ব্যাংক খাতে সুদ বৃদ্ধির প্রতিযোগিতা

জীবন ইসলাম

বাজারভিত্তিক সুদ আরোপের সুযোগ দেওয়ায় ব্যাংকগুলো সুদ বাড়ানোর  প্রতিযোগিতায় নেমেছে। মাত্র এক মাসের ব্যবধানে ঋণের সুদহার ৩ শতাংশ বাড়িয়েছে।আবার একটি ব্যাংক সুদহার  ৪ শতাংশ বাড়িয়েছে বা ১৭ শতাংশ আরোপ করেছে। তবে বেশিরভাগ ব্যাংকে  ১৪ থেকে ১৬ শতাংশের মধ্যে সুদ নির্ধারণ করেছে। ব্যাংকগুলোর ঘোষিত সুদহার নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মে মাসের প্রতিবেদনে এসব চিত্র উঠে এসেছে।

সুদহারের বৃদ্ধি ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ীসহ খাত সংশ্লিষ্টরা। এর ফলে ব্যবসায়ীদের উৎপাদন খরচ বাড়বে; এবং পণ্যমূল্যও বাড়বে। ফলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসার পরিবর্তে আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যদিও দীর্ঘদিন  উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে রয়েছে দেশবাসী।

জানা যায়, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে চলতি মুদ্রানীতি সংকোচনমুখী করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর আওতায় ঋণের সুদহার বাড়ানোর পথে হাঁটছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আইএমএফের পরামর্শে গত মে মাসের শুরুতে সব ধরনের সুদহার বাজারের ওপর ছেড়ে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ বিষয়ে গত ৮ মে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সার্কুলারে বলা হয়, বাজারে ঋণের চাহিদা ও ঋণযোগ্য তহবিলের জোগান সাপেক্ষে ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে ঋণের সুদহার নির্ধারিত হবে। এদিকে প্রস্তাবিত বাজেটেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সংকোচনমূলক নীতি গ্রহণ করা হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই ঘোষণার পরই সুদহার বাড়ানোর অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে অনেক ব্যাংক। বিশেষ করে যেসব ব্যাংকের তহবিল সংগ্রহের খরচ বেশি, সেসব ব্যাংক ঋণ বিতরণে বেশি সুদারোপ করছে। এতে সার্বিক ব্যাংক খাতে ঋণের গড় সুদহার বেড়ে যাচ্ছে।

এ বিষয়ে এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন বলেন, স্মার্ট পদ্ধতি চালু করার পর থেকেই ধারাবাহিক সুদের হার বেড়েছে। আর এখন স্মার্ট পদ্ধতি তুলে দেওয়ার কারণে সুদের হার বেশি হারে বাড়ছে। এত সুদে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করে ঋণের টাকা ফেরত দেওয়াও কঠিন। ঋণ যথাসময়ে ফেরত দিতে না পারলে খেলাপি বাড়বে। অন্যদিকে ডলারের রেট বাড়ানোর প্রভাবও ব্যবসা-বাণিজ্যে পড়বে।

বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানোর স্বার্থে বেশ কয়েক বছর ধরেই ব্যাংক ঋণের সুদহার ৯ শতাংশের মধ্যে আটকে রাখা হয়েছিল। তবে গত বছরের জুলাই থেকে সেই সীমা তুলে দিয়ে সুদহার নির্ধারণের স্মার্ট পদ্ধতি (ট্রেজারি বিলের ছয় মাসের চলমান গড় হার) চালু করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর থেকে প্রতি মাসেই ব্যাংক ঋণের সুদহার বাড়তে থাকে। সর্বশেষ এপ্রিল মাসে সেটি বেড়ে সাড়ে ১৩ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। তবে আইএমএফের পরামর্শে  মে মাসে সুদহার পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপর থেকে সুদের হার আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা

বর্তমান তহবিল খরচ বিবেচনায় সুদের হার ১৪ শতাংশের নিচে থাকার কথা থাকলেও তথ্য বলছে,  মে মাসেই বেশিরভাগ ব্যাংকের সুদের হার ১৪ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। এর মধ্যে একটির সুদের হার ১৭ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছে।

 

 

 

 

এ বিষয়েেএকটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বলেন, এভাবে ঋণের সুদহার বৃদ্ধি করলে ব্যবসার ক্ষতি হবে। নতুন করে কেউ ব্যবসায় আসবে না। ব্যবসা করে যে রিটার্ন আসবে, তা দিয়ে ঋণ পরিশোধ করতে পারবে না। সবাইকে বাস্তববাদী হতে হবে। এখন ঋণের সুদহার ১৪ শতাংশের ওপরে যাওয়া উচিত নয়। কারণ এখনো এমন কিছু হয়নি যে ১৭ শতাংশ সুদ  নিতে হবে।

মে মাসজুড়ে বিভিন্ন খাতে অর্থায়নে সর্বোচ্চ ১৭ শতাংশ পর্যন্ত সুদারোপ করেছে বেসরকারি খাতের মেঘনা ব্যাংক। ব্যাংকটি খাত বিবেচনায় নিয়ে ১৫ থেকে ১৭ শতাংশ পর্যন্ত সুদারোপ করেছে। কিন্তু এপ্রিল মাসে ব্যাংকটি গড় সুদ ১১ দশমিক ৩২ শতাংশ ছিল।

স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক মে মাসে সুদারোপ করেছে ১৪ থেকে ১৬ শতাংশ। আগের মাসে ব্যাংকটির গড় সুদের হার ছিল ১০ দশমিক ৪৫ শতাংশ। সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক সুদারোপ করেছে সাড়ে ১৩ থেকে সাড়ে ১৫ শতাংশ। আগের মাসে ব্যাংকটির গড় সুদের হার ছিল ১০ দশমিক ০৯ শতাংশ।  মে মাসে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক সুদারোপ করেছে ১৩ থেকে ১৫ শতাংশ। আগের মাসে গড় সুদারোপ ছিল ১১ দশমিক ২৭ শতাংশ।

যমুনা ব্যাংক মে মাসে সাড়ে ১৩ থেকে সাড়ে ১৫ শতাংশ সুদারোপ করে। আগের মাসে  গড় সুদের হার ছিল ১১ দশমিক ৩০ শতাংশ।  সিটিজেনস ব্যাংক মে মাসে ১৪ থেকে সাড়ে ১৫ শতাংশ সুদারোপ করেছে। আগের মাসে গড় সুদহার ছিল ১১ দশমিক ৯২ শতাংশ। ওয়ান ব্যাংক মে মাসে সুদারোপ করেছে ১৪ থেকে ১৬ শতাংশ। এর বইরে অন্য ব্যাংকগুলোও ১৩ থেকে ১৫ শতাংশের মধ্যে সুদারোপ করেছে।

আগে ব্যাংকগুলো আমানত ও ঋণের সুদ হারে স্প্রেড ৫ শতাংশ ব্যবধান নির্ধারণ করে দিত কেন্দ্রীয় ব্যাংক। দীর্ঘ সময় এটি চালু  থাকলেও ২০১৮ সাল থেকে স্প্রেড ৪ শতাংশের মধ্যে রাখার নির্দেশনা দেয় কেন্দ্রীয় ব্যংক। তবে স্মার্ট পদ্ধতি চালুর পর গত নভেম্বরে স্প্রেড ৪ শতাংশে রাখার সীমাবদ্ধতা তুলে দেওয়া হয়। স্প্রেড সীমা তুলে দেওয়ার কারণেই ব্যাংকগুলোর মধ্যে বেশি মুনাফা করার প্রবণতা কাজ করছে বলে  সংশ্লিষ্টরা জানান।

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *