১৮ সালে তা দাঁড়িয়েছে ১০৮-এর কাছাকাছি। নিম্ন সুদহারের সময়কাল হিসেবে অভিহিত রিগানের শাসনামলের পর এটিই সর্বোচ্চ।
সহজ কথায়, ইজি মানি বৈশ্বিক অর্থনীতিকে টেনে এনেছে এক উচ্চপ্রবৃদ্ধির চক্রে।
বাড়তি ভোক্তা ঋণের কারণে ব্যয় বেড়েছে। ব্যয় বাড়ার কারণে বিনিয়োগ বেড়েছে। সৃষ্টি হয়েছে নতুন নতুন ব্যবসা। এ দুইয়ের ধারাবাহিকতায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও বেড়েছে, বেড়েছে আয় ও কর্মসংস্থানও।
অন্যদিকে বিনিয়োগ বাড়ার সুবাদে অর্থনীতির উৎপাদনশীলতাও বেড়েছে। এতে করে মূল্যস্ফীতিও হয়ে উঠেছে স্থিতিশীল। ফলে বিশ্বব্যাপী কেন্দ্রীয় ব্যাংকাররা তাদের ইজি মানি নীতির প্রয়োগ অব্যাহত রেখেছেন। এর সবকিছুই ছিল আর্থিক বাজারের জন্য স্বস্তির। কারণ এর সমৃদ্ধি নিহিত ইজি মানিতেই।
কিন্তু সাম্প্রতিক মাসগুলোয় পরিস্থিতিতে পরিবর্তন এসেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো এখন সুদহার বাড়াতে শুরু করেছে। উবে যাচ্ছে ইজি মানির সুনামি। এর ধারাবাহিকতায় অর্থনীতির চাহিদা ও জোগান— দুই দিকেই ধস নামার সম্ভাবনা রয়েছে।
এক্ষেত্রে চাহিদার দিক থেকে বলতে গেলে, ইজি মানি নীতির সমাপ্তি ঘটায় ভোক্তাদের জন্য ঋণ গ্রহণ আরো কঠিন হয়ে পড়বে। জোগানের দিক থেকে বলতে গেলে, এর কারণে ছিটকে পড়বে কম মুনাফার ব্যবসাগুলোও।
সহজ কথায়, ইজি মানির পরিসমাপ্তিতে নিম্নপ্রবৃদ্ধির মারাত্মক এক চক্রে পড়তে যাচ্ছে বৈশ্বিক অর্থনীতি। ভোক্তা ঋণ হ্রাসের কারণে কমে যেতে পারে ব্যয়ের মাত্রা। আর ব্যয়ের মাত্রা কমে যাওয়ার কারণে ধসের মুখোমুখি হতে পারে একের পর এক ব্যবসা।
২০০৮-০৯ সালে ফেডারেল রিজার্ভের সুদহার বৃদ্ধির অব্যবহিত পরেও তা-ই ঘটেছিল। মন্দায় পড়ে গিয়েছিল মার্কিন অর্থনীতি। সে সময় যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি প্রান্তিকে গড়ে ৬ হাজারটি ব্যবসায় ধস নামে।
বর্তমানে এ সমস্যাকে আরো প্রকট করে তুলতে পারে বিশ্বব্যাপী বিশ্বায়নবিরোধী নানা মতবাদের উত্থান। এর ফলে ২০১৯ সালের বৈশ্বিক অর্থনীতি নিয়ে হতাশার মাত্রা আরো বেড়ে যাবে।
ডেইলিএফএক্সের মুদ্রা বিশ্লেষক দিমিত্রি জাবেলিনের ভাষায়, ‘আমার দৃষ্টিকোণ থেকে, ২০১৯ সালে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির চিত্র বেশ হতাশাজনক। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় উদার-বিকল্প মতবাদগুলোর বৈশ্বিক ধারার মধ্যে বাজারে ধস নামানোর প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। ইউরোপে বড় ধরনের বিভেদের শঙ্কা থাকায় আগামী বছর অনুষ্ঠেয় ইইউর পার্লামেন্টারি নির্বাচন ইউরোপের বাজারকে করে তুলতে পারে থমথমে।’
বিশ্বায়নবিরোধী মতবাদগুলোকে আরো শক্তিশালী করে তুলতে পারে এশিয়ার শ্লথ প্রবৃদ্ধি। এ প্রসঙ্গে দিমিত্রি জাবেলিন বলেন, ‘ফেডের কঠোর নীতিমালার পরিপ্রেক্ষিতে বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিকে আরো নিম্নমুখী করে তুলতে পারে চীন ও জাপানের প্রবৃদ্ধির শ্লথতা, যার কারণে উদীয়মান বাজারগুলোর গতিবিধির প্রভাবাধীন বিনিয়োগকারীদের মধ্যেও দেখা দিয়েছে আতঙ্ক। অর্থনীতির প্রক্ষেপিত শ্লথ প্রবৃদ্ধির কারণে ২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠানবিরোধী দলের উত্থান ঘটতে পারে, যার ধারাবাহিকতায় ঝুঁকি কাটানোর প্রবণতা বাড়ার পাশাপাশি প্রবৃদ্ধির চিত্রে দেখা যাবে বেহাল দশা।’
যা ঘটতে যাচ্ছে, এর আঁচ পাচ্ছেন বিনিয়োগকারীরাও। ফলে অর্থনীতি সংবেদনশীল কোম্পানিগুলোর শেয়ার এখন তারা অল্প দামেই ছেড়ে দিচ্ছেন। অন্যদিকে দাম বাড়াচ্ছেন ট্রেজারি বন্ডের।
(ফোর্বসে প্রকাশিত। লেখক প্যানোস মুরদোকুতাস নিউইয়র্কের লং আইল্যান্ড ইউনিভার্সিটির অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও চেয়ার)