বিপদে পড়তে যাচ্ছে কি দেশের ইস্পাত শিল্প
গত এক দশকে মেগা প্রজেক্টসহ অনেক নির্মাণ প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এসব প্রকল্প দেশের ইস্পাত খাতের চাহিদা বাড়িয়েছে। বাড়তি এ চাহিদা পূরণের জন্য ইস্পাত খাতের কোম্পানিগুলো বিনিয়োগ ও সক্ষমতা দুটোই বাড়িয়েছে। এমন মুহূর্তেই ব্যয় সংকোচনের নীতি থেকে নিতান্ত জরুরি ছাড়া নতুন করে অন্য কোনো প্রকল্প হাতে না নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বিষয়টি দেশের ইস্পাত খাতে উদ্বেগের সঞ্চার করেছে। চাহিদা হ্রাসে বাড়তি উৎপাদন সক্ষমতা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বড় বোঝা হয়ে ওঠার আশঙ্কা করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশের স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএসএমএ) ও উদ্যোক্তাদের তথ্য অনুযায়ী, গত ১০ বছরে দেশে ইস্পাত খাতে বড় ধরনের প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ২০১১ সালে দেশে সম্মিলিতভাবে এমএস রড উৎপাদন হতো ২৫ লাখ টন। ২০১৬ সালে এটি ৫৫ লাখ টনে দাঁড়ায়। বর্তমানে চাহিদা অনুযায়ী বছরে গড়ে উৎপাদন হচ্ছে ৬৫ লাখ টন। উৎপাদিত রডের তুলনায় বাজারে সরবরাহ করা রডের পরিমাণ কিছুটা কম। ২০১৬ সালে বাজারে গড়ে ৫০ লাখ টন রড বিক্রি হয়েছে। বর্তমানে এর পরিমাণ ৬০ লাখ টনের বেশি। যদিও ইস্পাত উৎপাদকদের রড উৎপাদন সক্ষমতা আরো বেশি। ২০১৬ সালে ইস্পাত খাতের মোট সক্ষমতা ছিল ৭০ লাখ টন, যা বর্তমানে ৮০ লাখ টন ছাড়িয়েছে। এখনো বেশকিছু প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বাড়ানোর কার্যক্রম চলছে। এতে আগামী দুই বছরে দেশে রড উৎপাদনের সক্ষমতা এক কোটি টন ছাড়িয়ে যাবে। ইস্পাত খাতে উদ্যোক্তাদের মোট বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। এর বড় অংশই ব্যাংকঋণ। বর্তমানে প্রায় তিন লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত কয়েক বছর অর্থনৈতিক অঞ্চল, সেতু, বিদ্যুৎকেন্দ্র ও যোগাযোগ অবকাঠামো নির্মাণসহ অনেক প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে। এসব প্রকল্প দেশে ইস্পাত খাতের চাহিদা বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রেখেছে। পাশাপাশি প্রবাসী আয়ে শহর ও গ্রামাঞ্চলে আবাসন নির্মাণ বাড়তে থাকার বিষয়টিও ইস্পাত খাতের প্রবৃদ্ধিতে সহায়তা করেছে। সামনের দিনগুলোয়ও এ ধারা অব্যাহত থাকবে ধরে নিয়ে বিনিয়োগ ও উৎপাদন সক্ষমতা বাড়িয়েছেন উদ্যোক্তারা। তবে বর্তমান পরিস্থিতি গোটা খাতের জন্যই বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে।
বিএসএমএর সেক্রেটারি জেনারেল ও মেট্রোসেম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, পদ্মা সেতু, দেশের সব জেলার মধ্যে ফোর লেন সংযোগ সড়ক, ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের মতো মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের জন্য বাড়তি যে ইস্পাতের চাহিদা তৈরি হবে সেটি মাথায় রেখেই কিন্তু গত ১০ বছরে দেশের ইস্পাত খাতের উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। বর্তমানে প্রয়োজনীয় নয় এমন প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন কার্যক্রম পিছিয়ে দেয়ার বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত ইস্পাত খাতের ওপর প্রভাব ফেলবে। কারণ হচ্ছে এসব প্রকল্পের ইস্পাতের চাহিদা বিবেচনায় নিয়েই কিন্তু বর্তমানে আমাদের উৎপাদন সক্ষমতার ৫২-৫৩ শতাংশ ব্যবহূত হচ্ছে। ফলে এসব প্রকল্পের বাস্তবায়ন পিছিয়ে গেলে স্বাভাবিকভাবেই ইস্পাতের ব্যবহার ও উৎপাদনও কমবে। এতে অব্যবহূত সক্ষমতার পরিমাণও বাড়বে। কভিডকালে ব্যবসায় টিকতে না পেরে ১০টির মতো ইস্পাত কারখানা বিক্রি ও একীভূতকরণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে কিছু কারখানা বিক্রিও হয়ে গিয়েছে। ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে। রডের দাম বাড়ায় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গিয়েছে এবং এ খাতের বিক্রিও কমেছে। কভিড থেকে পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীতেই আবাসন খাতের চাহিদা বেড়েছিল। কিন্তু বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আবাসন খাতের ব্যবসাও ধাক্কা খাবে। সামনের ২০২২-২৩ অর্থবছর ইস্পাত খাত বেশ চাপের মধ্য দিয়ে যাবে। পাশাপাশি এ খাতে উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগের ঝুঁকিও বাড়বে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি ভালো নয়।
১৯৫২ সালে চট্টগ্রামের নাছিরাবাদ শিল্প এলাকায় গড়ে ওঠা ‘ইস্ট বেঙ্গল স্টিল রি-রোলিং মিলস’ স্বাধীনতার পর নাম বদল করে রাখা হয় বাংলাদেশ স্টিল রি-রোলিং মিলস (বিএসআরএম)। বিএসআরএম গ্রুপের আট কারখানায় এখন বছরে রড উৎপাদনক্ষমতা ১৬ লাখ টন আর বিলেট উৎপাদনক্ষমতা ১৮ লাখ টন। দেশের পাশাপাশি বিদেশেও কার্যক্রম রয়েছে বিএসআরএমের। হংকংয়ে গ্রুপটির একটি সাবসিডিয়ারি রয়েছে। কেনিয়ায়ও বিএসআরএম বিনিয়োগ করেছে। তাছাড়া পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের কলকাতায় কয়েক বছর ধরে বিএসআরএম ব্যবসা করছে।
বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে বিএসআরএমের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) তপন সেন গুপ্ত বলেন, বড় অবকাঠামো নির্মাণযজ্ঞে ইস্পাত সরবরাহ ধীর হয়ে এলে স্বাভাবিকভাবেই এর একটা প্রভাব থাকবে। এছাড়া প্রকল্পের সময় বাড়লে এর অর্থনৈতিক সুবিধাও কমে আসার ঝুঁকি থাকে। তবে সরকার বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়েই নিশ্চয় এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
আবুল খায়ের গ্রুপ ১৯৯৩ সালে ঢেউটিন উৎপাদনের মাধ্যমে ফ্ল্যাট ইস্পাতের বাজারে এলেও রড উৎপাদন শুরু করে মূলত ২০০৯ সালে। একেএস ব্র্যান্ড নামেই রড বাজারজাত হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটির। ইস্পাতের বাজারে দেশে প্রথম ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেসে ইস্পাত উৎপাদন শুরু হয় তাদের হাত ধরেই। বছরে আবুল খায়ের গ্রুপের ইস্পাত কারখানার রড উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে ১৪ লাখ টন।
চট্টগ্রামভিত্তিক কবির স্টিল রি-রোলিং মিল (কেএসআরএম) ১৯৮৪ সাল থেকে রড উৎপাদন করে আসছে। প্রতিষ্ঠানটির শুরুতে সেমি রি-রোলিং মিল দিয়ে ১ লাখ ৫০ টন উৎপাদনক্ষমতা ছিল। ইউরোপের পমিনি প্রযুক্তিতে নিজেদের কারখানার রড উৎপাদনক্ষমতা পরে আট লাখ টনে উন্নীত করেছে। রডের মধ্যবর্তী কাঁচামাল বিলেট উৎপাদনও ছয়-আট লাখ টনে উন্নীত করার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে কোম্পানিটি।
২০০৮ সালে সীতাকুণ্ডে স্বয়ংক্রিয় কারখানায় ইস্পাত উৎপাদন শুরু করে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি জিপিএইচ ইস্পাত। ২০১৭ সালে কোম্পানিটি আড়াই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের কুমিরায় অত্যাধুনিক ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেস প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে নতুন কারখানা নির্মাণের কাজ শুরু করে। নতুন ও পুরনো কারখানা মিলিয়ে কোম্পানির বার্ষিক রড উৎপাদনক্ষমতা বছরে ১০ লাখ টন। এছাড়া জিপিএইচের পুরনো কারখানায় বার্ষিক বিলেট উৎপাদনক্ষমতা ১ লাখ ৬৮ হাজার টন হলেও সম্প্রসারিত নতুন কারখানায় উৎপাদন হবে ৮ লাখ ৪০ হাজার টন বিলেট। জিপিএইচের পণ্য শ্রীলংকা, চীনসহ ভারতের কয়েকটি রাজ্যে রফতানি হয়েছে। চীনের বাজারে বাংলাদেশ থেকে প্রথমবারের মতো বিলেট রফতানির কৃতিত্বও জিপিএইচ ইস্পাতের।
ইস্পাত খাতের ব্যবসা অভ্যন্তরীণ চাহিদা হিসাব করে ধাপে ধাপে কারখানা সম্প্রসারণ করছে আনোয়ার গ্রুপ। খালেদ আয়রন অ্যান্ড স্টিল মিলস লিমিটেড ২০০০ সালে পরিবর্তিত হয়ে যাত্রা করে আনোয়ার ইস্পাত লিমিটেড নামে। প্রতিষ্ঠানটির বর্তমানে এমএস রড উৎপাদনক্ষমতা বছরে তিন লাখ টন। পাশাপাশি বিলেট উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে আরো ১ লাখ ৯০ হাজার টন। বিদ্যমান সক্ষমতা আরো বাড়াতে কাজ করছে কোম্পানিটি।
বায়েজিদ স্টিল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবু বক্কর চৌধুরী বলেন, সরকারের চলমান মেগা প্রকল্পে যদি গতি ধীর হয় তবে কারখানার উৎপাদন ও বিপণন কার্যক্রমও স্লো হবে। কারণ বর্তমানে এ খাতের উৎপাদিত ইস্পাত পণ্যের ৭৫ শতাংশই সরকারিভাবে নির্মিতব্য বড় বড় প্রকল্পে ব্যবহূত হয়ে আসছে। এ মুহূর্তে দেশের অর্থনৈতিক স্বার্থকে সামনে রেখে সরকারের নেয়া সিদ্ধান্তকে নেতিবাচকভাবে দেখারও সুযোগ নেই বলে আমি মনে করি।