বাড়তি আয় থাকতেও গ্যাসের দাম বাড়াতে চায় পেট্রোবাংলা

স্টাফ রিপোর্টার

গ্যাসের দাম ফের বাড়ানোর প্রস্তাব করেছিল পেট্রোবাংলা এবং গ্যাস বিতরণ ও সঞ্চালন কোম্পানিগুলো। তবে বর্তমানে সরকার এ খাতে যে হারে ভর্তুকি দিচ্ছে তা বহাল রাখলে গ্যাসের দাম বাড়ানো দরকার নেই বলে মনে করে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) কারিগরি কমিটি। বরং সরকারের দেওয়া ভর্তুকি থেকে পেট্রোবাংলার হাতে যে অতিরিক্ত আয় রয়ে গেছে, তা ব্যয় করলে নতুন করে ভর্তুকি ছাড়াই গ্যাসের দাম কমবে। যদিও সরকার ভর্তুকি তুলে নিলে গ্যাসের দাম বাড়বে এমন হিসাব দেখিয়েই দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে প্রতিষ্ঠানটি। বিইআরসি আয়োজিত গণশুনানিতে এমনটাই তুলে ধরা হয়েছে।

সোমবার (২১ মার্চ) রাজধানীর বিয়াম ফাউন্ডেশন মিলনায়তনে এ শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। এতে নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষে কারিগরি কমিটি পেট্রোবাংলার প্রস্তাবনার বিশ্লেষণ করে। এসময় উপস্থিত ছিলেন, কমিশনের চেয়ারম্যান আব্দুল জলিল, সদস্য মকবুল ই ইলাহী চৌধুরী, বজলুর রহমান, মোহাম্মদ আবু ফারুক। এছাড়া পেট্রোবাংলার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও শুনানিতে মতামত দিতে বিইআরসির আমন্ত্রিত অতিথিরা উপস্থিত ছিলেন।

শুনানিতে দেখানো হয়, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) পেট্রোবাংলা সরবরাহকৃত প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ছিল ১২ টাকা ৫০ পয়সা। গ্রাহক পর্যায়ে সরকারের ভর্তুকিসহ যা দাঁড়িয়েছে ৯ টাকা ৩৬ পয়সায়। পেট্রোবাংলা নিজেদের দাম বাড়িয়ে ১৫ টাকা ৩০ পয়সা করার প্রস্তাব দেয়। তবে বিইআরসির কারিগরি কমিটি বিশ্লেষণ করে দেখায়, চলতি অর্থবছর পেট্রোবাংলার গ্যাসের দাম পড়বে ১২ টাকা ৪৭ পয়সা। অর্থাৎ তিন পয়সা সাশ্রয় হবে, যেখানে তারা তিন পয়সা বেশি দামেই বিক্রি করেছে। যদি ভর্তুকি চলমান থাকে তবে গ্রাহক পর্যায়ে দাম বাড়ার সুযোগ নেই।

কারিগরি মূল্যায়ন টিমের ফাইন্ডিংসে এলএনজি আমদানি বাবদ পেট্রোবাংলার ব্যয় ও অতিরিক্ত আয়ের বিবরণে বলা হয়, ২০২০-২১ অর্থবছরে সরকার এলএনজি আমদানি বাবদ পেট্রোবাংলাকে ভর্তুকি দিয়েছে ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। ২০১৮ সাল থেকে ২০২১ সালের জনু পর্যন্ত পাওয়া ভর্তুকিতে খরচ থেকেও পেট্রোবাংলার হাতে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা রয়ে গেছে। অর্থাৎ আগের বছরের তুলনায় বরং ১০০ কোটি টাকা এবছর অতিরিক্ত আয় রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির কাছে। অর্থাৎ, এবছর সরকার নতুন করে ভর্তুকি না দিলেও আরও ১০০ কোটি টাকা বাড়তি ব্যয়ের সক্ষমতা থাকছে পেট্রোবাংলার হাতে। একইসঙ্গে পেট্রোবাংলার মোট আমদানি করা এলএনজি ও দেশীয় উৎপাদিত গ্যাসে কারিগরি কমিটি মোট ব্যয় ধরেছে ৩৮ হাজার ৯৪৮ কোটি টাকা। সমপরিমাণ আয় করতে হলে পেট্রোবাংলাকে প্রতি ইউনিট গ্যাস বিক্রি করতে হবে ১২ টাকা ৪৭ পয়সায়। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি চলতি অর্থবছরের ছয় মাসে ভর্তুকিসহ তিন পয়সা বেশি লাভে ১২ টাকায় ৫০ পয়সায় বিক্রি করছে।

এদিকে, পেট্রোবাংলার প্রস্তাবকে অসম্পূর্ণ ঘোষণা দিয়ে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাবে আপত্তি জানিয়েছেন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম। ক্যাবের পক্ষ থেকে প্রস্তাবনার মূল্যায়ন ও ভোক্তার পক্ষে তিনি বেশকিছু সুপারিশ উত্থাপন করেন। সুপারিশগুলো হলো-
১. গ্যাসের বিদ্যমান মূল্যহার বহাল রেখে সব পর্যায়ের ট্যাক্স-ভ্যাট, অযৌক্তিক (লুণ্ঠনমূলক) ব্যয় কমিয়ে গ্যাসে আর্থিক ঘাটতি কমানোর সুপারিশ।
২. গ্যাস চুরি ও পরিমাপে কারচুপি এবং অস্বাভাবিক ব্যয়ে চাহিদার অতিরিক্ত সম্পদ অর্জনের মাধ্যমে ভোক্তাদের কাছ থেকে অর্থ লুণ্ঠন হচ্ছে। তার জন্য সরকারি প্রতিষ্ঠান পেট্রোবাংলাসহ গ্যাস সরবরাহে নিয়োজিত সব কোম্পানির নিজ নিজ পরিচালনা বোর্ডকে অভিযুক্ত করা হলো। এ অভিযোগ নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত মুনাফা মার্জিন রহিত করে ব্রেক-ইভেন্টে চলার প্রস্তাব করা হলো।
৩. গ্যাস খাতে সুশাসন নিশ্চিতের লক্ষ্যে সুপারিশ প্রণয়নের জন্য অংশীজনদের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন কমিশন গঠন করার প্রস্তাব করা হলো।
৪. এর আগে গ্যাসের দাম বাড়ানোর বিইআরসির আদেশাবলি পালন না করার দায়ে এবং গ্যাস খাত বিপর্যস্ত করার জন্য দায়ী সংশ্লিষ্ট লাইসেন্সধারীদের বিরুদ্ধে বিইআরসি আইনের ৪৩ ধারা এবং ৪৬ ধারায় ব্যবস্থা নেওয়ার প্রস্তাব করা হলো।
৫. গ্যাস সেবাকে স্বার্থ সংঘাত মুক্ত করার লক্ষ্যে, সেবা দেওয়া লাইসেন্সধারীদের পরিচালনা বোর্ডকে আমলা মুক্ত করার প্রস্তাব করা হলো।

শুনানিতে সুপারিশ উল্লেখ ও প্রস্তাবনার বিষয়ে মূল্যায়ন ও অসামঞ্জস্যতা তুলে ধরেন ক্যাব সভাপতি। তিনি বলেন, পেট্রোবাংলার আয়-ব্যয় ও প্রস্তাবনার সামঞ্জস্যতা বজায় রাখতে ক্যাবের পক্ষ থেকে বেশকিছু আপত্তি ও চাহিদা জানানো হলে সেগুলোও উত্থাপন করতে শুনানির দিন ব্যর্থ হয় প্রতিষ্ঠানটি। তাই গ্যাসের দাম বাড়ানোর বিষয়ে আপত্তি জানানো হচ্ছে।

তবে মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিইআরসি অমানবিক হবে না জানিয়ে বিইআরসি চেয়ারম্যান আব্দুল জলিল বলেন, কমিশন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ক্ষেত্রে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নেবে। এবার মূল্য নির্ধারণে অবিবেচক হবে না কমিশন। মূল্যহার নির্ধারণে সুবিবেচনা ও সুনির্দিষ্ট ভারসাম্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে। বাস্তবতার নিরিখে হবে ঘোষণা। কোনো অমানবিক সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *