ব্রিকস সম্মেলনে যোগ দিতে কাল জোহানেসবার্গ যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী

স্টাফ রিপোর্টার

আঞ্চলিক অর্থনৈতিক জোট ব্রিকসের শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে আগামীকাল দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গের উদ্দেশে রওনা করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার সফরসঙ্গী হিসেবে থাকবেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানসহ সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ তথ‌্য জানিয়েছেন।

মন্ত্রী বলেন, ‘২৪ আগস্ট জোহানেসবার্গে ১৫তম ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনের “‍‌ব্রিকস-আফ্রিকা আউটরিচ অ্যান্ড দ্য ব্রিকস প্লাস ডায়ালগস” অনুষ্ঠিত হবে। এতে যোগদানের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দল এতে অংশ নিচ্ছে। ব্রিকসের সদস্যদেশগুলো ছাড়াও বিভিন্ন দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রধানরা এ সভায় অংশগ্রহণ করবেন বলে আশা করা যাচ্ছে।’

ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, ‘গত ২ জুন দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনে অনুষ্ঠিত ফ্রেন্ডস অব ব্রিকস পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে আমি ভার্চুয়ালি যোগদান করে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরেছিলাম। সেখানে আমি ব্রিকস সদস্যদেশগুলোকে তাদের ব্যয়সাশ্রয়ী প্রযুক্তি উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাছে হস্তান্তর এবং উদ্বৃত্ত অর্থ উন্নয়নশীল দেশগুলোয় বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়েছিলাম। এ বছর আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিকসে যোগদানের বিষয়ে আমাদের ইচ্ছা ব্যক্ত করেছি।’

তিনি বলেন, ‘বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলা এবং উন্নয়নমূলক সহযোগিতার লক্ষ্যে বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, ইরান, সৌদি আরব, সিরিয়াসহ ২০টিরও বেশি দেশ এ জোটে যোগদানের আগ্রহ ব্যক্ত করেছে।’

২০২১ সালে বাংলাদেশ এ জোটের অর্থনৈতিক বাতায়ন নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সদস্যপদ লাভ করে। জোটের সম্মেলনে অংশগ্রহণের জন্য দক্ষিণ আফ্রিকায় অবস্থানকালে প্রধানমন্ত্রী ব্যস্ত সময় কাটাবেন। ২৩ আগস্ট তিনি প্রধান অতিথি হিসেবে ‘বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড বিজনেস সামিটে’ যোগ দেবেন বলে আশা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এবং বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) যৌথভাবে এর আয়োজন করবে। এছাড়া আফ্রিকার দেশগুলোয় নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতদের অংশগ্রহণে আঞ্চলিক দূত সম্মেলনেও অংশ নেয়ার কথা রয়েছে তার। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্টসহ ব্রিকসভুক্ত দেশগুলোর সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গেও তার সৌজন্য সাক্ষাতের কথা রয়েছে।

২৩ আগস্ট সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী ব্রিকসের বর্তমান চেয়ার, দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট কর্তৃক আয়োজিত রাষ্ট্রীয় ভোজসভায় যোগ দেবেন। ২৪ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী ‘‌ব্রিকস-আফ্রিকা আউটরিচ অ্যান্ড দ্য ব্রিকস প্লাস ডায়ালগস’-এ অংশ নেবেন। এতে নিউ ডেভেলপ ব্যাংকের সদস্য হিসেবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বক্তব্য দেবেন প্রধানমন্ত্রী। বিশ্বের প্রায় ৭০টি দেশের প্রতিনিধিরা এখানে উপস্থিত থাকবেন বলে আশা করা হচ্ছে। সন্ধ্যায় দক্ষিণ আফ্রিকায় বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন শেখ হাসিনা।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘সফরে নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন বলে আশা করা যাচ্ছে। এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের জন্য আফ্রিকার অনেক দেশ অনুরোধ জানিয়েছে। আমরা সেগুলো বিবেচনা করছি। এগুলোর সময় এখনো নির্ধারিত হয়নি। ২৬ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী ঢাকার উদ্দেশে জোহানেসবার্গ ত্যাগ করবেন।’

এর আগে গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে আগারগাঁওয়ে নবনির্মিত ১৫ তলার ‘‌বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) ভবন’ এবং ১৩ তলাবিশিষ্ট ‘‌তথ্য কমিশন ভবন’ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। এদিন ভার্চুয়ালি বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফডিসি) কমপ্লেক্সেরও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তিনি।

ভবন উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দেশে স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের অবারিত সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ১৯৯৬-০১ মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকার বেসরকারি খাতকে উন্মুক্ত করে দেয়ায় এ সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘কোনো রাখঢাক নয়, জনগণের জন্য কাজ করে আওয়ামী লীগ। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য নিয়ে সার্বিক উন্নয়নে কাজ করছে সরকার।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কেউ রাষ্ট্রক্ষমতায় এসে জনগণের কথা ভাবেনি। জাতির পিতাকে হত্যা করে সংবিধান লঙ্ঘন করে অবৈধভাবে সামরিক শাসন জারি করে যারা সরকারে এসেছিল, তারা কখনো গণমানুষের কথা ভাবেনি। সেটা জিয়া, এরশাদ, খালেদা জিয়া যেই হোক। ক্ষমতা ভোগ করা, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের অত্যাচার করা—এটাই তারা জানত। বর্তমানে দুর্যোগ ও অগ্নিসন্ত্রাস মোকাবেলা করেই এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।’

তিনি বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশ টেলিভিশন, বিটিভি ওয়ার্ল্ড এবং সংসদ টেলিভিশনের পাশাপাশি ৪৪টি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল, ২২টি এফএম রেডিও, ৩২টি কমিউনিটি রেডিও, ১৪টি আইপি টিভিসহ অসংখ্য সংবাদপত্র, অনলাইন পোর্টালের অনুমোদন দিয়েছি। আমরা সাংবাদিকদের কল্যাণে বাংলাদেশ সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠা করেছি। জাতীয় অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা ২০১৭, জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা ২০১৪সহ বিভিন্ন আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন করেছি।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘দেশে এখন টেলিডেনসিটি ১০৪ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। মোবাইল ফোনের গ্রাহক এখন ১৮ কোটির ওপরে। ১৭ কোটি মানুষ। কিন্তু সিম ব্যবহার হচ্ছে ১৮ কোটির ওপর। মোবাইল ইন্টারনেট সংযোগ রয়েছে এমন গ্রাহকের সংখ্যা ১২ কোটি ৭০ লাখ।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তথ্য চাওয়া এবং তথ্য পাওয়া মানুষের অধিকার। সেই অধিকার আমরা নিশ্চিত করতে পেরেছি। এখন মানুষ কোনো তথ্য চাইলে তা পেতে পারে। আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর নবম জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে তথ্য অধিকার আইন পাস এবং এর আওতায় তথ্য কমিশন গঠন করে। পাশাপাশি প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ দেয় এবং কমিশনের নিজস্ব ভবন নির্মাণের পদক্ষেপ গ্রহণ করে।’

মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের কথাও উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘দেশের সব টিভি চ্যানেল বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ব্যবহার করছে। সাবমেরিন কেবল কক্সবাজারে ও কুয়াকাটায় সংযুক্ত করা হয়েছে। আরো একটি সংযোগের জন্য প্রক্রিয়াধীন। বর্তমানে বিটিআরসির ব্যান্ডউইডথ চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবল কোম্পানি লিমিটেডের (বিএসসিসিএল) পাশাপাশি আরো তিনটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে সাবমেরিন কেবলে সংযুক্তির লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। সারা দেশে অপটিক্যাল ফাইবার বিস্তৃত হয়েছে ১ লাখ ৬০ হাজার ৩৪৮ কিলোমিটার।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘২০১১-২৩ পর্যন্ত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভের পাশাপাশি ১২ বছরে বিটিআরসি শুধু তরঙ্গ বরাদ্দ দিয়ে রাজস্ব আয় করেছে ৪ দশমিক ৮ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি। সরকার ৮ হাজার ৮৪৩টি ডিজিটাল সেন্টার এবং ৮ হাজার ৫০০টি পোস্ট ই-সেন্টার স্থাপন করেছে। ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত অপটিক্যাল ফাইবার সম্প্রসারণ করা হয়েছে।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘কলকাতা থেকে এ উপমহাদেশে সিনেমার যাত্রা শুরু। আমাদের সিনেমা শিল্পের যাত্রা জাতির পিতার হাত ধরে। ১৯৫৬ সালে মন্ত্রী থাকাকালে তার হাতেই এ দেশে চলচ্চিত্র শিল্পের গোড়াপত্তন হয়েছে। তিনি শিল্পমন্ত্রী থাকা অবস্থায় এফডিসি নির্মাণ করেন।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সিনেমায় জনসাধারণের জন্য বার্তা থাকতে হবে। মাঝে পরিবার নিয়ে সিনেমা দেখা যেত না। এখন তার পরিবর্তন হয়েছে। এখন আধুনিক প্রযুক্তিতে সিনেমা দেখানো হয়। হল মালিকদের সিনেপ্লেক্স তৈরির সুযোগ করে দিয়েছি আমরা। এখন ভালো সিনেমা নির্মাণ হচ্ছে। বিদেশে আমাদের সিনেমা প্রশংসা পাচ্ছে। চলচ্চিত্রকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা দিয়ে সুবিধার ব্যবস্থা আমরাই করেছি।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘শিল্পী কল্যাণ ট্রাস্ট আমরা গঠন করেছি। যন্ত্রশিল্পী থেকে শুরু করে সব শিল্পীকে সহায়তা করেছি। মানসম্মত সিনেমা নির্মাণের সব ব্যবস্থা করেছি। এফডিসি কমপ্লেক্স করছি।’

বিগত বছরগুলোয় সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘‌২০০৯-২৩ সাল পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতির সরকার চলছে। দেশে একটা স্থিতিশীলতা চলছে। যদিও এর মাঝে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগ, অগ্নিসন্ত্রাস অনেক কিছুই মোকাবেলা করতে হয়েছে। তার পরও কিন্তু বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এ অগ্রযাত্রা যেন অব্যাহত থাকে, সেটাই আমরা চাই।’

অনুষ্ঠানে বিটিআরসি ভবন, তথ্য কমিশন ভবন এবং বিএফডিসি কমপ্লেক্স (তেজগাঁও) প্রাঙ্গণ থেকে সংশ্লিষ্টরা সংযুক্ত ছিলেন। তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের (পিএমও) সচিব মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিন অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন। অনুষ্ঠানে নবনির্মিত বিটিআরসি ও তথ্য কমিশন ভবন এবং বিএফডিসি কমপ্লেক্সের ওপর অডিও-ভিডিও তথ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *