প্রাণ-আরএফএল ব্যাংক ঋণ ১৪ হাজার কোটি টাকা

দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্প গ্রুপগুলোর অন্যতম ‘প্রাণ-আরএফএল’। শিল্প গ্রুপটির ২৫টি কোম্পানি উৎপাদন করছে আড়াই হাজারের বেশি পণ্য। উৎপাদিত এসব পণ্য স্থানীয় বাজারে বিক্রির পাশাপাশি রফতানি হচ্ছে বিশ্বের ১৪১টি দেশে। প্রায় ২০০ ব্র্যান্ডের পণ্য উৎপাদনকারী গ্রুপটির বার্ষিক টার্নওভার সব মিলিয়ে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা।

এর বিপরীতে শিল্প গ্রুপটির ব্যাংকঋণ আছে ১৪ হাজার কোটি টাকার বেশি। এ হিসাবে শিল্প গ্রুপটির কাছে ব্যাংকগুলোর ঋণ দাঁড়িয়েছে ব্যবসার প্রায় আড়াই গুণ। ব্যাংকাররা বলছেন, সম্প্রসারণের রাশ টানা উচিত গ্রুপটির। একই সঙ্গে ঋণ না বাড়িয়ে পরিশোধের দিকে নজর দেয়া প্রয়োজন।

দেশের প্রায় সব ব্যাংকের সঙ্গেই লেনদেন রয়েছে শিল্প গ্রুপটির। সরকারি-বেসরকারি সিংহভাগ ব্যাংক থেকেই ঋণ নিয়েছে প্রাণ-আরএফএল। গ্রুপটিকে ঋণ দেয়া অধিকাংশ ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের বক্তব্য, প্রাণ-আরএফএলের ঋণ এখনো খেলাপি হয়নি। তবে গ্রুপটির ঋণের আকার দ্রুত বাড়ার কারণে ব্যাংকারদের স্নায়ুচাপ বেড়ে যাচ্ছে। গত এক দশকে প্রাণ-আরএফএল সম্প্রসারিত হওয়ার পাশাপাশি ব্যাংকের ঋণ বাড়িয়েছে। ব্যাংকঋণের ওপর নির্ভর করেই গ্রুপটি নতুন নতুন কোম্পানি খুলেছে। দেশের বেশির ভাগ ব্যাংকের বড় গ্রাহক প্রাণ-আরএফএল। এ হিসেবে গ্রুপটির সফলতার সঙ্গে ব্যাংকের ভাগ্যও জুড়ে গেছে। এজন্য নতুন করে বিনিয়োগ না করে পুরনো ঋণ গুছিয়ে নিচ্ছে অনেক ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোর (সিআইবি) তথ্যমতে, চলতি বছরের আগস্ট শেষে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপে বিভিন্ন ব্যাংকের মোট ঋণ দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ৪৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে ফান্ডেড ঋণের পরিমাণ ১০ হাজার ১৫৯ কোটি টাকা। বাকি ৩ হাজার ৮৯০ কোটি টাকা নন-ফান্ডেড ঋণ।

গত কয়েক বছরে দেশের প্রায় সব ব্যাংকই অনেকটা প্রতিযোগিতা করে প্রাণ-আরএফএলকে ঋণ দিয়েছে। গ্রুপটিতে বড় অংকের ঋণ রয়েছে এমন ব্যাংকগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি), প্রাইম ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, ব্র্যাক ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক (এমটিবি), পূবালী ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, এনসিসি ব্যাংক, যমুনা ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংক। বড় গ্রাহক হওয়ায় এসব ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের কেউই প্রাণের ঋণের বিষয়ে নিজেদের উদ্বেগের কথা আনুষ্ঠানিকভাবে বলতে চাননি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বলেন, প্রাণ-আরএফএলের ঋণ নিয়ে তারা স্নায়ুচাপে ভুগছেন। এজন্য গ্রুপটির ঋণ না বাড়িয়ে ক্রমান্বয়ে কমিয়ে আনছেন।

প্রাণ-আরএফএলের কাছে প্রায় সব ব্যাংকের ঋণের বিষয়ে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, দেশের বড় ব্র্যান্ড হিসেবে ‘প্রাণ-আরএফএল’ ভালো করছে। প্রাণের পণ্য সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। দেশে ও বিদেশে গ্রুপটির উৎপাদিত পণ্যের যে সুনাম সেটি অক্ষুণ্ন থাকবে, এটি আমাদের প্রত্যাশা। ব্যাংকার হিসেবে প্রাণ-আরএফএলের ওপর আস্থা রেখেই আমরা ঋণ দিয়েছি। আশা করছি, প্রাণও আমাদের আস্থার প্রতিদান দেবে।

দ্রুত সম্প্রসারণের কারণে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ এ মুহূর্তে কিছুটা বেকায়দায় আছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে। তাদের তথ্যমতে, গ্রুপটির বেশকিছু পণ্য বিক্রি থেকে আয় কমছে। বিপুল অংকের ঋণের সুদ পরিশোধে হিমশিম খেতে হচ্ছে গ্রুপটিকে। কিছু পণ্যের বিক্রি কমে যাওয়ায় গুদামে উৎপাদিত পণ্যের মজুদ বেড়েছে। এক্ষেত্রে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান গুটিয়ে নেয়ার চিন্তাও করছে গ্রুপটি। প্রাণ-আরএফএল থেকে রাজস্ব আয় কমে যাওয়ায় সম্প্রতি গ্রুপটির বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিশেষ নিরীক্ষার উদ্যোগ নিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাংক হিসাব ও আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য চেয়ে চিঠিও দিয়েছে রাজস্ব আহরণকারী সংস্থাটি।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে প্রাণ-আরএফএলের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আহসান খান চৌধুরীর সঙ্গে চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তবে শিল্প গ্রুপটির একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, প্রাণ-আরএফএল এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিষ্ঠান বন্ধ করেনি। তবে ব্যবসায় বৈচিত্র্য আনতে কিছু পণ্যের উৎপাদন কমিয়ে নতুন পণ্য উৎপাদনে জোর দিচ্ছে। প্রাণ-আরএফএলের ব্যবসার সব দিকই ভালো চলছে বলে অনানুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছেন গ্রুপটির পরিচালক (মার্কেটিং) কামরুজ্জামান কামাল।

প্রাণ-আরএফএলে ২৬২ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে এমটিবির। এর মধ্যে ৮১ কোটি টাকা ফান্ডেড, বাকি ১৮০ কোটি টাকা নন-ফান্ডেড। এ ঋণের বিষয়ে জানতে চাইলে ব্যাংকটির এমডি আনিস এ খান বলেন, প্রাণ-আরএফএল আমাদের পুরনো গ্রাহক। তাদের ঋণ নিয়মিত আছে। তবে ভবিষ্যতে গ্রুপটির কী হবে, তা আমরা কেউ বলতে পারছি না। আশা করছি, প্রাণ-আরএফএল সুনামের সঙ্গে এগিয়ে যাবে।

প্রাণ-আরএফএলকে বড় অংকের ঋণ দেয়া ব্যাংকগুলোর একটি ব্যাংক এশিয়া। গত ডিসেম্বর শেষে গ্রুপটির কাছে ব্যাংক এশিয়ার ঋণের স্থিতি ছিল ৫৬৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে ফান্ডেড ২৪২ কোটি ও নন-ফান্ডেড ৩২৫ কোটি টাকা।

প্রাণ-আরএফএলকে দেয়া ঋণগুলো কী অবস্থায় আছে, জানতে চাইলে ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. আরফান আলী বলেন, গ্রাহক হিসেবে প্রাণ-আরএফএল এখন পর্যন্ত নিয়মিত। ঋণের দায় পরিশোধ করার মতো পর্যাপ্ত সম্পদ আছে তাদের। গ্রুপটিতে প্রায় এক লাখ লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। তবে ব্যাংকের কোনো বিনিয়োগই শতভাগ ঝুঁকিমুক্ত বলা যাবে না।

গ্রুপটির কাছে আরেক বেসরকারি ব্যাংক ইউসিবির গত ডিসেম্বর শেষে ঋণ ছিল ৭৮৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৫৯০ কোটি টাকা ফান্ডেড, অবশিষ্ট ১৯৬ কোটি টাকা নন-ফান্ডেড।

প্রাণ-আরএফএলে ৪০২ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের। এর মধ্যে ২১৬ কোটি টাকা ফান্ডেড ও নন-ফান্ডেড ১৮৬ কোটি টাকা। গ্রুপটিকে দেয়া ঋণের বিষয়ে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কাজী মসিহুর রহমান বলেন, আমরা প্রাণ-আরএফএলের আর্থিক পরিস্থিতি দেখে-শুনেই ঋণ দিয়েছি। আমাদের ক্যালকুলেশনে কোনো ত্রুটি নেই। গ্রুপটি আমাদের বড় গ্রাহক। তবে আমরা কোনো গ্রাহকের ঋণই আর বড় করছি না।

গ্রুপটিতে অর্থায়নকারী অন্য ব্যাংকগুলোর মধ্যে পূবালী ব্যাংকের ঋণের পরিমাণ ৫২২ কোটি, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ৩১৬ কোটি, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের ২৩১ কোটি, প্রাইম ব্যাংকের ৪০২ কোটি, এনসিসি ব্যাংকের ২৯৪ কোটি, যমুনা ব্যাংকের ৪৭৮ কোটি, এক্সিম ব্যাংকের ৩৯৫ কোটি, ঢাকা ব্যাংকের ৩৩০ কোটি ও ব্র্যাক ব্যাংকের ২৯৬ কোটি টাকা।

অর্থায়নকারী একাধিক ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীর মতে, স্বল্প সময়ের ব্যবধানে গ্রুপটি অনেক বেশি সম্প্রসারিত হয়েছে। সবকিছুর বাজার ধরতে গিয়ে অনেক অপ্রয়োজনীয় পণ্যও উৎপাদন করেছে। এসব পণ্য এখন প্রাণ-আরএফএলের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যাংকের ঋণ নিয়মিত থাকলেও ভবিষ্যতের কথা ভেবে প্রাণ-আরএফএলের ব্যবসা সম্প্রসারণ না করে আর্থিক ভিত শক্তিশালী করার পরামর্শ দিয়েছেন এসব ব্যাংকের এমডিরা।

টিউবওয়েল উৎপাদনের মধ্য দিয়ে আশির দশকের শুরুতে যাত্রা করেছিল রংপুর ফাউন্ড্রি লিমিটেড (আরএফএল)। এরপর যুক্ত হয়েছে ‘প্রাণ’। ১৯৮১ সালে রংপুর থেকে শুরু হওয়া টিউবওয়েলের ছোট্ট প্রতিষ্ঠানটিই বর্তমানে দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্প গ্রুপ ‘প্রাণ-আরএফএল’।

প্রাণ-আরএফএলের প্রতিষ্ঠাতা অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা আমজাদ খান চৌধুরী ২০১৫ সালে প্রয়াত হলে শিল্প গ্রুপটির হাল ধরেন তার উত্তরাধিকারীরা। আমজাদ খান চৌধুরীর মৃত্যুর পর তার ছেলে আহসান খান চৌধুরী গ্রুপের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্ব নেন। পরিচালকের (করপোরেট অ্যান্ড ফিন্যান্স) দায়িত্ব পান আমজাদ খান চৌধুরীর কন্যা উজমা চৌধুরী। এ সময় থেকেই দ্রুত সম্প্রসারিত হয়েছে শিল্প গ্রুপটি। ২৫টি কোম্পানির অধীনে উৎপাদন হচ্ছে প্রায় ২ হাজার ৬০০ পণ্য। এরই মধ্যে ব্র্যান্ডের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ২০০। দেশের ১৩টি স্থানে শিল্প গ্রুপটি কারখানা স্থাপন করেছে। প্রাণের উৎপাদিত পণ্যের মধ্যে রয়েছে বেভারেজ, বিস্কুট-বেকারি, কালিনারি, ডেইরি, স্ন্যাকস, সুগার কনফেকশনারি ও ফ্রোজেন ফুড জাতীয় পণ্য।

আরএফএলের অধীনে উৎপাদন হচ্ছে ১৮ ধরনের পণ্য। এর মধ্যে রয়েছে কৃষি উপকরণ, স্যানিটারি ও ফিটিংস, রান্নাঘরের উপকরণ, ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্য, ইলেকট্রিক অ্যান্ড ইলেকট্রনিক সামগ্রী, বিভিন্ন ধরনের পাইপ, গৃহস্থালি সামগ্রী, খেলনা, জুতা, রঙ, গার্মেন্ট পণ্য ও শিল্প উপকরণ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *