বেসটেকের বড় জালিয়াতি উদ্ঘাটন
চট্টগ্রামের কর্ণফুলী রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে (কেইপিজেড) বড় পরিসরে ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করছে দক্ষিণ কোরিয়াভিত্তিক প্রতিষ্ঠান বেসটেক বিডি লিমিটেড। শতভাগ রফতানির প্রতিশ্রুতি দিয়ে শুল্কমুক্ত সুবিধায় বিদেশ থেকে নিয়মিত কাঁচামালও নিয়ে আসছে প্রতিষ্ঠানটি। তবে আমদানি হওয়া এসব কাঁচামাল চট্টগ্রাম বন্দর থেকে খালাসের পর নির্দিষ্ট কারখানায় না গিয়ে অবৈধভাবে চলে যাচ্ছে দেশের স্থানীয় বাজারে।
সম্প্রতি অনুসন্ধান চালিয়ে বেসটেক বিডি লিমিটেডের ১৭টি চালানে বড় ধরনের জালিয়াতি উদ্ঘাটন করেছে কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট, চট্টগ্রাম। এসব চালানের বেশির ভাগই ওভেন ফ্যাব্রিকস। ধারাবাহিকভাবে আমদানি করা এসব কাঁচামাল চট্টগ্রাম বন্দর থেকে খালাস হওয়ার পর নির্ধারিত কারখানায় না নিয়ে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য খালাস করতে চালানগুলোর শুল্কায়ন কার্যক্রম সম্পন্ন করেছে চট্টগ্রাম কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। চট্টগ্রাম কাস্টমস থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালের নভেম্বর থেকে চলতি বছরের মে পর্যন্ত বিভিন্ন ধাপে আগামপত্র দাখিল করে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ১৭টি চালান ছাড় করিয়ে নিয়েছে বেসটেক।
বাণিজ্যিকভাবে আমদানি করতে গেলে এসব পণ্যে ২৫ শতাংশ কাস্টমস ডিউটি, ৩ শতাংশ রেগুলেটরি ডিউটি, ২০ শতাংশ সাপ্লিমেন্টারি ডিউটি, ১৫ শতাংশ ভ্যাট, ৫ শতাংশ এআইটি ও ৪ শতাংশ এটিভি প্রদান করতে হতো। তবে কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট, চট্টগ্রামে তালিকাভুক্ত হওয়ায় প্রতিষ্ঠানটি থেকে শুল্ক ও করাদি আদায় করেনি চট্টগ্রাম কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।
জালিয়াতির মাধ্যমে শুল্কমুক্ত সুবিধার অপব্যবহারের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর গত ১৭ সেপ্টেম্বর বেসটেকের বিরুদ্ধে শুল্ক আইনে একটি মামলাও করেছে কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট। প্রতিষ্ঠানটির আগে আমদানি-রফতানি করা অন্যান্য চালান নিয়েও এখন তথ্য যাচাই শুরু করেছে বন্ড কমিশনারেট, চট্টগ্রাম।
এ বিষয়ে কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট, চট্টগ্রামের কমিশনার মো. আজিজুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকারের শুল্ক সুবিধা গ্রহণ করে এ জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছে কোরিয়াভিত্তিক বিদেশী প্রতিষ্ঠান বেসটেক বিডি লিমিটেড।
দীর্ঘ অনুসন্ধান চালিয়ে আমরা বিভিন্ন দফায় প্রতিষ্ঠানটির ১৭টি চালানে জালিয়াতি নিশ্চিত করেছি। এসব চালান চট্টগ্রাম বন্দর থেকে বের করে কারখানায় না নিয়ে স্থানীয় বাজারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে অধিক মুনাফার উদ্দেশ্যে। এ অনিয়মের ব্যাপারে বেসটেক বিডি লিমিটেড কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।’
এদিকে অনুসন্ধান কার্যক্রমে জালিয়াতি নিশ্চিত হওয়ায় গত সপ্তাহে বেসটেকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বরাবর চিঠি দিয়েছে কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট, চট্টগ্রাম। চিঠিতে বলা হয়, আপনার প্রতিষ্ঠানের বন্ড সুবিধায় আমদানি করা কাপড় দিয়ে পোশাক প্রস্তুত করে বিদেশে রফতানি করার কথা থাকলেও ফ্যাব্রিকস কাঁচামাল দেশের খোলাবাজারে বিক্রি করা হয়েছে।
এটা কাস্টমস অ্যাক্ট, ১৯৬৯-এর সেকশন ৬২, ৯০, ৯৪, ১০৪, ১০৫, ১৫৭ ও ১৬৮-এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন ও শাস্তিযোগ্য। এছাড়া একই আইনের সেকশন ১৩(৩) এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে বন্ড লাইসেন্স বাতিলযোগ্য।
এ ঘটনায় বেসটেক বিডি লিমিটেডের পক্ষ থেকে কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে, ‘এ ১৭টি চালান বেসটেক আমদানি করেনি, যদিও আইপিগুলো (ইমপোর্ট পারমিট) বেপজা থেকে বৈধভাবে গ্রহণ করা হয়েছে। মালামাল খালাসকারী সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টকেও আমরা নিয়োগ প্রদান করিনি। বাণিজ্যিক কর্মকর্তা জালিয়াতির মাধ্যমে এ কার্যক্রম সংঘটিত করেছে।’
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে বেসটেক বিডি লিমিটেডের ব্যবস্থাপক (বাণিজ্যিক) আমজাদ হোসাইন বলেন, ‘আমাদের কোম্পানির একাধিক কর্মকর্তা জাল জালিয়াতি করে এ অপকর্ম করেছে। তাদের বিরুদ্ধে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।’
চালানের গন্তব্যস্থল কোথায় ছিল: বেসটেকের এই জালিয়াতি উদ্ঘাটনে সংশ্লিষ্ট একাধিক সংস্থার মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মূলত রফতানির নাম করে বাংলাদেশে আনা এ ধরনের ফ্যাব্রিকস চালানের গন্তব্যস্থল দেশের সবচেয়ে বড় কাপড়ের পাইকারি বাজার ঢাকার ইসলামপুর মার্কেট।
সেখানকার বড় বড় পাইকার ব্যবসায়ী এসব অবৈধ ফ্যাব্রিকস কিনে থাকেন। পরবর্তীতে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের নামকরা ব্র্যান্ডের শোরুম থেকে শুরু করে খুচরা পর্যায়ের বড় ব্যবসায়ীরা ইসলামপুর থেকে এসব চালানের ফ্যাব্রিকস কিনে নেন।
তদারকি সংস্থার দুর্বলতা: এ ধরনের জালিয়াতির পেছনে তদারকি সংস্থার দুর্বলতাও দায়ী বলে মনে করেন রফতানি খাতের ব্যবসায়ীরা। সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করছেন এমন বেশ কয়েকটি রফতানিমুখী পোশাক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী কর্মকর্তারা বলেন, বর্তমানে কোনো প্রতিষ্ঠানের বন্ড লাইসেন্সে পণ্যের প্রাপ্যতা সঠিকভাবে নির্ধারণ, ডেডো (শুল্ক রেয়াত ও প্রত্যর্পণ পরিদপ্তর) কর্তৃক সঠিকভাবে সহগ নিরূপণ ও নির্দিষ্ট সময় পরপর তা হালনাগাদ করা, বন্ডে আমদানির তথ্য পাস বইতে যথাযথভাবে লিপিবদ্ধ করা ও ভ্যাট বিভাগের কর্মকর্তা কর্তৃক শিল্পপ্রতিষ্ঠানে সঠিকভাবে মনিটরিং করা হচ্ছে না। ফলে বেসটেকের মতো এ ধরনের জালিয়াতি প্রতিনিয়তই ঘটছে। কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট কর্তৃক বন্ডেড লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানগুলোয় যথাযথভাবে অডিট করা হলে এ জালিয়াতি অনেক নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে মনে করছেন তারা।