বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ধীর হওয়ার শঙ্কা
মহামারীর বিপর্যয় কাটিয়ে পুনরুদ্ধার হচ্ছে বিশ্ব অর্থনীতি। লোকসান কাটিয়ে ব্যবসা দাঁড় করাতে লাগামহীন ঋণ নিয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলো। জীবনযাত্রার ব্যয় মোকাবেলায় ধার-দেনা বাড়াতে হয়েছে পরিবারগুলোকেও। এ অবস্থায় ব্যক্তি খাতের ঋণের পরিমাণ রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে। এ পরিস্থিতি অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারকে ধীর করতে পারে বলে সতর্ক করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। বিশেষ করে অত্যন্ত ঋণে থাকা নিম্ন আয়ের পরিবার ও সংস্থা রয়েছে, এমন দেশগুলোর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি থমকে যেতে পারে।
ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে আইএমএফ জানিয়েছে, ব্যক্তিগত ঋণের মাত্রার সাম্প্রতিক বৃদ্ধি আগামী তিন বছরে গড়ে উন্নত অর্থনীতির মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) দশমিক ৯ শতাংশ এবং উদীয়মান অর্থনীতির ১ দশমিক ৩ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। ফলে বিশ্ব অর্থনীতির পুনরুদ্ধার ধীর হবে।
ওয়াশিংটনভিত্তিক ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে পরিবার ও সংস্থাগুলোর ঋণের বোঝা অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের গতিতে ঝুঁকি তৈরি করেছে। আবার এ ঝুঁকিও দেশ ও পরিবার অনুযায়ী সমান নয়। এ অবস্থায় ঝুঁকি কমানোর উপায়ও তুলে ধরেছে আইএমএফ। সংস্থাটির মতে, নিম্নআয়ের পরিবার ও দুর্বল প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যালান্স শিটগুলো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ ও রিয়েল-টাইমে নিরীক্ষণ করার মতো পদক্ষেপগুলো হঠাৎ বিপর্যয় প্রতিরোধ করতে পারে।
কভিডজনিত বিধ্বস্ত অবস্থা কাটিয়ে উঠতে বিশ্বব্যাপী সরকারগুলো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও পরিবারগুলোকে বিপুল পরিমাণ প্রণোদনা সরবরাহ করেছে। ক্রেডিট গ্যারান্টি, রেয়াতি ঋণ ও ঋণের সুদ পরিশোধে সময় বাড়ানোর মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় তারল্য প্রবাহে সহায়তা করা হয়েছে। এ নীতিগুলো ব্যালান্স শিট শক্তিশালী করতে সহায়তা করছে। ফলে ২০০৮ সালের বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের পর ব্যক্তি খাতের ঋণ ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে তুলেছে।
২০২০ সালে বিশ্বজুড়ে ব্যক্তি খাতের ঋণ বৈশ্বিক জিডিপির ১৩ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এ হার বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের সময় দেখা বৃদ্ধি এবং সরকারি ঋণের তুলনায় দ্রুত। আইএমএফ জানিয়েছে, নীতি ও অর্থনীতির ওপর নির্ভর করে পরিবার এবং প্রতিষ্ঠানের ঋণের পরিমাণ অসম ছিল। মহামারীর ঘরবন্দি সময়ে মানুষদের উচ্চ পরিচিত পরিষেবা যেমন বিনোদন খাতের ব্যয় সংকুচিত হয়েছে। তবে এ সময়ে কম্পিউটার, সফটওয়্যার ও অন্যান্য পণ্যের উৎপাদন ও রফতানি প্রসারিত হয়েছে। কারণ মহামারীতে গ্রাহকরা যন্ত্রপাতির জন্য বেশি ব্যয় করেছেন।
একদিকে মহামারীর এ দুই বছরে পর্যটন পরিষেবা, রেস্তোরাঁ, আতিথেয়তা ও বিনোদনের মতো খাতগুলো অনিশ্চিত রয়ে গেছে। অন্যদিকে নির্মাণ ও লজিস্টিকস খাতে শ্রমঘাটতি এবং দ্রুত মজুরি বৃদ্ধি স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। এর মধ্যে ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসন চলমান সরবরাহ ব্যবস্থার জটিলতা আরো বাড়িয়ে তুলেছে। ফলে মৌলিক পণ্যের ঘাটতি ও ব্যয় বেড়েছে।
আইএমএফ বলেছে, জ্বালানি ও খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় নিম্নআয়ের পরিবারগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। বিশেষ করে উদীয়মান ও উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে এ প্রভাব ভয়ংকর হতে পারে। চলমান ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা দীর্ঘয়িত হলে কাঁচামালের উচ্চ দামের কারণে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোও লোকসানের মুখে পড়বে। সাধারণত স্বল্পআয়ের পরিবার ও উচ্চ ঋণগ্রস্ত বা অলাভজনক সংস্থাগুলোর পর্বতসম ঋণের বোঝা মোকাবেলা করার সক্ষমতা কম থাকে। এ পরিস্থিতি ভবিষ্যতে ভোক্তা ব্যয় ও বিনিয়োগ ব্যাপকভাবে কমিয়ে দিতে পারে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার ভোক্তাদের পারিবারিক ঋণের অনুপাত সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। যদিও ডাটা না পাওয়ায় অনেক দেশ এ পরিসংখ্যানের বাইরে রয়েছে। উন্নত অর্থনীতির মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও যুক্তরাজ্যের নিম্নআয়ের পরিবারগুলোর ঋণ ফ্রান্স ও ইতালির তুলনায় তুলনামূলক বেশি বেড়েছে। পাশাপাশি পর্যটন ও যোগাযোগ সম্পর্কিত পরিষেবাগুলো টিকে থাকতে লড়াই করছে। এ অবস্থায় সংস্থাগুলোর নেয়া বিপুল পরিমাণ ঋণের বোঝার কারণে ভবিষ্যতে এ খাতে বিনিয়োগও কমে যেতে পারে। এছাড়া অর্থনীতি পুনরুদ্ধার ও মূল্যস্ফীতি ত্বরান্বিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সরকারগুলো প্রণোদনা বন্ধ করে আর্থিক ও মুদ্রানীতি কঠোর করছে। এ অবস্থায় দেশগুলোর এমন পদক্ষেপের প্রভাব বিবেচনা করার আহ্বান জানিয়েছে আইএমএফ।