বাণিজ্য সুবিধা বহাল থাকবে বাংলাদেশের
স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার সময় প্রতিটি দেশের জন্য সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় বাণিজ্যিক সুবিধা হারানো। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ চূড়ান্তভাবে পৌঁছাবে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে। জাতিসংঘের সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়ার পর থেকে চলছে পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার কৌশল। বিশ্ব বাণিজ্য সুবিধার ক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে রয়েছে চুক্তি। তবে স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হলেও বিশ্বে বাংলাদেশের বিশেষ বাণিজ্যিক সুবিধা অব্যাহত থাকবে বলেই প্রত্যাশা সংশ্লিষ্টদের।
অর্থনীতিবিদ ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশের সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ইবিএ (অস্ত্র বাদে সব) চুক্তি আছে। এই চুক্তির আওতায় ২০২৯ সাল পর্যন্ত সব সুবিধা অব্যাহত থাকবে। অস্ত্র বাদে সব পণ্যে অব্যাহত থাকবে শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) বাজার সুবিধা নীতির আলোকে বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত দেশগুলো (এলডিসি) ইইউতে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারমূলক বাজার (জিএসপি) সুবিধা পায়।
২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জন ও ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হবে বাংলাদেশ। তখন জিএসপি প্লাস সুবিধা মিলবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) বাজারে। তাই এলডিসি থেকে উত্তরণের ফলে উদ্বেগের কিছু নেই বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের।
উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তরের পথে শুল্ক সুবিধাবঞ্চিত হলে বাংলাদেশকে মাশুল হিসেবে ২৩ হাজার কোটি টাকার বেশি বাড়তি খরচ করতে হবে। বাংলাদেশ এসব মাশুল থেকে বাঁচতে নানা ধরনের পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে। এলডিসি গ্রাজ্যুয়েশনের পরও যাতে ইইউ, ভারত, চীন, কানাডা ও জাপানের সঙ্গে ১২ বছর বাণিজ্যিক সুবিধা অব্যাহত থাকে সেজন্য চুক্তি করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ১২ বছর না হলেও এসব বাজারে বর্তমান সুবিধা আরও অন্তত ৯ বছর টেনে নেওয়া যাবে বলে আশা প্রকাশ করছেন অর্থনীতিবিদরা।
যেসব সুবিধা অব্যাহত থাকবে
ইনহ্যান্স ইন্ট্রিগ্রেটি ফ্রেমওয়ার্কের আওতায় ২০২৬ সালের পর আরও পাঁচ বছর বাণিজ্য সুবিধা পাবে বাংলাদেশ। প্রধান উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে বাণিজ্য সংক্রান্ত নানা সুবিধা পাবে প্রকল্পের আওতায়। ইউএন ক্যাপিটাল ডেভেলপমেন্ট ফান্ড চুক্তির আওতায়ও বাংলাদেশ ২০২৬ সালের পর আরও পাঁচ বছর বাণিজ্য সুবিধা পাবে।
এছাড়া লিস্ট ডেভেলপ কান্ট্রিস ফান্ড চুক্তির আওতায় জলবায়ু সংক্রান্ত প্রকল্পগুলো অনুমোদনের ক্ষেত্রে আগের মতো সুবিধা, ইউএন টেকনোলজি ব্যাংক ফর এলডিসি চুক্তির আওতায় আইসিটি ও নলেজ শেয়ারিংয়ের ক্ষেত্রে বর্তমান সুবিধা মিলবে আরও পাঁচ বছর, ইউএন ট্রাভেল সাপোর্ট চুক্তির আওতায় বর্তমান সুবিধা তিন বছর অব্যাহত থাকবে। চুক্তির আওতায় জাতিসংঘের সংস্থাগুলো থেকে ট্রাভেল সাপোর্ট ফান্ডও পাবে বাংলাদেশ। ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ল’ অর্গানাইজেশন চুক্তির সুবিধা মিলবে পাঁচ বছর। এলডিসিভুক্ত সরকারগুলোর কাছ থেকে প্রফেশনাল সব সুযোগ-সুবিধা মিলবে এই চুক্তির আওতায়। তারপরও এসব চুক্তির পাশাপাশি নিজেদের আরও দক্ষ করে তোলায় মত দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।
স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তর ও বৈশ্বিক বাণিজ্য সুবিধা পাওয়া নিয়ে সরকারের পলিসির সঙ্গে দীর্ঘদিন সম্পৃক্ত শরিফা খান। এলডিসি নিয়ে সুবিধা-অসুবিধা প্রসঙ্গে শরিফা খান বলেন, আমি শুরু থেকেই বিষয়টি নিয়ে কাজ করছি। সবাই যতটা নেগেটিভ বলুক না কেন ততটা নেগেটিভ হবে না। ২০০৫ সাল থেকে সবাই বলছেন সবকিছু উঠে যাবে, কিন্তু ওঠেনি। বিভিন্ন পকেটে আমরা সুবিধা পাবো। এর ভালো দিক অনেক বেশি।
‘তবে শিল্প-কারখানার মালিকদের কাজ করতে হবে। তাদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে আলাদা ডাইমেনশনে কাজ করতে হবে। আর কতদিন তারা অন্যের হাত ধরে চলবে। সারাজীবন তো সাপোর্ট থাকবে না। তাই ডিফারেন্ট ডাইমেনশনের জন্য একটা ধাক্কা দরকার, আমার মনে হয় সেই ধাক্কা এখন লাগবে। এখন যদি দাঁড়াতে না পারে তবে কবে দাঁড়াবে।’
তিনি বলেন, এলডিসি থেকে বের হলেও সুবিধা থাকবে ইবিএ চুক্তির মাধ্যমে। ইউরোপের বাজারে জিএসপি সুবিধা আছে। ২০৩১ সালে যখন আমরা আপার মিডল ইনকাম কান্ট্রি হবো তখন জিএসপি প্লাস সুবিধা পাবো, এটা একটা ভালো দিক। এলডিসিভুক্ত দেশে থাকলেও কিন্তু আমরা যুক্তরাষ্ট্র থেকে কোনো সুবিধা পাই না। সুতরাং এটা নিয়ে উদ্বেগের কিছু নেই।
‘গ্লোবাল বাজার সম্প্রসারণ হচ্ছে। প্রাইভেট সেক্টরও বুঝে গেছে তাদের নিজের ক্যাপাসিটি গ্রো করতে হবে। আমি মনে করি এলডিসি আমাদের আরও বেশি করে ঘুরে দাঁড়ানো ও সক্ষমতা বাড়ানোর সোপান। এলডিসি থেকে উত্তরণে ক্রমান্বয়ে কিছু বাজার হারানো কিছু বাজারে সুবিধা পাবো। ইউরোপের বাজারে ১২ বছরের সুবিধা পেতে লবিং করছি, না হলেও ৯ বছর পাবো। এলডিসি থেকে উত্তরণে বাংলাদেশের ইমেজ আরও উন্নত হয়েছে। ফলে বিনিয়োগ সুবিধা পাবে।’
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এলডিসি থেকে উত্তরণের পর বাজার সুবিধা হারানো, স্বল্প সুদে ঋণপ্রাপ্তিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুযোগ হাতছাড়া হতে পারে। চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে তিনটি বিষয়ে। এগুলো হলো- বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও পরিবহন অবকাঠামো। উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হলে আগের মতো সহজ শর্তে বৈদেশিক ঋণ ও সাহায্য পাবে না বাংলাদেশ। আগের মতো রেয়াতি সুদে ঋণ পাবে না। বাংলাদেশকে ক্রমান্বয়ে একটি মিশ্র অর্থায়নে যেতে হবে, যেখানে উচ্চসুদে বৈদেশিক ঋণ নিতে হবে। বিশ্বব্যাংকের অঙ্গভুক্ত প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (আইডিএ) বাংলাদেশকে স্বল্পসুদে ঋণ দেয়। এই সুবিধা ২০২৬ সাল পর্যন্ত মিলবে। তারপরও এলডিসি থেকে বের হওয়ার ফলে চীনের নেতৃত্বাধীন এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংকের (এআইআইবি) মতো নতুন নতুন উন্নয়ন সহযোগী বাংলাদেশে আসছে বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের বিশ্বব্যাংক উইংয়ের প্রধান (অতিরিক্ত সচিব) আবদুল বাকী জাগো নিউজকে বলেন, এলডিসি গ্রাজ্যুয়েশনের ফলে কিছু অসুবিধা যেমন আছে তেমন সুবিধাও আছে। আমাদের সক্ষমতা বেড়েছে আগের তুলনায়। এখনই আমরা চড়া সুদে ঋণ নিচ্ছি। এছাড়া নতুন নতুন উন্নয়ন সহযোগীও আমাদের কাছে আসছে। বিশ্বে বাংলাদেশের সুনামও বেড়েছে।
সূত্র জানায়, খাতভিত্তিক প্রয়োজনীয় বাণিজ্য সুবিধা ন্যূনতম ২০৩৫ সাল পর্যন্ত বহাল রাখার বিষয়ে কাজ করছে বাংলাদেশ। ২০২৬ সালের পর ছয় বছর পুরোপুরি শুল্ক সুবিধা ও তার পরের তিন বছর পর্যালোচনার মাধ্যমে ধীরে ধীরে শুল্ক সুবিধা বহাল রাখতে হবে। কৃষি ও মৎস্যখাতের ভর্তুকি কীভাবে বহাল রাখা যায়, সে বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করছে বাংলাদেশ। পাশাপাশি তৈরি পোশাক খাতের বর্তমানের রপ্তানি যেভাবে চলছে, সেটি বজায় রেখে আরও বাড়তি সুবিধা কীভাবে আদায় করা যায় সেটি নিয়ে পরিকল্পনা চলমান।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এশিয়ার সঙ্গে আমাদের বাণিজ্যিক সুবিধা সেভাবে হয়নি। বাংলাদেশ ট্রেড সুবিধা নিতে পারেনি। ভারত ও চীনের সঙ্গে ট্রেড সুবিধা নিতে পারলে দূরে তাকাতে হবে না। ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়াতে হবে। সেক্ষেত্রে নৌপথ ও স্থলবন্দরের আরও উন্নয়ন করতে হবে। আমরা দেখি স্থলবন্দরে ট্রাকগুলো ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকে। এ বিষয়গুলো দ্রুত নিরসন করতে হবে। চীন ও ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়াতে হবে। সড়ক ও পরিবহনে আরও নজর দিতে হবে। রিজিওনাল কানেক্টিভিটি বাড়াতে হবে। এসব দেশকে ট্রান্সপোর্ট নেটওয়ার্কের মধ্যে আনতে হবে। আমরা আজীবন সুবিধা পাবো না- এ কথা মাথায় রেখে আমাদের সক্ষমতা বাড়াতে হবে।
তিনি আরও বলেন, ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চলে এক কোটি কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। প্রতি বছর ১০ শতাংশ হারে মাথাপিছু আয় বাড়াতে হবে। এলডিসি গ্রাজ্যুয়েশন একটা মাইলস্টোন। এটাকে ডেস্টিনেশন ভেবে বসে থাকলে চলবে না।
জাতিসংঘের মানদণ্ড অনুযায়ী স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার জন্য তিনটি সূচকে এরই মধ্যে উন্নীত হয়েছে বাংলাদেশ। সে হিসেবে ২০২৪ সালের মধ্যেই স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে প্রবেশ করার সময়সীমা ছিল। বাংলাদেশের অনুরোধে তা ২০২৬ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য সম্প্রসারণ করতে পারলে ইউরোপ-যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশ বেশি সুবিধা নিতে পারে বলে দাবি অর্থনীতিবিদদের।