বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালু রাখা অত্যন্ত কষ্টকর হয়ে গেছে: প্রধানমন্ত্রী

স্টাফ রিপোর্টার

বিদ্যুৎ উৎপাদনের উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালু রাখা কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে জানান তিনি।

গতকাল চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) ‘শেখ কামাল আইটি বিজনেস ইনকিউবেটর’ ও ‘শেখ জামাল ডরমিটরি ও রোজী জামাল ডরমিটরি’র উদ্বোধন অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন তিনি। অনুষ্ঠানে গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হন সরকারপ্রধান। এছাড়া বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে যেকোনো অনুষ্ঠান বা প্রতিষ্ঠানে আলোকসজ্জা না করতেও প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

চুয়েটের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের মানুষের কল্যাণে যখন যা করা দরকার তা-ই করেছে আওয়ামী লীগ সরকার। আমরা বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়িয়েছি, দেশের প্রতিটি ঘরে তা পৌঁছে দিয়েছি। কিন্তু এখন রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধ, রাশিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞার কারণে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাচ্ছে, এলএনজির দাম বাড়ছে। সবকিছুর দাম এমনভাবে বেড়ে গেছে যে এখন বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালিয়ে রাখাটাই অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও কষ্টকর হয়ে গেছে।

পরিসংখ্যান তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, আগে ফার্নেস অয়েলের দাম ছিল মাত্র ৭০৮ টাকা, ইউক্রেনের যুদ্ধের পর তা হয়ে গেছে ১ হাজার ৮০ টাকা। অর্থাৎ ৫০ শতাংশ বেড়েছে। এলএনজি এমএমবিটিইউ ১০ মার্কিন ডলারে কেনা হতো, তা এখন ৩৮ মার্কিন ডলার। দাম বেড়েছে প্রায় ২৮০ শতাংশ। কয়লার দাম আগে ছিল ১৮৭ মার্কিন ডলার, তা এখন ২৭৮ মার্কিন ডলার। অর্থাৎ ৬১ শতাংশ দাম বেড়েছে। ডিজেলের লিটার ছিল ৮০ মার্কিন ডলার, এখন ১৩০-এ চলে এসেছে। শোনা যাচ্ছে, এটা নাকি ৩০০ ডলার পর্যন্ত বাড়তে পারে। অর্থাৎ এখন একটা ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে সারা বিশ্বই যাচ্ছে। আমরা ডিজেলের ওপর অনেক নির্ভরশীল। এরই মধ্যে তার দাম ২৮ শতাংশ বেড়েছে এবং প্রতিনিয়ত বাড়ছে।

রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ না হলে জ্বালানি তেল, সার, গম সরবরাহ ঠিক থাকত উল্লেখ করে সরকারপ্রধান বলেন, যদিও জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেলের উদ্যোগে আলোচনা করে খাদ্য ও সার আমদানির ব্যাপারে কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা ও সুইফট বন্ধ করার কারণে আমরা ডলার দিয়ে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে পণ্য কিনতে পারছি না। কাজেই আর্থিক ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি কেমন হবে, সে প্রশ্নের উত্তর কেউ দিতে পারছে না। ইউরোপের অবস্থা খুবই খারাপ। যদিও তারা রাশিয়ার মুদ্রা রুবল ব্যবহার করে লেনদেন করতে পারছে। বাংলাদেশের সে সুযোগও খুব সীমিত। তবু আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে, আমরা সব ধরনের চেষ্টা করে যাচ্ছি।

শেখ হাসিনা বলেন, আমরা সবার ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়েছি, এটা ঠিক। কিন্তু এ খাতে ভর্তুকি যেন আর না বাড়ে সেজন্য বর্তমানে আমাদের লোডশেডিং করতেই হবে, উৎপাদনও সীমিত রাখতে হবে। বর্তমানে বিদ্যুতে মোট ভর্তুকি দিতে হচ্ছে ২৮ হাজার কোটি টাকা। আর এলএনজি আমদানির

ক্ষেত্রে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে ২৫ হাজার কোটি টাকা। প্রতি ঘনমিটার এলএনজি কেনায় সরকারের ব্যয় হয় ৫৯ দশমিক ৬০ টাকা, কিন্তু আমরা তা গ্রাহকদের কাছে দিচ্ছিলাম মাত্র ৯ দশমিক ৬৯ টাকায়। যেটা সম্প্রতি ১১ টাকায় উন্নীত করা হয়েছে। তার পরও বিশাল অংকের ভর্তুকি রয়ে গেছে সেখানে।

প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, ফার্নেস অয়েলভিত্তিক প্রতি একক ইউনিট বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় হচ্ছে ১৭ দশমিক ৪১ টাকা, সেখানেও ভর্তুকি দিয়ে ৫ দশমিক শূন্য ৮ টাকায় গ্রাহককে দেয়া হচ্ছে। ডিজেলভিত্তিক প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় ৩৬ দশমিক ৮৫ টাকা, ভর্তুকি দিয়ে তা বিক্রি করা হচ্ছে ৫ দশমিক শূন্য ৮ টাকায়। কয়লা থেকে যে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় তা ১২ দশমিক ৩৭ টাকা, দেয়া হচ্ছে মাত্র ৫ দশমিক শূন্য ৮ টাকায়।

এ বিশাল অংকের ভর্তুকি সরকার কতক্ষণ দিতে পারবে, সে প্রশ্ন রাখেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, আমাদের তো মানুষের খাদ্য দিতে হবে, চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে, গৃহহীনদের ঘর দিতে হবে। জনগণের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমাদের নজর দিতে হবে। আমরা কৃষিতে ভর্তুকি দিচ্ছি। এবারের বাজেটেও প্রায় ৮৪ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি দিতে হবে। যুদ্ধের কারণে সব আমদানি পণ্যের দাম বেড়েছে। ভোজ্যতেলও কিনে আনতে হচ্ছে। সে কারণে আমি সবাইকে আহ্বান করেছি, প্রত্যেকে যেন নিজের সঞ্চয়ের পরিমাণ বাড়ায়। খরচের ক্ষেত্রে মিতব্যয়ী হবে এবং যতটুকু পারা যায় বিদ্যুৎ সাশ্রয় করতে হবে। বিদ্যুতের ব্যবহার কমাতে হবে।

তিনি বলেন, আমাদের এখন একটাই উপায়। আর সেটা হলো কখন কোন এলাকায় কত ঘণ্টা লোডশেডিং হবে তার একটা রুটিন তৈরি করে সেভাবে লোডশেডিং দিতে হবে, যেন মানুষ প্রস্তুত থাকতে পারে। এরই মধ্যে আমি এ নির্দেশনা দিয়েছি। আমি আশা করি, দেশবাসী আমাদের এ ব্যাপারে সহযোগিতা করবে।

অন্যদিকে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে সামাজিক অনুষ্ঠান, কমিউনিটি সেন্টার ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে আলোকসজ্জা না করার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল প্রধানমন্ত্রীর প্রেস উইং থেকে পাঠানো এক বার্তায় বলা হয়, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং যুক্তরাষ্ট্র-ইউরোপের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার বাস্তবতায় বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের লক্ষ্যে বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান, কমিউনিটি সেন্টার, বিপণিবিতান, দোকানপাট, অফিস-আদালত ও বাড়িঘরে আলোকসজ্জা না করার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

ডিজিটাল মার্কেটের বিকাশে সরকার হাই-টেক পার্ক স্থাপন করছে

গতকাল আইসিটি বিভাগের সম্মেলন কক্ষে ‘বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের বোর্ড অব গভর্নরস’-এর দ্বিতীয় সভায় গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নিজের বক্তব্যে তিনি বলেন, আমরা ডিজিটাল অর্থনীতির বিকাশের লক্ষ্যে হাই-টেক পার্ক স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এ সিদ্ধান্তের পেছনে ছিলেন সজীব ওয়াজেদ জয়।

শেখ হাসিনা বলেন, সারা দেশে ৯২টি হাই-টেক পার্ক বা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক কিংবা আইটি ট্রেনিং অ্যান্ড ইনকিউবেশন সেন্টার স্থাপন করা হচ্ছে। এরই মধ্যে নয়টি পার্ক স্থাপনের কাজ সমাপ্ত হয়েছে। এখানে হার্ডওয়্যার-সফটওয়্যার নিয়ে কাজ করার জন্য ট্যাক্স মওকুফ, কাস্টম ডিউটি মওকুফসহ ১৪টি প্রণোদনা সুবিধা দেয়া হচ্ছে। হাই-টেক পার্কগুলোয় বেসরকারি উদ্যোগে ২০২১ সাল নাগাদ ৫৭০ কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে। ২০২৫ সালের মধ্যে প্রতিষ্ঠানগুলোয় প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হবে বলে আমি আশা করি। গার্মেন্টপণ্যের মতো আমাদের ডিজিটাল ডিভাইসগুলো ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ট্যাগ নিয়েই রফতানি হবে, সে লক্ষ্যেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি।

গত ১৩ বছরের ডিজিটাল বাজার থেকে আয়ের চিত্র তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৩ বছর আগে ডিজিটাল অর্থনীতির আকার ছিল মাত্র ২৬ মিলিয়ন ডলার। আর বর্তমানে তা ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। ২০২৫ সালে আইসিটি পণ্য রফতানি ৫ বিলিয়ন ডলার ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির মাধ্যমে আইসিটি খাতে কর্মসংস্থান ৩০ লাখে উন্নীত করার লক্ষ্য আমরা নির্ধারণ করেছি।

শেখ হাসিনা বলেন, এ লক্ষ্য নিয়েই আইসিটি অবকাঠামো গড়ে তোলার পাশাপাশি দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলার লক্ষ্যে সরকার কাজ করছে। আমাদের তরুণ প্রজন্মের মেধা বিকাশ ও উদ্ভাবনী শক্তি কাজে লাগানোর সুযোগ করে দেয়া হবে। কেননা তরুণ প্রজন্মের সুপ্ত প্রতিভা কাজে লাগানোর মাধ্যমেই দেশ এগিয়ে যেতে পারে, তাই আওয়ামী লীগ সরকার নানা পদক্ষেপও নিয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *