মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি এক দশকেও হয়নি
প্রায় ১০ বছর ধরে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) নিয়ে আলোচনা চলছে। তবে এখন পর্যন্ত কোনো দেশের সঙ্গেই এ চুক্তি করা সম্ভব হয়নি। এদিকে সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হয়ে যাবে বাংলাদেশ। তখন বিভিন্ন দেশে এখনকার মতো শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা পাওয়া যাবে না। একই সঙ্গে রপ্তানির বিপরীতে প্রণোদনা ও নগদ সহায়তাও দেওয়া যাবে না। এতে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জে পড়বে রপ্তানি বাণিজ্য।
এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নির্দিষ্ট কয়েকটি দেশের জিএসপি বা শুল্কমুক্ত সুবিধার ওপর নির্ভর না করে ২০২৬ সালের মধ্যেই বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় ও আঞ্চলিক মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) করার পরামর্শ দিয়ে আসছেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, প্রতিবেশী ছোট অর্থনীতির দেশ ভুটানের সঙ্গে শুধু বাংলাদেশের অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি (পিটিএ) সই হয়েছে। এর বাইরে অন্য কোনো দেশের সঙ্গে পিটিএ বা এফটিএ করা সম্ভব হয়নি। অথচ পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনামের সঙ্গে এফটিএ আছে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) ২৭ দেশসহ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, ভারত, চিলি, চীন, সিঙ্গাপুর, ব্রুনেই, বেলারুশ, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তানসহ ৫০টির মতো দেশের।
এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, ২০১০ সালে ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণে বিভিন্ন ধরনের দ্বিপক্ষীয় চুক্তির জন্য একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়। কোন কোন দেশের সঙ্গে এফটিএ বা এর আদলে অন্য কোনো চুক্তি করা যায়– তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয় ২০১৪ সাল থেকে। ইতোমধ্যে বেশ কিছু দেশের সঙ্গে এফটিএ করার লাভক্ষতি খতিয়ে দেখতে যৌথভাবে সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছে। কিন্তু এর চেয়ে বেশি অগ্রগতি হয়নি।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, এসব সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে দেখা গেছে, বাংলাদেশের গড় ট্যারিফ প্রায় ১৫ শতাংশ। আমদানি শুল্কের মাধ্যমেই জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মোট রাজস্বের প্রায় ২৭ শতাংশ আসে। অপরদিকে যেসব দেশের সঙ্গে এফটিএ প্রয়োজন, সেসব দেশে ট্যারিফ ২ থেকে ৩ শতাংশ। অর্থাৎ এসব দেশ সহজেই ট্যারিফে ছাড় দিতে পারলেও এ ধাক্কায় রাজস্ব অনেক কমে যাওয়ার শঙ্কায় বাংলাদেশের পক্ষে একই হারে ছাড় দেওয়া সম্ভব হয়নি। তাছাড়া বাংলাদেশের রপ্তানির বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নকেন্দ্রিক। এসব দেশকে প্রস্তাব দেওয়া হলেও তারা বাংলাদেশে শ্রম, কার্বন নিঃসরণসহ অন্যান্য কমপ্লায়েন্স ইস্যুতে দুর্বলতা উল্লেখ করে প্রস্তাবে রাজি হয়নি।
মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির অগ্রগতি
বাংলাদেশ জাপানের সঙ্গে এফটিএর আদলেই অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি (ইপিএ) করার জন্য সম্ভাব্যতা যাচাই সম্পন্ন করেছে। আগামীকাল বুধবার বাংলাদেশ ও জাপান যৌথভাবে এর ফল প্রকাশ করবে। এরপর আরও কিছু আনুষ্ঠানিকতা সেরে চুক্তি হতে পারে। এ ছাড়া বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে প্রস্তাবিত কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ অ্যাগ্রিমেন্ট (সেপা) বা সর্বাত্মক অর্থনৈতিক অংশীদারি চুক্তিও দ্রুত শেষ করতে চায় সরকার। একই সঙ্গে চীন ও সিঙ্গাপুরসহ অন্তত ১০টি দেশের যত দ্রুত সম্ভব দ্বিপক্ষীয় এ চুক্তির কথা ভাবা হচ্ছে। এ তালিকায় আরও রয়েছে– ইন্দোনেশিয়া, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, চীন, মালয়েশিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ব্রাজিল, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, আর্জেন্টিনা, সংযুক্ত আরব আমিরাত, অস্ট্রেলিয়া ও সৌদি আরব।
এদিকে গতকাল ভারতের কয়েকটি গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, চীন নেতৃত্বে জোট আরসিইপিতে যুক্ত হলে বাংলাদেশের সঙ্গে সেপা চুক্তি করা হবে কিনা তা পুনর্বিবেচনা করবে ভারত। তাই বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সেপা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে।
এ বিষয়ে বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, এফটিএ করাটা বেশ দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। সরকার ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি দেশের সঙ্গে এফটিএ করার বিষয়ে উদ্যোগ নিয়েছে। ২০২৬ সালের আগেই কয়েকটি দেশের সঙ্গে এফটিএ বা পিটিএ করা হবে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এলডিসি থেকে বের হওয়ার পর ২০২৬ সালের পর রপ্তানিতে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি হবে। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার প্রস্তুতি হিসেবে আরও আগে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে এফটিএসহ অন্যান্য দ্বিপক্ষীয় চুক্তি করার উদ্যোগ নেওয়া উচিত ছিল। তবে জাপানের সঙ্গে ইপিএ করার বিষয়ে অগ্রগতি ভালো খবর। অন্যান্য দেশের সঙ্গে যত দ্রুত সম্ভব বাণিজ্যের পাশাপাশি বিনিয়োগকে অন্তর্ভুক্ত করে এফটিএর উদ্যোগ নিতে হবে।