যে কারণে দীর্ঘ হচ্ছে চা-শ্রমিক আন্দোলন

স্টাফ রিপোর্টার

চা-শ্রমিকের আন্দোলন নিয়ে খেলা চলছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, প্রশাসন ও অন্যান্য শ্রমিক সংগঠন ক্রেডিট দেখাতে গিয়ে আন্দোলন দীর্ঘ হচ্ছে। মূল সংগঠন চা-শ্রমিক ইউনিয়ন নেতাদের হাতে নেই এর চাবিকাটি। সাধারণ শ্রমিকদের সঙ্গে নেতাদের সমন্বয়হীনতার অভাবে এমনটাই হচ্ছে বলে জানিয়েছেন চা শ্রমিক নেতারা।

আন্দোলন কোন দিকে যাচ্ছে এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে সাধারণ শ্রমিকদের মাঝে। পক্ষকালব্যাপী তাদের এ আন্দোলনের কী ফলাফল আসবে তা নিয়েই ভাবনায় পড়েছেন তারা।

শনিবার বিকেলে মৌলভীবাজার-৪ আসনের এমপি মো. আব্দুস শহীদের মধ্যস্ততায় শ্রম অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খালেদ মামুন চৌধুরীর উপস্থিতিতে ২৫ টাকা মজুরি বৃদ্ধি করে ১৪৫ টাকা করা হয়। এ সময় চলমান আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন শ্রমিক নেতারা। কিন্তু এর ৩ ঘণ্টা পর সেই সিদ্ধান্ত সাধারণ শ্রমিকরা প্রত্যাখান করায় বেকায়দায় পড়ে যান চা-শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা। তাদের হাত থেকে ফসকে যায় আন্দোলনের চাবিকাটি।

পরদিন চা বাগানের যুব সমাজের সক্রিয় ভূমিকায় জোরদার হয় আন্দোলন। বাগান থেকে বেরিয়ে এসে হাজার হাজার নারী শ্রমিক আঞ্চলিক মহাসড়ক অবরোধ করেন।

এর একদিন পর ২১ আগস্ট মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসানের উদ্যোগে তার কার্যালয়ে মধ্যরাতের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় পূর্বের মজুরি ১২০ টাকায় কাজে ফিরবেন শ্রমিকরা। প্রধানমন্ত্রী তাদের মজুরির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেবেন। তার প্রতি সম্মান জানিয়ে তারা ধর্মঘট প্রত্যাহার করবেন। কিন্তু না, রাতের সিদ্ধান্ত আবার সকালে মেনে নেননি শ্রমিকরা। তারা আবার আন্দোলনে নেমে যান।

কথা ছিল কাজে ফিরবেন। কিন্তু বাংলাদেশ টি স্টেইটের ট্রেড ইউনিয়নভুক্ত ১৬৭ চা বাগানের মধ্যে মৌলভীবাজার ৯২টি বাগানের ৯৫ ভাগ শ্রমিকরা কাজে ফেরেননি। সরলমনা অবহেলিত চা শ্রমিকরা মনে করেন শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা মালিক পক্ষের সঙ্গে আতাত করে তাদের ধোকা দিয়ে বোকা বানাচ্ছে। তাদের অভিমত আগের মজুরি ১২০ টাকায় ফিরে যাওয়াই কী কষ্টের আন্দোলনের ফসল?

জানা গেছে, চা শ্রমিকদের মাঝে চা-শ্রমিক ইউনিয়ন, চা-শ্রমিক ফেডারেশন ও চা-ছাত্র যুব পরিষদ এই ৩টি সংগঠন কাজ করছে। মূল সংগঠন চা শ্রমিক ইউনিয়নসহ আন্দোলনে ৩টি সংগঠনই সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে। ২০ আগস্টের পর চা-শ্রমিক ইউনিয়ন কিছুটা পিছিয়ে গেছে। তবে শ্রমিকদের আন্দোলন বেগবান করার পেছনে নেপথ্য ভূমিকা রয়েছে চা-ছাত্র যুব পরিষদের নেতা কর্মীদের। এমনটাই মনে করছে প্রশাসন ও অন্যান্য মহল।

তবে চা-ছাত্র যুব পরিষদের নেতৃবৃন্দ জানিয়েছেন তারা নেতৃত্বে নেই। আন্দোলনে শ্রমিকদের সহযোগিতা করছেন। বাগানে বাগানে ছাত্র যুবসমাজ জেগে উঠেছে।

এদিকে ১২০ টাকা মজুরিতে কাজে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্তকে প্রত্যাখান করে শ্রমিকরা তাদের নেতাদের দালাল আখ্যায়িত করছেন। এমনকি কোনো কোনো স্থানে নেতাদের লাঞ্ছিত করেছেন। এতে মঙ্গলবার থেকে কোনো ভূমিকায় নেই চা- শ্রমিক ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ। নিরাপদে থাকার জন্য তারা ফোনও বন্ধ রেখেছেন। দেওয়ালে পিঠ টেকে যাওয়ায় এখন প্রতিটি বাগানের বাগান পঞ্চায়েত সভাপতিরাই নেতেৃত্বের হাল ধরেছেন।

একাধিক বাগান ঘুরে চা-শ্রমিকের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে ভালো নেই তারা। রাজনগর উপজেলার উদনা ছড়া চা-বাগানের চম্পাবতী কৈরী, লীলাবতী কৈরী, শ্রীমতি কৈরী ও যমুনা বাউরির সঙ্গে কথা হলে তারা বলেন, আজ ১৫ দিন পার হলো আমরা এক বেলা না খেয়ে ঋণ করে সংসার চালাচ্ছি। সরকার কি আমাদের কথা শুনে না।

প্রতি বছর সরকার চা-শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য প্রতি শ্রমিককে মাথাপিছু ৫ হাজার টাকা ত্রাণ দেয়। সেই টাকা পান কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তারা বলেন, আমাদের পঞ্চায়েত সভাপতি শুধু আশ্বাস দেয় আমরা পাইনি।

শ্রীমঙ্গলের কালিঘাট চাবাগানের লক্ষ্মীবালা বলেন, মজুরি না বাড়ালে আমরা আর চলতে পারি না। জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে কয়েকগুণ। আয়ের সঙ্গে ব্যয় মেলাতে হিমশিম খাচ্ছি।

জুড়ী ভ্যালীর সভাপতি কমল বুর্নাজি বলেন, আমরা আর সাধারণ শ্রমিকদের সঙ্গে নেই। আমরা আন্দোলন প্রত্যাহার করেছি। আমাদের সঙ্গে যারা আছে তারা কাজে যাবে।

লংলাভ্যালীর সভাপতি শহীদুল ইসলাম বলেন, আমাদের বিরোদ্ধে কে বা কারা সাধারণ শ্রমিকদের ভূল ধারণা দিচ্ছে। তাদের সঙ্গে আমাদের সমন্বয় হচ্ছে না। আমরা আর শ্রমিকদের সঙ্গে নেই।

বালিসিড়া ভ্যালীর সভাপতি বিজয় হাজরা বলেন, মজুরি নিয়ে সিদ্ধান্ত পাল্টাপাল্টির কারণে শ্রমিকদের সঙ্গে আমাদের দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে গেছে। সমন্বয়হীনতার অভাব দেখা দিয়েছে। এখন আন্দোলনের কী হবে তা জানি না।

এদিকে শ্রমিকদের কাজে নামানোর জন্য জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান ও পুলিশ সুপার মো. জাকারিয়া বাগানে বাগানে গিয়ে শ্রমিকদের সঙ্গে বৈঠক করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অচলাবস্থা পুরোপুরি কাটছে না। জেলার সামান্য কিছু বাগানের শ্রমিকরা কাজে যোগ দিলেও অধিকাংশরা কর্মবিরতি পালন করছেন।

জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান বলেন, আমরা রোববার রাতে শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে বিষয়টির সমাধান করলাম। শ্রমিকরা প্রধানমন্ত্রীর বার্তা শুনছে না। কয়েক দিনের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী তাদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে কথা বলে ন্যায্য মজুরি নির্ধারণ করবেন।

এদিকে মজুরি বাড়ানোর দাবিতে চলমান সংকট ও অচলাবস্থা নিরসনে শ্রম ও কর্মসংস্থান অধিদপ্তর উদ্যোগ নিয়েছে। আগামী ২৫ আগস্ট বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টায় শ্রম ভবনের সভাকক্ষে চা শ্রমিক নেতারা এক বৈঠকের আয়োজন করেছেন। এ বৈঠকে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুন্নুজাহান সুফিয়ানের সভাপতিত্ব করার কথা রয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *