যে কারণে দিশেহারা বিনিয়োগকারীরা

স্টাফ রিপোর্টার

৫০ টাকা করে বিডি থাই ফুডের শেয়ার কেনেন অপূর্ব। সময়টা গত ডিসেম্বরের মাঝামাঝি। যেদিন এই বিনিয়োগকারী কোম্পানিটির শেয়ার কেনেন, তার পর থেকেই শুরু হয় দরপতন। ধারাবাহিকভাবে কমতে কমতে কোম্পানিটির শেয়ার দাম এখন নেমেছে ৩৪ টাকা ৮০ পয়সায়। ফ্লোর প্রাইসের কারণে এর নিচে কোম্পানিটির শেয়ার দাম কমার সুযোগ নেই।

ধারাবাহিকভাবে দাম কমায় বিডি থাই ফুডের শেয়ার আর বিক্রি করতে পারেননি অপূর্ব। ফলে আটকে গেছে তার বিনিয়োগ করা টাকা। ক্রেতা না থাকায় এখন লোকসানেও তার কাছে থাকা শেয়ার বিক্রি করতে পারছেন না। ফলে নতুন বিনিয়োগের পথও বন্ধ হয়ে গেছে এই বিনিয়োগকারীর।

এর আগে এক বছরের বেশি সময় ধরে তার বিনিয়োগ করা টাকার বড় অংশ আটকে রয়েছে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো, ট্রাস্ট ব্যাংক ফার্স্ট মিউচ্যুয়াল ফান্ড, জেনারেশন নেক্সট, রবি, এসিআই ফরমুলেশন, বে-লিজিংসহ আরও কয়েকটি কোম্পানিতে। এসব কোম্পানির শেয়ার দাম দীর্ঘদিন ধরে ফ্লোর প্রাইসে আটকে রয়েছে। ক্রেতা না থাকায় শেয়ার বিক্রি করতে পারছেন না।

এভাবে একের পর এক কোম্পানিতে টাকা আটকে যাওয়ার বিষয়ে অপূর্ব বলেন, ফ্লোর প্রাইসের কারণে আগে বিনিয়োগ করা সব টাকাই আটকে রয়েছে। আগে যেসব কোম্পানির শেয়ার ও মিউচ্যুয়াল ফান্ড কেনা ছিল তার একটিও বিক্রি করতে পারছি না।

তিনি বলেন, কিছু টাকা জোগাড় করে গত ডিসেম্বরে নতুন করে বিডি থাই ফুডের কিছু শেয়ার কিনি। আমি যখন শেয়ার কিনি, তার আগে প্রতিদিন বিডি থাই ফুডের শেয়ার ভালোই লেনদেন হচ্ছিল। কিন্তু আমি শেয়ার কেনার পর থেকেই দাম কমতে থাকে। এখন দাম কমতে কমতে ফ্লোর প্রাইসে এসে ঠেকেছে। ক্রেতা না থাকায় এখন এ কোম্পানিটির শেয়ারও বিক্রি করতে পারছি না। এখন আমার সব টাকাই আটকে গেছে। পোর্টফোলিওতে থাকা কোনো শেয়ার যেমন বিক্রি করতে পারছি না, তেমনি নতুন করে কিছু কিনতেও পারছি না। কবে এসব শেয়ার থেকে বের হতে পারবো তার কিছুই বুঝতে পারছি না।

শুধু অপূর্ব নয়, শেয়ারবাজারের অধিকাংশ সাধারণ বিনিয়োগকারীর এখন এমন দিশেহারা অবস্থা। এসব বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ করা অর্থের সিংগভাগ আটকে আছে। আর বাজারের এমন চিত্রে ব্রোকারেজ হাউজ সংশ্লিষ্টদের চোখে-মুখে স্পষ্ট হয়ে উঠছে বিস্ময়।

শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্ট ও বিশ্লেষকরা বলছেন, বৈশ্বিক পরিস্থিতি এবং ডলার সংকটের কারণে কয়েক মাস ধরেই শেয়ারবাজারে মন্দাভাব চলছে। এর সঙ্গে শেয়ারবাজারে বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে ফ্লোর প্রাইস। ফ্লোর প্রাইসের কারণে বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ করা টাকা আটকে যাচ্ছে। ফলে কমছে লেনদেনের গতি।

তারা বলছেন, ফ্লোর প্রাইসের কারণে একদিকে শেয়ারবাজারের স্বাভাবিকতা নষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে কারসজিচক্র নিচ্ছে এর সুবিধা। বর্তমান মন্দা পরিস্থিতিতেও একটি বিশেষ চক্র বাজারে কারসাজিতে লিপ্ত রয়েছে। এসব কারসাজিচক্রের বিরুদ্ধে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) শক্ত কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। ফলে বাজারের ওপর থেকে বিনিয়োগকারীদের আস্থা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, যা দীর্ঘ মেয়াদের জন্য শেয়ারবাজারের ক্ষতি করছে।

বাজার পর্যালোচনায় দেখা যায়, শেষ সাত কার্যদিবসের একদিনও প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) পাঁচশ কোটি টাকার লেনদেনের দেখা মেলেনি। এর মধ্যে এক কার্যদিবসে তিনশ কোটি টাকার কম এবং দুই কার্যদিবসে লেনদেন হয়েছে চারশ কোটি টাকার কম। এমন লেনদেন খরার মধ্যে শেষ সাত কার্যদিবসে ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক কমেছে ৬৫ পয়েন্ট। আর বাজার মূলধন কমেছে ৪ হাজার ১৪৩ কোটি টাকা।

অবশ্য বাজারের পতনের মাত্রা যতটা, বিনিয়োগকারীদের ক্ষতির মাত্রা তার কয়েকগুণ বেশি। কারণ প্রতিদিন যে হারে সিংহভাগ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার দাম কমছে, সেই হারে মূল্যসূচক কমছে না। ফলে বিনিয়োগকারীদের ক্ষতির মাত্রা কতটা, সেটা সূচকের পতন দিয়ে সঠিকভাবে পরিমাপ করা যাচ্ছে না।

এ বিষয়ে বিনিয়োগকারী মশিউর রহমান বলেন, নিয়মিত ভালো লেনদেন হওয়া এবং বড় লভ্যাংশ দেওয়ায় গত বছরের সেপ্টেম্বরে সামিট পাওয়ারের শেয়ার কিনি। আমি শেয়ার কেনার পর কিছুদিন কোম্পানিটির শেয়ার ভালো লেনদেন হয়। এরপর হঠাৎ করেই দাম কমে ফ্লোর প্রাইসে চলে আসে। পরে আর ফ্লোর প্রাইসের ওপরে ওঠেনি কোম্পানিটির শেয়ার দাম। অপরদিকে ফ্লোর প্রাইসে প্রতিদিন লাখ লাখ শেয়ার বিক্রির আদেশ আসছে, কিন্তু ক্রেতা নেই। ফলে একটি শেয়ারও বিক্রি করতে পারিনি। এভাবেই আমার সব টাকা শেয়ারে আটকে গেছে। জরুরি প্রয়োজনেও শেয়ার বিক্রি করে কোনো টাকা তুলতে পারছি না।

মো. সোহেল নামে আরেক বিনিয়োগকারী বলেন, প্রতিদিন যে কয়টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার দাম বাড়ছে, তার পাঁচ-দশগুণ বেশি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার দাম কমছে। কিন্তু সূচক খুব একটা কমছে না। বরং, অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের দরপতনের মধ্যেও সূচক বাড়তে দেখা গেছে। বাজারে এ এক অন্য রকম পরিস্থিতি দেখতে হচ্ছে আমাদের।

তিনি বলেন, বাজারে অর্ধেকের বেশি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার লেনদেন হচ্ছে না। গুটিকয়েক কোম্পানির শেয়ার লেনদেন হচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানের শেয়ারে বিনিয়োগ করেও স্বস্তি নেই। একটি ভালো সংবাদ পেয়ে বিডি ওয়েল্ডিংয়ের শেয়ার কিনি। আমি যেদিন কোম্পানিটির শেয়ার কিনেছি, পরের দিন থেকেই সর্বনিম্ন দামি শেয়ারের বিপুল পরিমাণ বিক্রির আদেশ আসছে। ক্রেতা না থাকায় ওই শেয়ার আর বিক্রি করতে পারছি না। প্রতিদিন একটু একটু করে শেয়ার দাম কমতে দেখছি। আমার মতো সাধারণ বিনিয়োগকারীদের এখন দিশেহারা অবস্থা। কোথায় গেলে হারানো পুঁজি ফিরে আসবে, সেই পথ কারও যেন জানা নেই।

এ বিষয়ে বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, বাজার পড়তে না দিয়ে জোর করে আটকে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। এতে লেনদেন কমবেই। ফ্লোর প্রাইস দিয়ে বাজারের লংটার্ম একটা ক্ষতি করা হয়েছে। যারা ভালো বিনিয়োগকারী তারাও বাজারের ওপর থেকে আস্থা হরিয়ে ফেলেছে। ভালো ভালো কোম্পানির শেয়ার প্রয়োজনে বিক্রি করতে পারছে না, আটকে গেছে।

‘ব্যাংকে টাকা রাখলে তোলা যায়, এফডিআর করলে টাকা তোলা যায়। এখানে (শেয়ারবাজার) আমার টাকা আটকে আছে ছয় মাস ধরে, তাহলে কি আমি এখানে বিনিয়োগ করবো ভবিষ্যতে? এর মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের আস্থা নষ্ট করা হয়েছে। এভাবে চললে বাজারের ওপর কারও আস্থা থাকবে না। ভবিষ্যতে বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও বিনিয়োগ করবে না।’

তিনি আরও বলেন, কারসাজিচক্রের বিরুদ্ধে নিয়ন্ত্রক সংস্থার কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ না করাও বাজারের ওপর থেকে বিনিয়োগকারীদের আস্থা নষ্ট হওয়ার একটি কারণ। বর্তমানে অল্প কয়েকটি কোম্পানির শেয়ার লেনদেন হচ্ছে। এর মধ্যেও কারসাজির ঘটনা ঘটছে। বাজারটা চলছে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করে। এভাবে বাজার চললে কারসাজি তো হবেই।

ডিএসইর এক সদস্য বলেন, শেয়াবাজারে এখন যে মন্দাভাব দেখা যাচ্ছে তার মূল কারণ বিনিয়োগকারীদের টাকা আটকে যাওয়া। এর সঙ্গে বৈশ্বিক পরিস্থিতি ও ডলার সংকটেও শেয়ারবাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। ফ্লোর প্রাইসের কারণে অধিকাংশ বিনিয়োগকারীর টাকা আটকে গেছে। শেয়ার বিক্রি করতে না পারায় তারা এখন নতুন বিনিয়োগ করতে পারছেন না। আমরা ব্রোকারেজ হাউজগুলোও বড় সমস্যায় আছি। বাজার পরিস্থিতি নিয়েও আমরাও খুব টেনশনে।

ডিএসইর আরেক সদস্য বলেন, ফ্লোর প্রাইস দিয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কোনো লাভ হয়নি। এর মাধ্যমে মূলত এক শ্রেণির কারসাজিচক্রকে সুবিধা দেওয়া হয়েছে। বর্তমান বাজারেও ওই চক্র এর সুবিধা নিচ্ছে। গুটিকয়েক কোম্পানির শেয়ার তারা দলবদ্ধ লেনদেনের মাধ্যমে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করছেন। সাধারণ বিনিয়োগকারীরা যখন এসব কোম্পানির শেয়ার কিনছেন, তখনই আটকে যাচ্ছেন। বাজারে এক বিস্ময়কর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। আগে কখনো এমন অবস্থা বাজারে দেখিনি।

একটি ব্রোকারেজ হাউজে ট্রেডিংয়ের দায়িত্ব পালন করা শুভ বলেন, দীর্ঘদিন ধরে শেয়ারবাজারের সঙ্গে যুক্ত রয়েছি। ২০১০ সালের মহাধস দেখেছি। ক্ষেত্র বিশেষে বর্তমান বাজার পরিস্থিতি ২০১০ সালের মহাধসের পরের পরিস্থিতি থেকেও খারাপ। বিনিয়োগকারীরা যখন যে শেয়ার কিনছেন, সেই শেয়ারে আটকে যাচ্ছেন। এমন বিস্ময়কর পরিস্থিতি আগে কখনো শেয়ারবাজারে দেখিনি।

যোগাযোগ করা হলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, শেয়ারবাজারে লেনদেনের গতি বাড়ানোর জন্য আমরা প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ বাড়ানোর ক্ষেত্রে মোটিভেট করছি। অল্প কিছুদিনের মধ্যে ডিসেম্বর ক্লোজিং প্রতিষ্ঠানগুলোর লভ্যাংশের ঘোষণা আসবে। আমরা আশা করছি বাজার পরিস্থিতি ভালো হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *