বেসরকারি খাতে দেয়ার উদ্যোগ বিদ্যুৎ সঞ্চালন
বিদ্যুৎ উৎপাদনের পর এবার সঞ্চালন ব্যবস্থার সঙ্গেও যুক্ত হচ্ছে বেসরকারি খাত। ব্যক্তিখাতের কোম্পানির হাতে জাতীয় বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন দিতে যাচ্ছে বিদ্যুৎ বিভাগ। এরই অংশ হিসেবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দুটি সঞ্চালন লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছে সংশ্লিষ্ট বিভাগ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উৎপাদনে বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণের ফলে বিদ্যুতের ব্যয় বেড়েছে। সঞ্চালন লাইন বেসরকারি খাতে দেয়া হলে সামগ্রিক সঞ্চালন ব্যয়ও বেড়ে যাবে। এর চাপ পড়বে গ্রাহকের ওপর।
বিদ্যুৎ উৎপাদনের সঙ্গে সমন্বয় রেখে উন্নতি হচ্ছে না সঞ্চালন ব্যবস্থার। উৎপাদনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সঞ্চালন লাইন নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হলেও লোকবল ও অন্যান্য সীমাবদ্ধতার কারণে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সঞ্চালন কোম্পানি পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) পক্ষে তা সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া সরকারি প্রতিষ্ঠান হওয়ার কারণে কাঙ্ক্ষিত সময়ে বিভিন্ন প্রকল্পে অর্থায়ন চেয়েও পাচ্ছে না। তবে বেসরকারি খাতে দেয়া হলে বিভিন্ন কোম্পানি খুব দ্রুত আগ্রহ দেখাবে বলে মনে করেন বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা।
এ সম্ভাবনা থেকেই প্রাথমিকভাবে কক্সবাজারের মহেশখালী থেকে মদুনাঘাট এবং চট্টগ্রামের রাউজান থেকে মিরসরাই পর্যন্ত বেসরকারি খাতে দুটি সঞ্চালন লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে রাষ্ট্রীয় সঞ্চালন প্রতিষ্ঠান পিজিসিবিকে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। পিজিসিবি দুটি লাইনের একটি বিডার ফিন্যান্সিং পদ্ধতি ও অন্যটি আইপিপি প্রক্রিয়ায় করার প্রস্তাব তৈরি করেছে।
জানতে চাইলে পিজিসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মাসুম আল বেরুনী এ প্রসঙ্গে বলেন, প্রাথমিকভাবে আমরা দুটি লাইন করার বিষয়ে ভাবছি। তবে আইপিপির কোন মডেলটি অনুসরণ করা হবে, তা নির্ধারণের জন্য সরকারের বিদ্যুৎ বিষয়ে নীতিগবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলকে বলা হয়েছে। তারা একটি মডেল চূড়ান্ত করলে এ বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
তবে পিজিসিবির মতো শক্তিশালী রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান থাকার পরও মাত্র ২০ হাজার মেগাওয়াটের জন্য বেসরকারি খাতে সঞ্চালন লাইন ছেড়ে দেয়ার বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেছেন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, বিদ্যুৎ উৎপাদনে রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের নামে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিয়ে বিদ্যুতের ব্যয় যেভাবে বেড়েছে, সঞ্চালন লাইনের ক্ষেত্রেও একই উদ্যোগ নিলে ব্যয়ের মাত্রা আরো বেড়ে যাবে।
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, মাত্র ২০ হাজার মেগাওয়াট সঞ্চালনের জন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভর করা কোনো যৌক্তিক সিদ্ধান্ত হবে না। এটা হলে রেন্টাল মডেলে উৎপাদন খাতের মতো সঞ্চালন খাতও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দেয়া হবে। এখানেও ক্যাপাসিটি চার্জ রাখা হবে, যা পুরোপুরি জনস্বার্থবিরোধী।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিদ্যুতের সঞ্চালন ব্যবস্থা বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়ার নজির নেই পার্শ্ববর্তী দেশেও। ভারতে ‘ওয়ান ন্যাশন, ওয়ান গ্রিড’ নামে বিদ্যুৎ সঞ্চালন হয় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন জাতীয় সঞ্চালন কোম্পানির মাধ্যমে।
রাষ্ট্রীয় সঞ্চালন কোম্পানি পাওয়ার গ্রিড করপোরেশন অব ইন্ডিয়া লিমিটেডের (পিজিসিআই) পাশাপাশি প্রতিটি রাজ্যে রয়েছে আলাদা সঞ্চালন প্রতিষ্ঠান। সেগুলোও পিজিসিআই নিয়ন্ত্রণ করে। বর্তমানে পিজিসিআইয়ের আওতায় সারা ভারতে সঞ্চালন লাইন রয়েছে ১ লাখ ৪৯ হাজার সার্কিট কিলোমিটার। আর দেশটির বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ৩ লাখ ৪৬ হাজার ৪৭ মেগাওয়াট।
বিদ্যুৎ বিভাগের হিসাবমতে, বর্তমানে আমদানি, ক্যাপটিভ ও অন্যান্য খাতসহ বাংলাদেশে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২০ হাজার মেগাওয়াট। বিদ্যুৎ খাতের মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২১ সালে এ সক্ষমতা ২৪ হাজার এবং ২০৩০ সালে ৪০ হাজার মেগাওয়াটে দাঁড়াবে।
গত কয়েক বছরে উৎপাদন সক্ষমতা বাড়লেও সঞ্চালন ব্যবস্থার দিকে নজর না দেয়ায় এখন তা (সঞ্চালন) বেসরকারি খাতে দেয়ার সিদ্ধান্ত হচ্ছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. মোহাম্মদ তামিম। তিনি বলেন, সঞ্চালন খাতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করতে হলে সরকারকে ‘ফিক্সড রেট অব ইনভেস্টমেন্ট’ কঠোরভাবে দেখতে হবে।
উল্লেখ্য, দেশে জাতীয় গ্রিডভুক্ত সঞ্চালন লাইন ও উপকেন্দ্রের ক্ষমতা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। ২০০৯ সালে মোট সঞ্চালন লাইন ছিল মাত্র ৮ হাজার সার্কিট কিলোমিটার। বর্তমানে এটি ১১ হাজার ৩৩ সার্কিট কিলোমিটারে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে ৪০০ কিলোভোল্টেজের লাইন রয়েছে ৬৯৭ সার্কিট কিলোমিটার, ২৩০ কিলোভোল্টেজ ক্ষমতার লাইন রয়েছে ৩ হাজার ৩৪২ সার্কিট কিলোমিটার এবং ১৩২ কিলোভোল্টেজ লাইন ৬ হাজার ৯৯৪ সার্কিট কিলোমিটার। এছাড়া সাবস্টেশনের সক্ষমতা ১৫ হাজার ৮৭০ এমভিএ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৬ হাজার ৪৬ এমভিএতে।