মৌমাছিদের জীবন যেন এক বিস্ময়কর রহস্য

পতঙ্গদের বিশিষ্ট সদস্য মৌমাছির জগতের ভুল করে একবার ঢুকে পড়লে কিন্তু তাজ্জব বনে যেতে হয়। ইংরেজিতে এদের ‘হানি-বি’ বললেও বৈজ্ঞানিকরা তাদের ভাষায় সুন্দর একটা নাম দিয়েছেন এদের। নামটি হল ‘এপিস’। নামটি এসেছে লাতিন শব্দ ‘এপিস’ থেকে। প্রচুর ঘাম ঝরিয়ে, দিনের পর দিন, রাতের পর রাত বনজঙ্গলের এ প্রান্ত-ও প্রান্ত তন্ন তন্ন করে খুঁজে প্রাণিবিজ্ঞানীরা আপাতত কুড়ি হাজার রকমের মৌমাছির খোঁজ পেয়েছেন।

তাদের মধ্যে রয়েছে ‘এপিস ইন্ডিকা’, ‘এপিস সেরানা’, ‘এপিস ডোরসাটা’, ইত্যাদি। আরও কিছু মৌমাছির খোঁজ যে শিগগির পাওয়া যেতে পারে, তেমন ইঙ্গিতও দিয়ে রেখেছেন তারা। কিন্তু যত প্রজাতিরই মৌমাছি থাকুক না কেন, এদের সংসার বড় বিচিত্র।

যারা এতদিন শুধু মানুষকেই ঘোর সংসারী বলে ভেবে এসেছেন, তাদের ধ্যান-ধারণা বদলে ফেলতে হবে মৌমাছির সংসারের কথা জানলে। কারণ মৌমাছিরা কিন্তু মানুষের চেয়েও অনেক গুণ বেশি সংসারী। নাছোড়বান্দা বিজ্ঞানীরা রীতিমতো পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে এ কথা একেবারে যুক্তি-তথ্য দিয়ে প্রমাণ করে দিয়েছেন। একটা মাঝারি আকারের মৌচাকের ভেতর থাকে প্রায় ষাট হাজার মৌমাছি।

সে জন্যই তো এদের বলে ‘সোশাল ইনসেক্ট’ বা ‘সামাজিক পতঙ্গ’। এবার না হয় জানা যাক মৌচাকের বাসিন্দাদের কিছু খবরাখবর। নিজেদের সমাজে এক একজনের কাজের ভিত্তিতে মৌমাছির দল নিজেদের মধ্যে একটা ভাগাভাগি করে নিয়েছে। বলা যায়, নিজেরাই নিজেদের মধ্যে তৈরি করে নিয়েছে একটা ভেদাভেদ।

কিন্তু এই গোটা ব্যাপারটাই তারা করেছে নিজেদের ছোট্ট দুনিয়ার মধ্যে, তাদের মৌচাকের ভেতরে। এই ভাগাভাগিটাও কিন্তু ভারি মজার। একটা মৌচাকের মধ্যে থাকে একটি রানী মৌমাছি। রানী বলে কথা! তাই আকারেও রানী মৌমাছি অন্যদের চেয়ে আলাদা। বেশ বড়সড় আর মোটাসোটা।

তাকে অগ্রাহ্য করবে এমন ক্ষমতা মৌচাকে কারও নেই। কারণ তার হাতেই তো রয়েছে রাজ্য শাসনের রাজদণ্ড, অর্থাৎ মৌচাকের ভেতরের যাবতীয় শাসনক্ষমতা। মৌচাকের মধ্যে বিশেষ একটি ওয়াক্স সেল-এ থাকে রানী মৌমাছি। একেবারে সম্রাজ্ঞীর মতো! এই বিশেষ কক্ষটির নাম হল ‘কুইনস চেম্বার’। মৌচাকের অন্য সদস্যদের মধ্যে রয়েছে পুরুষ মৌমাছি ও শ্রমিক মৌমাছি। সবাই থাকে মিলেঝুলে, জোটবদ্ধভাবে। সত্যি কথা বলতে কী, রানী মৌমাছির সাম্রাজ্যে সে নিজেই সর্বেসর্বা।

পুরুষ মৌমাছিরা প্রজনন ছাড়া বিশেষ কোনো কাজেই অংশগ্রহণ করার চেষ্টা করে না। তাই বেশির ভাগ কাজই করে শ্রমিক মৌমাছির দল। এরা হল আসলে মেয়ে মৌমাছি, যাদের ওপর রয়েছে অনেক গুরুদায়িত্ব। এরা আবার ভীষণ প্রভুভক্ত। এমনকী, এদের আনুগত্যও খুব। দরকার পড়লে নিজেদের প্রাণের বিনিময়েও রানী মৌমাছিকে বাঁচাতে এরা কোমর বেঁধে সব সময় প্রস্তুত।

রানীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ছাড়াও এদের কিন্তু উদয়ান্ত নানা কাজ। নিজেদের ঘরদোর অর্থাৎ মৌচাকটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, ফুলে-ফুলে উড়ে বেড়িয়ে মধু সংগ্রহ করা, রানী মৌমাছির জন্য খাবার জোগাড় করা, সন্তান-সন্ততিদের খাওয়ানো-দাওয়ানো, মৌচাকের ভেতর ওয়াক্স সেল তৈরি ইত্যাদি। ফুল থেকে যত্ন করে মধু ও রেণু বয়ে নিয়ে আসে তারা মৌচাকে। তবে ভুল করেও অন্যের মৌচাকে ঢুকে পড়ে না কিন্তু! তারা জানে যে, ভুলেও অন্যের মৌচাকে ঢুকে পড়লে বা উঁকি মারতে গেলে তাদের ঘোর বিপদ।

তাই খাদ্য সংগ্রহ হয়ে গেলে অদ্ভুত সব আকার-ইঙ্গিতে নির্ভুলভাবে তারা খুঁজে নেয় নিজেদের মৌচাকটি। তারপর মৌচাকে ফিরে নিজেদের শরীরের বিশেষ গ্ল্যান্ডের সাহায্যে তৈরি করে ‘রয়াল জেলি’ নামের একটি পদার্থ। কিন্তু কিছুদিন পর যখন তাদের এই গ্ল্যান্ড ধীরে ধীরে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে, তখন তারা মন দেয় ‘কোম্ব সেল’ তৈরির কাজে।

পোকা-মাকড় হলে হবে কী, বয়স তো আর থেমে থাকে না। তাই বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এদের কাজের ধরনও যায় বদলে। বাইরে বাইরে কাজকর্ম করার চেয়ে মৌচাকের ভেতরের নানা খুঁটিনাটি কাজেই তখন তারা মনোযোগ দেয় বেশি। ঠিক যেন মানুষেরই মতো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *