বিয়ে বিচ্ছেদ বাড়ছে
বিয়ে বিচ্ছেদ। এই শব্দটিকে একসময় নেতিবাচকভাবেই দেখা হতো। জীবন বাজি রেখে মানুষ তার সংসার টিকিয়ে রাখতে বদ্ধপরিকর থাকত। দিনবদলের পালায় সেই বিচ্ছেদ এখন অনেকটা সহজ হয়ে গেছে মানুষের জীবনে। জীবনের নানা বাঁকে যখনই মানুষ কোনো পারিবারিক বাধার সম্মুখীন হচ্ছে, তখন বিয়ে বিচ্ছেদের আশ্রয় নিতে পিছপা হচ্ছে না।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে বিয়ে বিচ্ছেদের ঘটনা বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে। তবে কোন ধরনের পরিবারে বেশি বিচ্ছেদ ঘটছে, তা নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে জমা পড়া তালাকের তথ্য-উপাত্ত বিশ্নেষণ করে দেখা গেছে, মূলত উচ্চ ও নিম্নবিত্ত পরিবারে বিচ্ছেদ বেশি হচ্ছে।
সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, গত ছয় বছরে দুই সিটি এলাকায় বিচ্ছেদের নোটিস জমা পড়েছে ৩৬ হাজার ৩৭১টি। এর মধ্যে কার্যকর হয়েছে ৩০ হাজার ৮৫৫টি ও বিচ্ছেদের অপেক্ষায় আছে পাঁচ হাজার ৫১৬টি। আর স্বামীকে তালাকের নোটিস ২৪ হাজার ৮০৩টি বা ৬৮ দশমিক ১৯ শতাংশ এবং স্ত্রীকে তালাকের নোটিস ১২ হাজার ১৮টি বা ৩৩ দশমিক ০৪ শতাংশ। যাদের অধিকাংশের বয়স ৩০-৩৫ বছরের মধ্যে এবং যারা উচ্চ ও নিম্নবিত্ত পরিবারের সদস্য। আর বিয়ের এক বছর না যেতেই তারা বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সমাজবিজ্ঞানী ড. মাহবুবা নাসরীন বলেন, ‘সাধারণত উচ্চবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের মধ্যে বিচ্ছেদ প্রবণতা বেশি দেখা যায়। তবে মধ্যবিত্ত পরিবারে এমন প্রবণতা অনেকটাই কম। উচ্চবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের কেউ কারও কথা শুনতে চান না। তারা যে যার কথামতো চলেন। উচ্চবিত্ত পরিবারের সদস্যরা মনে করেন, নিজেদের অঢেল অর্থ সম্পদ রয়েছে, তাই বিচ্ছেদ হলে সমস্যা হবে না। আর নিম্নবিত্ত পরিবারে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির ফারাক থাকে বেশি। বেশিরভাগ পরিবারের নারীরা চাহিদা অনুযায়ী অনেক কিছুই পান না, অভাব-অনটন লেগেই থাকে। ফলে ঝগড়া-বিবাদ সৃষ্টি হয়। আর মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যরা লোকলজ্জায় ঘর ভাঙতে রাজি হন না।’
বর্তমানে আমাদের দেশে বিচ্ছেদ বেশি হচ্ছে উল্লেখ করে ড. মাহবুবা নাসরীন বলেন, ‘মূলত নারীর স্বাধীনতা, সচেতনতা এবং উপার্জন ক্ষমতা বাড়ায় তারা খুব সহজেই বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন।’
গবেষণায় দেখা গেছে পারস্পরিক বোঝাপড়ার অভাব, ব্যক্তিত্বের সংঘাত, সামাজিক অস্থিরতা, যৌতুক দাবি, নির্যাতন, তথ্যপ্রযুক্তি ও আকাশ সংস্কৃতির প্রভাব, দৃষ্টিভঙ্গি, অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা, পারিবারিক কলহ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, মাদকাসক্তি, পরকীয়া, সন্দেহপ্রবণতা, ধর্মীয় অনুশাসন মেনে না চলা, নারীর পুরুষ নির্ভরশীলতা কমা, নারীর আত্মমর্যাদা বৃদ্ধিসহ নানা কারণে বিচ্ছেদ ঘটছে। এক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে নারীরাই এগিয়ে। সামাজিকভাবে নারীদের আত্মমর্যাদা ও কর্মপরিধি বেড়েছে। অনেক ক্ষেত্রে তারা নিজেরাই স্বয়ংসম্পূর্ণ। স্বামীর ওপর ভরসা করতে চান না তারা। এজন্য পারিবারে সমস্যা সৃষ্টি হলে তারা বিচ্ছেদের দিকে যাচ্ছেন। তবে নির্যাতন, আচরণগত সমস্যা এবং সামাজিক অস্থিরতাও বিচ্ছেদের একটি বড় কারণ।’
‘মনিটরিং দ্য সিচুয়েশন অব ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস অব বাংলাদেশ’ (এমএসভিএসবি) শীর্ষক প্রতিবেদন বলছে, দেশে বিয়ে বিচ্ছেদের হার বেড়েছে। এ বিচ্ছেদ করার ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে নারীরা বেশি এগিয়ে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তালাক বা বিচ্ছেদের ঘটনা দিন দিন বেড়ে যাওয়ার পেছনে মাদকের বিস্তার, প্রযুক্তির উৎকর্ষ, নারীর উপার্জিত অর্থ স্বাধীনভাবে ব্যয়ে বাধা, পারিবারিক ও সামাজিক মেলবন্ধনের ঘাটতি বড় ভূমিকা রাখছে। একই সঙ্গে নারীদের বিবাহ, তালাক ও পৃথক বসবাসের সংখ্যাও বেড়েছে। দেশের ১০০ জন নারীর মধ্যে বর্তমানে গড়ে ১০ দশমিক পাঁচ শতাংশ নারী তালাকপ্রাপ্ত, যা আগের বছর ছিল ১০ শতাংশ। গত পাঁচ বছরের ব্যবধানে এই হার বেড়েছে দুই ভাগ। ২০১৭ সাল পর্যন্ত হিসাব অনুসারে দেশের মোট বিবাহযোগ্য পুরুষ জনসংখ্যার ৫৯ দশমিক ৯ শতাংশ বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ। ২০১৬ সালে এ হার ছিল ৫৯ দশমিক দুই শতাংশ। ১০ বছরের বেশি বয়সীদের বিয়ের হিসাব কষে এ হার বের করা হয়েছে।
বিয়ে বিচ্ছেদের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ফারাহ দীবা বলেন, বিয়ে বিচ্ছেদের কারণকে দুটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। এর মধ্যে একটি মুখ্য কারণ হলো নারীর আর্থিক সক্ষমতা। অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। এটা পজিটিভ। তবে এই অর্থ স্বাধীনভাবে ব্যয়ে বাধা আসে, অনেক সময় শৃঙ্খলভাবে হয় না। মানে হলো বিশৃঙ্খল জীবন বিচ্ছেদের বড় কারণ। দেখা যায়, কর্মজীবী নারীদের মধ্যে এই বিচ্ছেদের হার বেশি। আবার মাদকের প্রভাবেও বিয়ে বিচ্ছেদের মাত্রা এখন ভয়াবহ জানিয়ে তিনি বলেন, এটি বিচ্ছেদের বড় কারণ। বিশেষ করে বিয়ের পর নেশাগ্রস্ত স্বামীর প্রতি স্ত্রী আস্থা হারিয়ে ফেলছেন। একজন নেশাগ্রস্ত মানুষ নানা অপরাধের সঙ্গেই যুক্ত হতে পারেন।
নেশায় আক্রান্ত মানুষ শারীরিকভাবেও ধীরে ধীরে অক্ষম হয়ে ওঠে। সঙ্গত কারণে একজন নারী ওই পুরুষের কাছে জীবন ও সংসারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেন না। তখন বিচ্ছেদ আবশ্যক হয়ে ওঠে। নারীদেরও কেউ কেউ নেশায় জড়িয়ে যাচ্ছেন এবং তাদের কারণেও বিচ্ছেদ ঘটছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা হাফিজুর রহমান মনে করেন, সমাজে বিয়ে বিচ্ছেদের অন্যতম কারণ প্রযুক্তির উৎকর্ষতা। তিনি বলেন, ইন্টারনেট বা প্রযুক্তির প্রতি ঝোঁক বাড়ার কারণে স্ত্রীকে সময় দেন না স্বামী। স্ত্রীও পর্যাপ্ত সময় দেন না স্বামীকে। ফলে তাদের মধ্যে দূরত্ব বাড়ছে। একসময় এই সম্পর্কে তিক্ততা বেড়ে যাচ্ছে, বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে।
উচ্চশিক্ষিত এক নারী আয়শা আনজুম বলছিলেন, আগে পুরুষ বেশি শিক্ষিত ছিল, এখন নারীরাও এগিয়ে যাচ্ছে। ফলে নারী তার মতামতের
ওপর শ্রদ্ধাশীল হয়েছে। স্বামী বা পুরুষ ইচ্ছা করলেই তার সিদ্ধান্ত নারী বা স্ত্রীর ওপর চাপিয়ে দিতে পারে না। অবক্ষয় নয়, সামাজিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের ফলে এটি হচ্ছে। আমার মনে হয় নারীর নিজের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের কারণে এই সংখ্যা দিনের পর দিন বাড়ছে।