যে কারণে হুন্ডিতে ঝুঁকছেন প্রবাসীরা

স্টাফ রিপোর্টার

চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার প্রায় অর্ধলক্ষ মানুষ জীবিকার তাগিদে পাড়ি জমিয়েছেন মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। তাদের মধ্যে বেশিরভাগ প্রবাসীই টাকা পাঠান হুন্ডিতে (অবৈধ পথে টাকা পাঠানো)। হয়রানি, টাকা পেতে দেরি হওয়াসহ নানা অভিযোগে ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাঠানোয় অনীহা তাদের। বৈধভাবে রেমিট্যান্স পাঠানোয় সরকারের প্রণোদনার পরও হুন্ডিতে ঝুঁকছেন তারা। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের অর্থনীতি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মিরসরাইয়ে ১৬ ইউনিয়ন ও দুটি পৌরসভার মানুষ জীবিকার তাগিদে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমিয়েছেন। তবে এ উপজেলায় যত সংখ্যক প্রবাসী আছেন সে তুলনায় ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স আসছে না। ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানো ও পরিবারের পক্ষ থেকে সেটা তোলার প্রক্রিয়াকে ঝামেলা মনে করেন তারা। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে এক শ্রেণির অসাধু ব্যক্তি হুন্ডিকে জনপ্রিয় করছেন।

মিরসরাই উপজেলা পরিসংখ্যান কর্মকর্তা শাকিলা জান্নাত নিশাত বলেন, উপজেলার কতজন মানুষ প্রবাসে থাকে তার সঠিক হিসাব আমাদের কাছে নেই। তবে এরই মধ্যে আমরা প্রবাসীদের ওপর জরিপ করেছি। এ এলাকার প্রায় প্রতিটি পরিবারেই দু-একজন প্রবাসী রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে মিরসরাইয়ে প্রায় ৫০ হাজার প্রবাসী রয়েছেন। কিন্তু সঠিক তথ্য জানা যাবে জরিপের রিপোর্ট আসার পর। রিপোর্ট আসতে আরও কিছু সময় লাগবে। এছাড়া, ২০২২ সালে আদমশুমারির তথ্য অনুযায়ী এ উপজেলার ১৬ ইউনিয়ন ও দুই পৌরসভার মোট জনসংখ্যা চার লাখ ৭১ হাজার ৭৫২ জন।

প্রবাসীদের অভিযোগ, যে কোনো ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা পাঠাতে চাইলে নির্ধারিত ব্যাংকে গিয়ে কারেন্সি জমা দিতে হয়। ওই কারেন্সির টাকা দেশের যে কোনো ব্যাংক থেকে তুলতে চার-পাঁচ দিন সময় লাগে। টাকা তোলার জন্য প্রবাসীর পরিবারকে নির্ধারিত ব্যাংকে যেতে হয়। এতে যেমন দেরি তেমন ভোগান্তিতেও পড়তে হয়। কিন্তু হুন্ডিতে টাকা পাঠাতে সময় লাগে না। ওই টাকা সঙ্গে সঙ্গে পরিবারের কাছে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। এজন্য পরিবারের মাসিক খরচের টাকা হুন্ডির মাধ্যমে পাঠাতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন তারা।

সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রবাসী কামরুল হাসান বলেন, প্রথমত আমি চেষ্টা করি ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা পাঠাতে। পরে ব্যাংকে যাতায়াত ও এক্সচেঞ্জ চার্জ বাঁচাতে হুন্ডিতে টাকা পাঠানো শুরু করি। শুধু তাই নয়, যার কাছে টাকা পাঠাই তাকেও ব্যাংকে যেতে হয়, সিরিয়াল ধরতে হয়। অনেক সময় যাতায়াত ও হয়রানির শিকার হতে হয়।

উপজেলার সাহেরখালী ইউনিয়নের গজারিয়া এলাকার গৃহবধূ রোকেয়া বেগম বলেন, আমার স্বামী ও দুই ছেলে বিদেশে থাকে। বাড়িতে কোনো পুরুষ নেই। ব্যাংকে টাকা পাঠালে অনেক ঝামেলায় পড়তে হয়। তাছাড়া হুন্ডিতে টাকা পাঠালে বাড়ি এসে দিয়ে যায়। এতে কোথাও যেতে হয় না, আর ভোগান্তিতেও পড়তে হয় না।

উপজেলার ইছাখালী ইউনিয়নের লুদ্দাখালী এলাকার খোরশেদ আলম দীর্ঘদিন ধরে সংযুক্ত আরব আমিরাতে থাকেন। তিনি টাকা পাঠান হুন্ডির মাধ্যমে। প্রবাসে থাকা হুন্ডির এজেন্টদের কাছে টাকা জমা দিয়ে দেশে তার ছোট ভাই আনোয়ারকে ফোনে জানিয়ে দেন। ভাইয়ের ফোন পাওয়ার আধঘণ্টার মধ্যেই গ্রাহকের ফোনে একটি অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন আসে তথ্য যাচাইয়ের জন্য। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই গ্রাহকের দেওয়া ঠিকানায় টাকা নিয়ে চলে আসেন অপরিচিত ব্যক্তি।

ব্যাংকিং চ্যানেলে অনীহার কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে টাকা পাঠালে ১ দিরহামে পাওয়া যায় ২৯.৯৩ টাকা। হুন্ডিতে পাঠালে ১ দিরহামে দেয় ৩১.৬০ টাকা। এক হাজার দিরহামে ব্যাংকে দেয় ২৯ হাজার ৯৩০ টাকা আরও হুন্ডিতে পাওয়া যায় ৩১ হাজার ৬০০ টাকা। ১০০০ দিরহামে ব্যাংকের চেয়ে হুন্ডিতে এক হাজার ৬৭০ টাকা বেশি পাওয়া যায়। এ কারণেও অনেক প্রবাসী ব্যাংকে টাকা না পাঠিয়ে হুন্ডিতে পাঠান।

এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে মিরসরাইয়ে হুন্ডির কয়েকটি সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। তাদের নিয়ন্ত্রণ করে চট্টগ্রাম শহরের রিয়াজুদ্দিন বাজার ও তামাকুমন্ডি লেনের কয়েকটি সিন্ডিকেট। প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা লেনদেন হয় হুন্ডিতে। প্রবাসীদের একটি বড় অংশ, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে থাকা প্রবাসীদের বেশিরভাগই হুন্ডির মাধ্যমে দেশে টাকা পাঠাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন।

জানা যায়, সারাবছর হুন্ডি ব্যবসায়ীদের আনাগোনা থাকলেও ঈদের সময় তা বেড়ে যায়। মিরসরাইয়ের বারইয়ারহাট, দারোগারহাট, নিজামপুর, বড়তাকিয়া, মিরসরাই সদর, জোরারগঞ্জ, মিঠাছড়ায় হুন্ডি ব্যবসায়ীদের শক্তিশালী নেতৃত্বের পাশাপাশি উপকূলীয় অঞ্চল (ডোমখালী, সাহেরখালী, আবুতোরাব, শান্তিরহাট, বামনসুন্দর দারগারহাট, ঝুলনপোল, আবুরহাট) ও ভারতীয় সীমান্তবর্তী করেরহাটসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় হুন্ডি ব্যবসায়ীদের অপতৎপরতা রয়েছে।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম বলেন, হুন্ডি প্রবাসীদের জন্য একটি অতি সহজ পদ্ধতি। কাগজপত্রে সই করা লাগছে না, কোনো ঝামেলা নেই, খুব সহজে দেশে টাকা পাঠানো যাচ্ছে। এটি রোধ করা অসম্ভব। বরং আগামীতে আরও বাড়তে পারে। আমাদের দেশের অনেক প্রবাসী বৈধ চ্যানেলের বাইরে হুন্ডিতে টাকা পাঠাতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।

তিনি আরও বলেন, বৈধ চ্যানেলের বাইরে লেনদেনে রাষ্ট্র বঞ্চিত হয় আর কালোবাজারিরা লাভবান হন। ডলার ক্রাইসিস থেকে উত্তরণে এ সমস্যা বন্ধ হবে না। সরকার যদি পাচার রোধ করতে পারে তাহলে অবৈধ লেনদেন রোধ করা সম্ভব। এটি এখন বাংলাদেশের অন্যতম সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মিরসরাই সদরের একটি বেসরকারি ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বলেন, প্রবাসীদের ব্যাংকিং চ্যানেলের দিকে ফেরাতে সরকার নানামুখী কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে। দেশের যে কোনো ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠালে এক লাখে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। তারপরও ব্যাংকিং চ্যানেল বহির্ভূতভাবে রেমিট্যান্স আসা দুঃখজনক। এ থেকে প্রবাসীদের বের করে নিয়ে আসতে না পারলে দেশের অর্থনীতিতে অনেক প্রভাব পড়বে। এখন গ্রামীণ সব বাজারে বিভিন্ন ব্যাংকের এজেন্ট শাখা চালু রয়েছে। একেবারে গ্রাহকদের হাতের নাগালে বলা যায়।

হুন্ডিকে কোটি কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য থাকলে ব্যবসা বন্ধে এখনো পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ নেয়নি প্রশাসন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ব্যবসা পরিচালনা করছেন তারা।

এ বিষয়ে মিরসরাই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. কবির হোসেন বলেন, হুন্ডি ব্যবসায়ীরা প্রকাশ্যে আসেন না। হুন্ডিতে অবৈধভাবে লেনদেনের দেখভালের দায়িত্বে সুনির্দিষ্ট করে কেউ নেই। মিরসরাইয়ে এখন পর্যন্ত কেউ কোনো হুন্ডি ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে অভিযোগ দেননি। অভিযোগ পেলে আমরা তদন্ত সাপেক্ষে আইনি ব্যবস্থা নেবো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *