বাপ-দাদার পেশা তাই আঁকড়ে আছি `তাঁতে ‘দুর্দিন’

স্টাফ রিপোর্টার

তিন দশক আগেও রাজবাড়ী সদরের তাঁতিপাড়া গ্রামে ছয় থেকে সাত শতাধিক তাঁত ছিলো। বর্তমানে টিকে আছে ১৫টি।

উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় লোকসানের মুখে পড়েছেন রাজবাড়ীর তাঁতশিল্পীরা। একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তাঁত। অনেকেই এ পেশা ছেড়েছেন। বাপ-দাদার পেশা বলে কেউ কেউ ধরে রেখেছেন।

তাদের মধ্যে একজন সদর উপজেলার রামকান্তপুর ইউনিয়নের তাঁতিপাড়া গ্রামের মজিবর রহমান মুন্সি। বাপ-দাদার এ পেশা ছাড়তে না পারলেও লোকসান ঠিকই গুণতে হচ্ছে তাকে।

সত্তরোর্ধ্ব এ তাঁতশিল্পী ভারাক্রান্ত গলায় বলেন, “১৯৯০ সাল পর্যন্ত তাঁতের তৈরি পণ্য তৈরি করে পরিবার-পরিজন নিয়ে ভালোই চলতে পেরেছি। নব্বই দশকের পর থেকে রং, সুতার দাম বাড়তে থাকে। এখন অনেকেই এই পেশা ছেড়ে দিয়েছে। কেউ ভ্যান চালায়, কেউ অন্য ব্যবসা করছে,কেউ বিদেশ গেছে। বাপ-দাদার পেশা তাই ধরে রেখেছি।”

তিনি জানান, ১৯৪৬ সাল থেকে রামকান্তপুর ইউনিয়নে তাঁত শিল্পের শুরু। এ সময় তাঁতের তৈরি গামছা, লুঙ্গি, শাড়ির প্রচুর চাহিদা ছিলো। এই তাঁত শিল্পের ওপর নির্ভর করে খেয়ে-পড়ে ভালোই চলতো কারিগরদের সংসার। তিন দশক আগেও এই গ্রামে ছয় থেকে সাত শতাধিক তাঁত ছিলো। গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই ছিলো তাঁত।

মজিবর বলেন, “বর্তমানে টিকে আছে ১৫টি। ক্রমাগত লোকসান, প্রয়োজনীয় পুঁজি আর দফায় দফায় কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধির কারণে একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তাঁত।”

মজিবরের তাঁত কারখানা ঘুরে দেখা যায়, দুই চালা টিনের তৈরি ঘরে পাঁচটি তাঁত রয়েছে। তিনজন শ্রমিক ভোর থেকেই খটখট শব্দে গামছা, লুঙ্গি তৈরি করছেন। একজন চরকার সাহায্যে সুতা ছাড়িয়ে তাঁতে দিচ্ছেন। আরেকজন মাটির পাত্রের মধ্যে এরারুটের আঠা দিয়ে সুতা ভিজিয়ে রোদে শুকাতে দিচ্ছেন।

তাঁত কারিগর মো. আজাহার মিয়া বলেন, তিনি ৩০ বছর ধরে বিভিন্ন কারখানায় কাজ করছেন। বর্তমানে এই পেশায় থেকে যে আয় হয় তা দিয়ে সংসার চলে না। সারাদিন কাজ করে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা আয় হয়। এ দিয়ে সংসার চালানো কঠিন।

আরেক কারিগর মো. আবজাল হোসেন বলেন, দুই দশক আগেও ছয় থেকে সাতশ টাকায় এক বেল্ট সুতা পাওয়া যেত। এক দশক আগে দাম ছিলো এক হাজার টাকা। কিন্তু বর্তমানে সেই সুতা কিনতে হয় আড়াই থেকে তিন হাজার টাকায়। রংয়ের দাম বেড়েছে। কিন্তু সেই অনুপাতে গামছা, লুঙ্গির দাম বাড়েনি।

তাঁত মালিক মজিবর রহমান বলেন, “২০১০ সালে সাধারণ মানের চারটি লুঙ্গি গড়ে ৫০০ টাকায় বিক্রি হতো। বর্তমানে বিক্রি হয় এক হাজার টাকায়। ওই সময় চার পিস লুঙ্গিতে ৩০ থেকে ৪০ টাকা করে লাভ থাকতো। আর বর্তমানে লাভ থাকে ১০ থেকে ২০ টাকা। আর গামছাও বিভিন্ন প্রকারের আছে; আকার ভেদে বিক্রি হয়ে থাকে।

এক দশক আগে প্রতি পিস গামছা ৫০ থেকে ২০০ টাকায় বিক্রি হতো। বর্তমানে সেই গামছা বিক্রি হয় ১০০ থেকে ৩০০ টাকায়। সেসময় চারটি গামছায় ৩০ থেকে ৪০ টাকা করে লাভ থাকতো। আর বর্তমানে লাভ থাকে ১০ থেকে ২০ টাকা।”

এই শিল্পটাকে টিকিয়ে রাখতে সরকারের নজর দেওয়া উচিৎ বলে মনে করেন এই তাঁত মালিক।

রাজবাড়ী জেলা পরিসংখ্যান ব্যুরো কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলম জানান, ২০১৮ সালের তাঁতশুমারি অনুযায়ী, জেলায় তাঁতীর সংখ্যা তিন হাজার ৪৮৮ জন। তাঁত প্রতিষ্ঠান আছে এক হাজার ২৬৬টি। তাঁতকল আছে দুই হাজার ২১৫টি। সচল তাঁতকল আছে এক হাজার ৫০৮টি,অচল ৭০৭টি।

জেলায় তাঁতি পরিবার কমছে কি-না এমন প্রশ্নে রাজবাড়ীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো. মাহাবুর রহমান শেখ বলেন, বিষয়টি তার জানা নেই। এ বিষয়ে স্ব স্ব উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তারা বলতে পারবেন।

সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মার্জিয়া সুলতানা বলেন, এই উপজেলায় তাঁতীর সংখা কমছে কি-না সেটা জানা নেই। তবে তিনি খুব দ্রুত রামকান্তপুর ইউনিয়নের তাঁতীপাড়া পরিদর্শনে যাবেন।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুঠির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) রাজবাড়ীর সহকারী মহাব্যবস্থাপক চয়ন বিশ্বাস বলেন, “বিসিক কুটির শিল্প উন্নয়নে ১৯৫৭ সাল থেকে কাজ করে যাচ্ছে। শুধু তাঁত শিল্প না, অন্যান্য শিল্পের ক্ষেত্রেও আমরা বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে থাকি। এ ছাড়া তাঁতিদের আর্থিকভাবেও সহযোগিতা করতে পারি। যদি তারা উপযুক্ত কাজগপত্র নিয়ে আমাদের কাছে আসেন।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *