‘বঙ্গা’ বিক্রি হয় বছরে ৫০ কোটি টাকা

স্টাফ রিপোর্টার

বছরে প্রায় দুই হাজার ধান মাড়াই মেশিন তৈরি হচ্ছে নওগাঁয়। এসব মেশিন দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হচ্ছে। এতে বছরে বেচাকেনা হচ্ছে অর্ধশত কোটি টাকারও বেশি।

সূত্র জানায়, এক যুগ আগে জেলার পত্নীতলা উপজেলার নজিপুর বাজার ও ধামইরহাট উপজেলা সদরে গড়ে ওঠে ধান মাড়াই মেশিন কারখানা। গত ৫-৭ বছরের ব্যবধানে কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণ বেড়ে যাওয়ায় মাড়াই মেশিনের গুরুত্ব বেড়েছে।

স্থানীয় ভাষায় মাড়াই মেশিনকে বলা হয় ‘বঙ্গা’। পত্নীতলা ও ধামইরহাট উপজেলায় বঙ্গা কারখানা রয়েছে প্রায় ৮০টি। এসব কারখানা থেকে বছরে প্রায় দুই হাজার ধান মাড়াই মেশিন তৈরি হচ্ছে। পাশাপাশি প্রায় ৭০০ জন শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে।

কারখানা সূত্র জানায়, প্রতিটি ধান মাড়াই মেশিন তৈরিতে ৫-৬ জন শ্রমিকের সময় লেগে যায় ৫-৭ দিন। আর একেকটি মাড়াই মেশিনের দাম পড়ে দুই লাখ ৭০ হাজার টাকা থেকে দুই লাখ ৮০ হাজার টাকা। সে হিসাবে দুই হাজার মাড়াই মেশিনের দাম দাঁড়ায় প্রায় ৫৬ কোটি টাকা।

ধান মাড়াইয়ের এ মেশিনে মাড়াইয়ের পাশাপাশি ধানও পরিষ্কার হয়ে যায়। তাই আলাদা করে ধান পরিষ্কার করার প্রয়োজন হয় না। বোরো ও আমন মৌসুমে মাড়াই মেশিন বেশি ব্যবহৃত হয়।

একসময় ক্ষেত থেকে ফসল কাটার পর মাড়াই সমস্যায় পড়তে হতো চাষিদের। শ্রমিক সংকটের কারণে বিড়ম্বনায় পড়তে হতো। সঠিক সময়ে মাড়াই করতে না পারায় ফসল নষ্ট হতো। গত ৫-৭ বছরের ব্যবধানে কৃষিতে বেড়েছে যান্ত্রিকীকরণ। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে গত কয়েক বছরে প্রযুক্তি ও যন্ত্রাংশ ব্যবহারে কৃষকদের কষ্ট অনেকটা কমে এসেছে।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মাড়াই মেশিনে ধান মাড়াইয়ের পাশাপাশি সরিষা, তিল, তিষি, গম, ধনিয়া ও মাসকলাই মাড়াই করা যায়। নওগাঁ থেকে এসব মাড়াই মেশিন নোয়াখালী, যশোর, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, নীলফামারী, দিনাজপুর ও রংপুরসহ কয়েকটি জেলায় সরবরাহ করা হয়।

সততা ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপের মালিক শাহিনুর ইসলাম বলেন, বর্তমানে বাজারে অটো মাড়াই মেশিনের চাহিদা বেশি। এ মাড়াই মেশিন দিয়ে মাড়াইয়ের পাশাপাশি ধান পরিষ্কার হয়ে যায়। প্রতি ঘণ্টায় প্রায় এক একর জমির ধান মাড়াই করা সম্ভব।

নজিপুর বাজারে ২০০৮ সালে ‘নজিপুর ভাই ভাই ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ’ নাম দিয়ে ধান মাড়াই মেশিন কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন হারুনুর রশিদ। সেসময় ছোট আকারে ধান মাড়াই মেশিন তৈরি করতেন। ধানের সঙ্গে খড়কুটা থাকায় আলাদা করে বাতাস করতে হতো। চাহিদা বাড়তে থাকায় মাড়াই যন্ত্রে কিছুটা আধুনিকায়ন শুরু করেন। ২০১০ সালে অটো মাড়াই মেশিন তৈরি শুরু করেন। বর্তমানে বাজারে এর চাহিদা রয়েছে।

হারুনুর রশিদ জানান, তার কারখানায় ১৮ জন শ্রমিক নিয়মিত কাজ করছেন। মাড়াই মেশিনটি তৈরিতে কারিগরদের দিতে হয় ১৮-২০ হাজার টাকা। খাবার দিতে হয় তিনবেলা। শ্যালো মেশিনসহ মাড়াই মেশিনের ওজন প্রায় ১৪শ কেজি। বাজারে বিক্রি হচ্ছে দুই লাখ ৭০ হাজার টাকা থেকে দুই লাখ ৮০ হাজার টাকায়।

তিনি বলেন, ‘বর্তমানে সবকিছুর দাম বেড়েছে। বেশি দামে ধান মাড়াই মেশিন বিক্রি করেও লাভ থাকছে খুবই কম। করোনাভাইরাস শুরু হওয়ার আগে যন্ত্রাংশের দাম কম ছিল। সেসময় লাভ মোটামুটি ভালো ছিল।’

কৃষিতে ভর্তুকি দেওয়ায় কৃষকদের মধ্যে কৃষি যন্ত্রাংশ নেওয়ার আগ্রহ বাড়ছে। সরকার থেকে সহযোগিতা পেলে আগামীতে আরও আধুনিক মানের মাড়াই মেশিন তৈরি করা সম্ভব হবে বলে মনে করেন হারুনুর রশিদ।

তিনি বলেন, ‘বর্তমানে বাজারে যে মাড়াই মেশিন রয়েছে তা দিয়ে ধান মাড়াই করা হলে খড়গুলো কেটে টুকরা টুকরা হয়ে যায়। খড় যেন কেটে টুকরা না হয়ে গোটা খড় বেরিয়ে আসে, আগামীতে এমন মাড়াই মেশিন তৈরির চেষ্টা করছি।’

নজিপুর বঙ্গা সমিতির সাধারণ সম্পাদক মাসুম রেজা বলেন, ‘আমরা স্বল্প পুঁজির ব্যবসায়ী। করোনা শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবসায়ী আমাদের কাঁচামাল বাকিতে দিচ্ছে না। বিভিন্ন সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে মালামাল কিনতে হচ্ছে। বেসরকারি সংস্থা থেকে উচ্চহারের সুদে ঋণ নিতে হচ্ছে। কোনো ব্যাংক আমাদের সহযোগিতা করছে না।’

তিনি বলেন, ব্যাংক থেকে জামানত দিতে বলা হয়। কিন্তু ব্যাংকের চাহিদামতো আমাদের পক্ষে জামানত দেওয়া সম্ভব না। যদি সহজ শর্তে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া সম্ভব হতো তাহলে আমাদের ব্যবসার পরিধি আরও বাড়ানো যেতো।

নওগাঁ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. শামসুল ওয়াদুদ বলেন, জেলার পত্নীতলা ও ধামইরহাট উপজেলায় যথেষ্ট ভালো ও মানসম্মত পাওয়ার থ্রেসার (ধান মাড়াই মেশিন) তৈরি হয়। কর্তৃপক্ষ এসে কারখানাগুলো দেখে গেছেন। আমরা এ শিল্পকে আরও সম্প্রসারণের চেষ্টা করছি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *