ভোক্তার স্বার্থ রক্ষায় আইন আছে, বাস্তবায়ন নেই

ভোক্তার স্বার্থ রক্ষায় আইন আছে, কিন্তু বাস্তবায়ন নেই। প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার কারণে ঝিমিয়ে পড়ছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর কার্যক্রম। এতে নিত্যপণ্য ও সেবায় বাড়ছে প্রতারণা, চলছে কারচুপি শুভঙ্করের ফাঁকি। শক্তিশালী হয়ে উঠছে কারসাজিকারী ও অসাধু চক্র। উপেক্ষিত ও ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে ভোক্তা স্বার্থ— বলছেন এ খাতসংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা।

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত ও ভোক্তার স্বার্থ রক্ষায় বেশকিছু আইন করেছে সরকার। এর মধ্যে রয়েছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯, প্রতিযোগিতা আইন ২০১২, নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩, ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৫, বিএসটিআই আইন ২০১৮। আইনগুলোতে জেল-জরিমানা, ব্যবসার লাইসেন্স বাতিল বা ব্যবসায়িক কার্যক্রম সাময়িক বা স্থায়ীভাবে বন্ধ করার ক্ষমতা রয়েছে। এসব আইন বাস্তবায়নে রয়েছে বিভিন্ন সংস্থা-অধিদফতর। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার কারণে আইন থাকলেও তা যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে না।

জানা গেছে, জাতীয় সংসদ ২০১৩ সালের ১০ অক্টোবর নাগরিকের জীবন ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করতে ‘নিরাপদ খাদ্য আইন’ অনুমোদন হয়। বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতির যথাযথ অনুশীলনের মাধ্যমে নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করতে খাদ্য উৎপাদন, আমদানি, প্রক্রিয়াকরণ, মজুত, সরবরাহ, বিপণন, বিক্রয় সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমের সমন্বয়ের মাধ্যমে সহযোগিতা প্রদান ও নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যে গঠিত হয় বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ (বিএফএসএ)। প্রতিষ্ঠানটির অন্যতম দায়িত্ব হচ্ছে, আইনের আলোকে উৎকৃষ্ট পন্থায় গৃহীত খাবার সব সময় সবার জন্য সুরক্ষা ও স্বাস্থ্যসম্মতভাবে পৌঁছানো। কিন্তু প্রতিষ্ঠার পাঁচ বছর পার হলেও জনবল ও সরঞ্জাম সংকটে কার্যকর হতে পারছে না বিএফএসএ।

এদিকে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯ বাস্তবায়নে করা হয়েছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। প্রয়োজনীয় লোকবল ও কাঠামোগত সহযোগিতার অভাবে ভোক্তার চাহিদা অনুযায়ী কাজ করতে পারছে না সংস্থাটি।

এ বিষয়ে ভোক্তা অধিদফতরের ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, ঢাকা শহরে প্রায় দুই কোটি মানুষের বাস। বিশাল এ জনগোষ্ঠীর অধিকার নিশ্চিতে কাজ করছে অধিদফতরের মাত্র ছয়জন কর্মকর্তা। অর্থাৎ জনগণের প্রত্যাশা থাকা সত্ত্বেও লোকবল সংকটের কারণে যথাযথ অধিকার পূরণ করতে পারছি না।

তিনি বলেন, জেলা পর্যায়ে কাজ করা হচ্ছে। কিন্ত বেশিরভাগ ক্ষেত্রে লজিস্টিক সাপোর্টের কারণে তা বাধাগ্রস্ত হয়। এছাড়া এখন ভেজাল পণ্য উপজেলা পর্যায়ে বিস্তার ঘটেছে। কিন্তু লোকবলের অভাবে সেখানে কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না।

মানুষ সচেতন হওয়ার ফলে অভিযোগের সংখ্যা বাড়ছে উল্লেখ করে অধিদফতরের এ কর্মকর্তা জানান, দিন যাচ্ছে এখন অভিযোগের পরিমাণ বাড়ছে। এসব অভিযোগ নিষ্পত্তিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। হটলাইন চালু হচ্ছে। এখন অভিযোগ আরও বাড়বে। ভোক্তাদের সন্তুষ্টি অর্জন ও অধিদফতর সচল রাখতে প্রয়োজনীয় লোকবলের পাশাপাশি লজিস্টিক সাপোর্ট দরকার বলে তিনি জানান।

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণবিষয়ক সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান  বলেন, ভোক্তার অধিকার বিষয়ে সাধারণ মানুষ তেমন সচেতন নয়। গত ১০-১৫ বছরে দেশে ভোক্তা স্বার্থ সংরক্ষণে বেশকিছু আইন করেছে সরকার। এর মধ্যে ভোক্তা সংরক্ষণ আইন, নিরাপদ খাদ্য আইন, প্রতিযোগিতা কমিশন আইন, বিএসটিআই আইন অন্যতম। ভোক্তাদের স্বার্থে এসব আইন হলেও বাস্তবায়নে যেসব প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর অভাব রয়েছে। অর্থাৎ আইন আছে, কিন্তু তার প্রয়োগ নেই।

তিনি বলেন, নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত ও ভোক্তার স্বার্থ রক্ষায় নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ এবং ভোক্তা অধিদফতর কাজ করছে। তারা কিছু অভিযান করছে, কিন্তু এদের প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম বেশি শক্তিশালী নয়। অনেক ক্ষেত্রে তাদের সক্ষমতার অভাব রয়েছে। ভোক্তা স্বার্থ নিশ্চিত করতে হলে এসব প্রতিষ্ঠানকে কাঠামোগত শক্তিশালী করার পরামর্শ দেন তিনি।

অধিকার আদায়ে ভোক্তাদের সচেতন হতে হবে জানিয়ে ক্যাব নেতা গোলাম রহমান বলেন, ভোক্তাদের শিক্ষিত হতে হবে, অধিকার সম্পর্কে জানতে হবে। কারণ ভোক্তারা যত সচেতন হবে আইনের প্রয়োগ তত বাড়বে। একই সঙ্গে সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীদের মূল্যবোধ সৃষ্টিতে কাজ করতে হবে। কারণ, নিজেরা যদি সচেতন না হয় তাহলে আইন করে সচেতন করা সম্ভব নয়।

১৫ মার্চ বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস। কনজ্যুমারস ইন্টারন্যাশনালের (সিআই) উদ্যোগে বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১২০টি দেশে ২৪০টিরও বেশি সংস্থা বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে ভোক্তা অধিকার দিবস পালন করে।

বাংলাদেশ ২০২০ সালে দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘মুজিববর্ষের অঙ্গীকার সুরক্ষিত ভোক্তা অধিকার’। দিবসটি একযোগে কেন্দ্রীয়, বিভাগ, জেলা এবং উপজেলা পর্যায়ে বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে উদযাপন করা হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *