বিনিয়োগে স্থবিরতা, আগ্রহীরা বিনিয়োগ করছেন না

জীবন ইসলাম

বিনিয়োগে স্থবিরতা, প্রস্তাবিত প্রকল্পের কাজ আগাচ্ছে না, গ্যাস সংকটে প্রতিষ্ঠিত শিল্প টিকে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত।ব্যাংক ঋণের সুদের হার বৃদ্ধি, তারল্য সংকট, টাকার অবমূল্যায়ন ও ডলার সংকটের কারণে নতুন বিনিয়োগ হচ্ছে না বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়।

জানা গেছে, গত তিন অর্থবছরে দেশীয় উদ্যোক্তারা যেসব বিনিয়োগ প্রস্তাব করেছিল, তা বাস্তবায়নে কার্যকরি কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করছেন না। কোনো কোনো উদ্যোক্তা ভূমি উন্নয়ন ছাড়া কোনো কাজ করেননি। কেউ কেউ আবার গ্যাসের নিশ্চয়তা না পাওয়া পর্যন্ত বিনিয়োগ করতে নাজি নয়। পাশাপাশি যে অর্থ বিনিয়োগ করে প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল, সেই অর্থে এখন আর প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না বলে বিনিয়োগে স্থবিরতার সৃষ্টি হয়েছে।

সূত্র জানায়, নারায়ণগঞ্জের মেঘনাঘাটে ৪৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ পরিকল্পনা করেছিল আনলিমা মেঘনাঘাট পাওয়ার প্লান্ট লিমিটেড। গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিতে ২৬ হাজার ৩০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন বোর্ডে (বিডা) নিবন্ধন করেছিল। এটি ছিল বিডায় ২০২১-২২ অর্থবছরে নিবন্ধিত দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বিনিয়োগ প্রস্তাব। গত তিন বছরে ভূমি উন্নয়ন ছাড়া প্রকল্পের আর কোনো কাজ এগিয়ে নিতে পারেনি আনলিমা।

জানা গেছে, পর্যাপ্ত গ্যাসের সংস্থান না থাকা, ডলার সংকট এবং ‍উচ্চ সুদের কারণে প্রকল্পটি নিয়ে ‘ধীরে চলো নীতি’তে চলছে কোম্পানিটি। এ বিষয়ে আনলিমার প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. সোহাগ বলেন, ‘অর্থনৈতিক নানা সংকটের কারণে কাজের গতি এখন কম। বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে গ্যাস প্রাপ্তির নিশ্চয়তা চুক্তি হওয়ার পর যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ঋণপত্র (এলসি) খোলার উদ্যোগ নেয়া হবে।

গত তিন অর্থবছরে (২০২১-২২ থেকে ২০২৩-২৪) নতুন বিনিয়োগ প্রস্তাব নিবন্ধনের পরিমাণ কমেছে। এ বিষয়ে বিনিয়োগকারীদের ভাষ্য হলো ডলার সংকট, উচ্চ সুদহার ও বিনিয়োগ পরিবেশ সহ অন্যান্য প্রতিবন্ধকতা প্রকল্প বাস্তবায়নে  অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন নতুন বিনিয়োগ নিয়ে কেউ এগিয়ে আসতে পারছেন না।

বিডার তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ব্যক্তি খাতের স্থানীয় বিভিন্ন শিল্পে মোট ২ লাখ ৪৮ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রস্তাব ছিল। ২০২১-২২ অর্থবছরে, যার পরিমাণ ছিল ১ লাখ ২৫ হাজার ৮৬৬ কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ছিল ৮৩ হাজার ৮৫৩ কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আট মাসে বিনিয়োগ নিবন্ধিত হয় ৩৮ হাজার ৮২২ কোটি টাকার।

সূত্র জানায়, ব্যাংকে তারল্য সংকট, উচ্চ সুদহার বিনিয়োগকারীদের চাপে ফেলেছে। আবার ডলার সংকটে শিল্প খাতে মেশিনারিজ ও কাঁচামাল আমদানিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এর ধারাবাহিকতায় বিদেশী এবং স্থানীয় বিনিয়োগ দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এফবিসিসিআই) সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, ‘বিনিয়োগ পরিবেশ আরো বিনিয়োগবান্ধব করতে হবে। অর্থনৈতিক অঞ্চলে গ্যাস ও বিদ্যুতের ব্যবস্থা করতে হবে। ওয়ান স্টপ সার্ভিস নিশ্চিত করতে হবে। ঋণের সুদহারের প্রতি নজর দিতে হবে।’

২০২০ সালের এপ্রিলে ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার নির্ধারণ করা হয় ৯ শতাংশ। বিদায়ী অর্থবছরের শুরুতে সর্বোচ্চ সুদের সীমা তুলে নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তার পর থেকে প্রতি মাসেই সুদহার বাড়ছে। এপ্রিলে ঋণের সুদহার ১৩ দশমিক ৫৫ শতাংশ উঠে।  এখন অনেক ব্যাংক ঋণের সুদ ১৬-১৭ শতাংশ নির্ধারণ করেছে।

বিডায় ২০২১-২২ অর্থবছরে  বড় বিনিয়োগ প্রস্তাব ছিল বসুন্ধরা গ্রুপের। বসুন্ধরা গোল্ড রিফাইনারি লিমিটেডে ৭৫ হাজার ৭৬৬ কোটি টাকা বিনিয়োগ করার কথা। এছাড়া গ্রুপটি বসুন্ধরা স্পোর্টস কমপ্লেক্স লিমিটেডে ১২ হাজার ৮৫১ কোটি টাকা বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছিল। দুটি প্রকল্পে এই গ্রুপের ৮৮ হাজার ৬১৭ কোটি টাকার বিনিয়োগ নিবন্ধিত হয়। প্রকল্পের অগ্রগতি ও উৎপাদন শুরুর সম্ভাব্য সময় নিয়ে কোনো তথ্য দিতে পারেননি প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা।

২০২১-২২ অর্থবছরে বিডায় বিনিয়োগ প্রস্তাব দিয়েছিল সামিট গ্রুপ এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের জন্য ১০ হাজার ৭৮৬ কোটি টাকা। দৈনিক ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট সরবরাহ সক্ষমতার এ টার্মিনালটি নির্মাণ হওয়ার কথা কক্সবাজারের মহেশখালীতে। এ নিয়ে সরকারের সঙ্গে সামিটের চুক্তিও হয়েছে। এখনো প্রকল্পের মাঠ পর্যায়ের  কাজ শুরু হয়নি।

ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের আওতায় ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে ক্যান্সার হাসপাতাল নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছিল ল্যাবএইড গ্রুপ। হাসপাতাল নির্মাণে কোম্পানিটি মোট ৭৩৫ কোটি টাকা বিনিয়োগের প্রস্তাব দেয়। এর মধ্যে ঢাকায় ক্যান্সার হাসপাতালে ৫০০ কোটি টাকা এবং ছয় বিভাগে ক্যান্সার সেন্টার স্থাপনে বাকি অর্থ বিনিয়োগের পরিকল্পনা ছিল।

জানা গেছে, ক্যান্সার হাসপাতালের জন্য ভবন নির্মাণে ২০০ কোটি টাকা এবং যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ১৮০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। হাসপাতালের জন্য আরো প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানির প্রয়োজন থাকলেও ডলার সংকট ও এলসি জটিলতায় ১২০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে পারছে না। ব্যাংক থেকে টাকা পাওয়ার জটিলতায় ঢাকার বাইরে বিভাগীয় সেন্টার স্থাপন করা যাবে কিনা তা নিয়েও শঙ্কা রয়েছে।

ল্যাবএইড গ্রুপ জানায়, ‘ক্যান্সার হাসপাতালের জন্য যখন বিনিয়োগ প্রস্তাব দেওয়া হয়, তখন ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য ছিল ৮৫ টাকা। ব্যাংকের সুদহারও ছিল অনেক কম।

বিডায় ২০২১-২২ অর্থবছরে তৃতীয় শীর্ষ প্রস্তাব এসেছিল ঢাকা ফ্লাই এয়ারলাইনস লিমিটেডের। বিনিয়োগ ঘোষণা ছিল ১৭ হাজার ৯৮৬ কোটি টাকা। তালিকার অন্যান্য কোম্পানির মধ্যে উনবা পেপার ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড ৯ হাজার ৯৪১ কোটি টাকা, বেস্ট সার্ভিসেস লিমিটেড ৯ হাজার ১৭৩ কোটি টাকা, হেলথ কেয়ার ফর্মুলেশন লিমিটেড ৮ হাজার ৪১৩ কোটি ও ইকরাম ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড ৮ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রস্তাব দিয়েছিল। এ তালিকার আরেক প্রতিষ্ঠান রিমার্ক এইচবি লিমিটেডের বিনিয়োগ প্রস্তাব ছিল ১১ হাজার ৪৪৮ কোটি টাকা। যদিও প্রতিষ্ঠানটি এ বিনিয়োগ করতে পারেনি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২১ সালে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাংক থেকে মেয়াদি ঋণ পেয়েছিল ৫৪ হাজার ৬২৫ কোটি টাকা। ২০২২ সালে ৫৬ হাজার ৩৩ কোটি টাকা। এ দুই বছরে ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ছিল ৪৬ হাজার ৪১৩ কোটি এবং ৪৯ হাজার ৯৮৬ কোটি টাকা। ঋণ গ্রহীতারা সঠিক সময়ে ঋণ পরিশোধ না করায় মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণের পরিমাণ বেড়েছে। ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত মোট টার্ম লোনের মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণের পরিমাণ ছিল ৫০ হাজার ৯২৮ কোটি টাকা, যা ২০২৩ সালের জুনে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৯ হাজার ৫৯০ কোটি টাকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *