বিদেশিদের মাথায় বগুড়ার টুপি

স্টাফ রিপোর্টার

বৈশ্বিক মহামারি করোনার প্রভাব কেটে যাওয়ায় দুই বছর পর কর্মচাঞ্চল্য ফিরেছে বগুড়ার শেরপুরের টুপি পল্লীতে। রমজানের ঈদকে সামনে রেখে বাহারি ডিজাইনের টুপি তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিশেষ করে গ্রাম্যবধূদের নিপুণ হাতের ছোঁয়া আর সুতা ও ক্রুশ কাটার বন্ধনে তৈরি হচ্ছে রং-বেরংয়ের রকমারি টুপি।

এই উপজেলার তৈরি টুপি বিশ্বমানের। তাই দেশের চাহিদা মিটিয়ে এসব টুপি সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে। যা থেকে আয় হচ্ছে কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা। সেইসঙ্গে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত গ্রামের অর্ধলাখ মানুষের ভাগ্যের চাকাও ঘুরতে শুরু করেছে।

জানা যায়, প্রায় বিশ বছর আগে শেরপুর উপজেলার কল্যাণী গ্রামের গ্রাম্যবধূরা টুপি বুনোনের কাজ শুরু করেন। এরপর থেকে তা আস্তে আস্তে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। বিগত ১৫ বছরের ব্যবধানে টুপি তৈরিতে অনেকটা বিপ্লব ঘটে গেছে। বর্তমানে উপজেলার প্রায় শতাধিক গ্রামে কমবেশি বাণিজ্যিকভাবে টুপি তৈরির কাজ চলছে। এরমধ্যে জয়লা-জুয়ান, জয়লা-আলাদি, কল্যাণী, চক-কল্যাণী, চকধূলি গুয়াগাছী, বিনোদপুর, মির্জাপুর, খানপুর, খানপুর দহপাড়া, শেরুয়া, শেরুয়া বটতলা, হামছায়াপুর, কাঁঠালতলা, ভিমজানি গ্রাম অন্যতম। বছরের ১১ মাসই এই পেশার সঙ্গে অন্তত অর্ধলাখ মানুষ প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে যুক্ত থাকেন। যাদের মধ্যে বেশিরভাগই নারী।

তবে প্রত্যেক রমজানে এই সংখ্যা বেড়ে যায়। এসব গ্রামে সুতাসহ টুপি তৈরির সব ধরনের উপকরণ পৌঁছানোর জন্য তিন শতাধিক মাঠকর্মী কাজ করেন। টুপি তৈরি শেষ হলে তারা বাড়ি বাড়ি যান এবং সুতার দাম বাদ রেখে পাইকারি বাজারদর অনুযায়ী টুপিগুলো ক্রয় করেন। এই শিল্পে কোনো টাকা বিনিয়োগ করতে হয় না। যা করার সবই মহাজনের পক্ষ থেকে করা হয়।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, স্কুলপড়ুয়া থেকে শুরু করে গৃহবধূ কোনো নারী বসে নেই। সবাই টুপি তৈরিতে ব্যস্ত। কারণ মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রধান উৎসব ঈদুল ফিতরের সময় দ্রুত ঘনিয়ে আসছে। সেই দিনটি ঘিরে সবাই ব্যস্ত টুপি বুনোনের কর্মযজ্ঞে। ঘরের কাজ করেই তারা ছুটছেন টুপি তৈরির কাজে। ছায়াঘেরা পরিবেশে বসে মেতে ওঠেন নানা সুখ-দুঃখের আলাপচারিতায়। জমানো আসরে গল্পের গল্পের তালে তালে চলে টুপি বুনোনের কাজ।

মরিয়ম, শিল্পী খাতুন, কুলসুম বিবি, শিরিন আকতার এই দলের নিপুণ শিল্পী। গল্পের ফাঁকে ফাঁকে কী যেন করছিলেন। এগিয়ে যেতেই নজরে এলো সেই সুতা আর ক্রুশ কাটা। এসব নারীদের কারিগরি নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় তৈরি হচ্ছে বাহারি ডিজাইনের টুপি।

তারা জানান, অনেক ছোট থেকেই টুপি তৈরির পেশায় তারা যুক্ত। বাড়িতে কর্মহীন হয়ে বসে থাকার চেয়ে কিছু একটা করা ভালো। এমন ভাবনা এবং বংশীয় ঐতিহ্যকে ধারণ করতে অনেকেই টুপি তৈরির শিল্পের সঙ্গে নিজেদেরকে জড়িয়ে ফেলেছেন।

গৃহবধূ লিলিমা আক্তার, ছাবিনা খাতুন বলেন, গ্রামের স্কুলপড়য়া ছোট ছোট মেয়েরা লেখাপড়ার পাশাপাশি টুপি তৈরি করে থাকে। এছাড়া গ্রামের গৃহবধূরা সাংসারিক কাজের ফাঁকে ফাঁকে টুপি বানিয়ে থাকেন। তা থেকে আয়ও মন্দ হয় না। বিশেষ করে প্রতি বছর রমজান মাসে গ্রামে গ্রামে টুপি তৈরির হিড়িক পড়ে যায়।

তারা জানান, বিভিন্ন এলাকার ব্যাপারীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে সুতা দিয়ে থাকেন। পরে সুতার দাম কেটে রেখে অবশিষ্ট টাকা দিয়ে টুপি কেনেন।

বগুড়া জেলা হস্ত কুঠির শিল্প উন্নয়ন সমিতির সভাপতি মেসার্স জুয়েল ক্যাপ ডিপোর সত্ত্বাধিকারী জুয়েল আকন্দ জানান, বগুড়া সদর উপজেলা, শেরপুর, ধুনট, কাজীপুর, রায়গঞ্জ, সারিয়াকান্দি, শিবগঞ্জ, শাজাহানপুর উপজেলায় বাহারি ডিজাইনের জালি টুপি তৈরি করা হয়। তবে শেরপুর উপজেলায় সবচেয়ে বেশি টুপি তৈরি হয়ে থাকে। যা আবার বিভিন্ন নামে পরিচিত। এরমধ্যে তাহফিজ, মাকড়শা, বিস্কুট, পাঁচ পয়সা, কদমফুল, মাছের কাটা, দশফুল, আনারস ডিজাইনের জালি টুপি উল্লেখযোগ্য। তাহফিজ নামে জালি টুপির কদর এবার সবচেয়ে বেশি।

তিনি জানান, করোনার কারণে বিগত দুই বছর ব্যবসায় স্থবিরতা ছিল। তবে সেটি ইতোমধ্যে কেটে যেতে শুরু করেছে।

হস্ত কুটির শিল্প উন্নয়ন সমিতির এই নেতা বলেন, দেশীয় টুপি নিতে দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তের ব্যবসায়ীরা অগ্রীম অর্ডার দিয়ে থাকেন। সেই অনুযায়ী তিনি নারীদের পারিশ্রমিক দিয়ে টুপি তৈরি করে নেন। পরে এসব বাহারি ডিজাইনের টুপি সৌদি আরব, দুবাই, কাতার, মালয়েশিয়া, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, নেপালসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়। আবার আরব রাষ্ট্রের একাধিক ব্যবসায়ীর মাধ্যমে এসব টুপি মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন রাষ্ট্রে রপ্তানি হয়।

জুয়েল আকন্দ বলেন, তিনি ছাড়াও বেশ কয়েকজন বড় ব্যবসায়ী প্রত্যেক বছর ঈদের কমপক্ষে দুই মাস আগ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা এই শিল্পে বিনিয়োগ করেন। করোনার প্রভাব কেটে যাওয়ায় এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। ওইসব ব্যবসায়ীদের অর্ডার অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সংখ্যক মাঠকর্মী নামানো হয়েছে। এসব মাঠকর্মীরা প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল থেকে টুপি ক্রয় করে আনেন। সেই টুপি তার কাছে অথবা ঢাকার বড় বড় ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করেন। পরে তা দেশের বাইরে চলে যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *