ব্যাংকের পরিচালন মুনাফায় চমক নানা সংকটেও

স্টাফ রিপোর্টার জীবন ইসলাম

বৈদেশিক মুদ্রার তীব্র সংকট, ঋণ আদায় কম, তারল্য সংকট, ঊর্ধ্বমুখী খেলাপি ঋণ, মূলধন ঘাটতি, সঞ্চিতি (প্রভিশন) ঘাটতিসহ নানা সমস্যার কারণে ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থা নাজুক। এমন পরিস্থিতির মধ্যেও চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে বেশিরভাগ ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে বেড়েছে।

ব্যাংকের ঋণের সুদহার বৃদ্ধির পাশাপাশি বিভিন্ন চার্জ কমিশন ও ট্রেজারি বিল-বন্ডের আয়ের ওপর ভর করে ব্যাংকগুলোর পরিচালন মুনাফা বেড়েছে বলে জানিয়েছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। তবে পরিচালন মুনাফা ব্যাংকের চূড়ান্ত মুনাফা নয়। পরিচালন মুনাফা থেকে ঋণের মান অনুযায়ী নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) রাখতে হয়। আবার পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হলে সাড়ে ৩৭ শতাংশ করপোরেট কর দিতে হয়। এর পরই চূড়ান্ত হয় নিট বা প্রকৃত মুনাফা।

দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত। প্রান্তিক (তিন মাস) ভিত্তিতে ব্যাংকগুলো তাদের অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন কেন্দ্রীয় ব্যাংক, পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এবং সংশ্লিষ্ট স্টক এক্সচেঞ্জের কাছে জমা দিতে হয়। এর আগে কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ তাদের বার্ষিক সভায় আর্থিক প্রতিবেদন অনুমোদন করতে হয়। তারপর পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের জন্য সেই প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট স্টক এক্সচেঞ্জ তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে।

সোমবার ছিল ব্যাংক হলিডে। এদিন ব্যাংকগুলো তাদের বিভিন্ন শাখা থেকে পাঠানো হিসাব একত্র করে অর্ধবার্ষিকী আর্থিক প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছে। নিয়মানুযায়ী, তালিকাখভুক্ত প্রতিষ্ঠান স্টক এক্সচেঞ্জে জমা দেওয়ার আগে আনুষ্ঠানিকভাবে পরিচালন মুনাফার তথ্য জানাতে পারবে না। তবে খোঁজ নিয়ে বিভিন্ন সূত্রে বেশ কিছু ব্যাংকের পরিচালন মুনাফার তথ্য পাওয়া গেছে। সেখানে বেশিরভাগ ব্যাংকেরই পরিচালন মুনাফা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় বেড়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী জানান, এ বছর পরিচালন মুনাফা অনেক বেড়েছে। এর প্রধান কারণ সুদহার বেড়েছে। অনেক ঋণে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। ট্রেজারি বন্ড থেকেও আয় ভালো হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন চার্জ, কমিশন থেকেও মুনাফা বেড়েছে। সব মিলিয়ে চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে পরিচালন মুনাফা বেড়েছে।

যেসব ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা বেড়েছে তার মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক। ২০২৪ সালে (জানুয়ারি-জুন) ব্যাংকটি পরিচালন মুনাফা করেছে ২২৬০ কোটি টাকা। ২০২৩ সালের প্রথম ছয় মাসে ব্যাংকটির মুনাফা ছিল ১,৬৮০ কোটি টাকা। রূপালী ব্যাংক মুনাফা করেছে ৪৫০ কোটি টাকা; আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৩২০ কোটি টাকা। রূপালী ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, সুদ ও ট্রেজারি থেকে আয় এবং খেলাপি ও অবলোপিত ঋণের আদায় বাড়ায় ব্যাংকটি অর্ধবার্ষিকীতে এ মুনাফা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।

বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে বছরের প্রথম ছয় মাসে সাউথইস্ট ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা হয়েছে ৫৭৯ কোটি। গত বছরের একই সময়ে ৪০৭ কোটি টাকা মুনাফা করেছিল ব্যাংকটি। আলোচিত সময়ে ব্যাংকটির পরিচালন মুনাফা বেড়েছে ১৭২ কোটি টাকা। সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসি (এসআইবিএল) পরিচালন মুনাফা করেছে ২১১ কোটি টাকা। আগের বছর করেছিল ২০০ কোটি টাকা।

চতুর্থ প্রজন্মের মধুমতি ব্যাংক ২০২৪ সালে প্রথম ছয় মাসে পরিচালন মুনাফা করেছে ১৮০ কোটি টাকা; আগের বছরের একই সময় মুনাফা করেছিল ৮১ কোটি টাকা। ইউনিয়ন ব্যাংকের মুনাফা ২৫০ কোটি টাকা। আগের বছরে ছিল ২১০ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৪ সালের মার্চ শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৬, ৪০, ৮৫৫ কোটি টাকায়। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে ১,৮২,২৯৫ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ১১ দশমিক ১১ শতাংশ। হিসাব অনুযায়ী, এক বছরে দেশে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৫০ হাজার ৬৭৫ কোটি টাকা, এর মধ্যে তিন মাসেই বেড়েছে ৩৬ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা।

এদিকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শুরুতে ব্যাংকঋণের সুদহার নির্ধারণে সিক্স মান্থস মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল বা ‘স্মার্ট’ পদ্ধতি চালু করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু অর্থবছর শেষ হওয়ার আগেই ব্যর্থ হয়ে স্মার্ট সুদহার পদ্ধতি বাতিল করা হয়। চলতি বছরের ৮ মে ঋণের সুদহার পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে।

নিয়ন্ত্রক সংস্থা থেকে বলা হয়, ব্যাংকগুলো চাহিদা ও জোগানের ভিত্তিতে ঋণের সুদহার নির্ধারণ করতে পারবে। এ ক্ষেত্রে ব্যাংক গ্রাহক সম্পর্কও বিবেচনায় নিতে পারবে। সুদহার শতভাগ বাজারভিত্তিক করতে ‘স্মার্ট’নীতি প্রত্যাহার করা হলো। এর পর থেকে বাড়তে থাকে ঋণের সুদহার। এতে ব্যাংকঋণের সুদহার ১৬ থেকে ১৮ শতাংশে উঠে গেছে।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *