বেকার হয়ে পড়েছে শত শত লাইটারেজ জাহাজ
ডলার সংকটে সীমিত হয়েছে দেশের আমদানি। এর প্রভাব পড়েছে বন্দরকেন্দ্রিক নৌ-বাণিজ্যে। কোভিড-পরবর্তী রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বেসামাল বিশ্ব অর্থনীতি। কমেছে নৌ-পথে পণ্য পরিবহন। মাদার ভ্যাসেল থেকে লাইটারেজ জাহাজের মাধ্যমে বন্দরে খালাস করা হয় পণ্য। আমদানি কমায় চট্টগ্রাম বন্দরে অলস সময় পার করছে শত শত লাইটারেজ জাহাজ। লোকসান গুনছেন এসব জাহাজের মালিকরা। আমদানি পণ্যের চেয়ে আনুপাতিক হারে লাইটারেজের সংখ্যা বৃদ্ধিকেও এর জন্য দায়ী করছেন কেউ কেউ।
সূত্র জানায়, ডলার সংকটে আমদানি কমে যাওয়ায় কয়েকমাস ধরে অনেক আমদানিকারক ঋণপত্র খোলা বন্ধ রাখেন। যার প্রভাব পড়েছে দেশের সামগ্রিক আমদানিতে। বিশেষ করে গম, পাথর, ভুট্টা, সিমেন্ট ক্লিংকার, লোহার স্ক্র্যাপ আমদানি অনেকটা সীমিত করেন ব্যবসায়ীরা। একই সঙ্গে সরকারি পর্যায়ে চাল-গম আমদানিও। যে কারণে চট্টগ্রামে কার্গো বোঝাই ভ্যাসেল আসা কমে গেছে।
তথ্য অনুযায়ী, বিগত সময়ে যেখানে শতাধিক মাদার ভ্যাসেল আমদানি করা বিভিন্ন পণ্য নিয়ে খালাসমান ও খালাসের অপেক্ষায় থাকতো, এখন সেটা ৬৫-৭৫টির মতো ভ্যাসেল থাকছে চট্টগ্রাম বন্দরে। এর মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ কনটেইনার ভ্যাসেল।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বহির্নোঙর ও জেটিতে অবস্থানকারী জাহাজের ওভারসাইট থেকে কেবল লাইটারেজ জাহাজেই পণ্য খালাস করা হয়। বহির্নোঙর থেকে পাথর, সিমেন্ট ক্লিংকার, স্ক্র্যাপ, গম, কয়লা, সার, ভুট্টা, ডাল, চিনি, লবণ, সরিষাসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য লাইটারেজ জাহাজের মাধ্যমে পরিবাহিত হয়। ফলে সারাবছর লাইটারেজ জাহাজের চাহিদা থাকে।
চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্য অনুযায়ী, সবশেষ ১২ জুন বাল্ক পণ্যবাহী ৪৩টি জাহাজ বহির্নোঙরে অবস্থান করছে। এর মধ্যে পণ্য খালাস হচ্ছে ৩২টি থেকে। খালাসরত জাহাজগুলোর মধ্যে পাঁচটি জেনারেল কার্গো, ছয়টি ফুড গ্রেন, দুটি সার, ১৫টি সিমেন্ট ক্লিংকার, দুটি চিনি এবং দুটি অয়েল ট্যাংকার রয়েছে।
জানা যায়, দেশে ছোট-বড় পাঁচ হাজারের মতো লাইটার জাহাজ রয়েছে। বেশ কয়েকবছর ধরে বহির্নোঙর থেকে লাইটারেজ পণ্য খালাস নিয়ন্ত্রণ করে ‘ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল (ডব্লিউটিসি)’।
ডব্লিউটিসির তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির অধীনে প্রায় সাড়ে ১২শ লাইটারেজ রয়েছে। ১২ জানুয়ারি চট্টগ্রামে ৭শ লাইটারেজ খালি অবস্থায় পণ্য বোঝাইয়ের বুকিং সিরিয়ালে ছিল। অন্যদিকে ডব্লিউটিসির বাইরে বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানের শত শত লাইটারেজ রয়েছে। বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজস্ব লাইটারেজগুলো নিজেদের আমদানি পণ্য পরিবহন করলেও ছোট ছোট মালিকদের জাহাজগুলো সংকটে পড়েছে।
নৌ-পরিবহন অধিদপ্তরের মুখ্য পরিদর্শক মো. শফিকুর রহমান বলেন, ডিপার্টমেন্ট অব শিপিংয়ে নিবন্ধিত পাঁচ হাজারের কাছাকাছি লাইটার জাহাজ রয়েছে। এসব লাইটার জাহাজ অভ্যন্তরীণ নৌপথে চলাচল করে।
খাদ্যপণ্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান গ্রিন ইমপেক্স লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী মাহবুব রানা বলেন, ‘ডলার সংকটের কারণে এলসি (ঋণপত্র) কমে গেছে। আমদানি কম হওয়ায় বহির্নোঙরে কার্গোবাহী জাহাজের সংখ্যাও কমেছে। ফলে লাইটারেজের চাহিদাও কমেছে।’
তিনি বলেন, ‘শুধু খাদ্যপণ্য নয়, ডলার সংকটে স্ক্র্যাপ, সিমেন্ট ক্লিংকার আমদানিও কমেছে। এতে হঠাৎ করে কমে গেছে লাইটারেজের চাহিদা।’
চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক পরিচালক মাহফুজুল হক শাহ বলেন, ‘লাইটার জাহাজে বাল্কপণ্য পরিবহন করা হয়। ডলার সংকটের কারণে আমদানি সীমিত হওয়ায় বাল্কপণ্য আমদানি কিছুটা কমেছে। এতে কমেছে লাইটার জাহাজগুলোর চাহিদা।’
ডব্লিউটিসির যুগ্ম সচিব (অপারেশন) আতাউল কবীর রঞ্জু বলেন, ‘আমাদের তালিকাভুক্ত ১২শ ৫০টি লাইটার রয়েছে। এখন ৭শ’র মতো বসা। কিছু বসা রয়েছে একমাসের বেশি।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ কার্গো ভ্যাসেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব চিটাগাংয়ের (বিসিভোয়া) কো-কনভেনর নুরুল হক বলেন, আমদানি কিছুটা কমেছে। এটির প্রভাব রয়েছে। মূল বিষয় হচ্ছে, বড় শিল্পগ্রুপগুলো নিজেদের লাইটার দিয়ে পণ্য পরিবহন করছে। এর প্রভাবে আমাদের লাইটারগুলোর বুকিং কম হচ্ছে।