পেঁয়াজ রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা, কেজিতে দাম বাড়ল ১০০ টাকা

স্টাফ রিপোর্টার

অভ্যন্তরীণ বাজারে দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে গত শুক্রবার থেকে পেঁয়াজ রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ভারত। বাংলাদেশের বাজারে এ ঘোষণা ছড়িয়ে পড়লে একদিনের ব্যবধানে পণ্যটির দাম কেজিতে প্রায় ১০০ টাকা বা ৭০ শতাংশেরও বেশি বাড়িয়ে দেন ব্যবসায়ীরা। কোথাও কোথাও আমদানি করা পেঁয়াজ গতকাল বিক্রি হয়েছে দ্বিগুণ দামে। দেশী পেঁয়াজের মূল্য সরকার নির্ধারণ করে দিলেও এখন তিন-চার গুণ বেশিতে বিক্রি হচ্ছে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন বাজার পর্যবেক্ষণ করে এ চিত্র দেখা গেছে।

খুচরা ব্যবসায়ীরা জানান, পেঁয়াজ রফতানিতে ভারতের নিষেধাজ্ঞার খবর ছড়িয়ে পড়লে শুক্রবার দুপুর থেকেই দাম বাড়তে শুরু করে। সকাল গড়িয়ে সন্ধ্যায় কেজিপ্রতি ৪০-৫০ টাকা পর্যন্ত দাম বেড়ে যায়। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) তাদের ওয়েবসাইটে প্রতিদিনের হালনাগাদ তথ্যে জানিয়েছে, রাজধানীর খুচরা বাজারে গতকাল দেশী পেঁয়াজ প্রতি কেজি ১৮০-১৯০ টাকা আর আমদানি করা পেঁয়াজ ১৬০-১৭০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। যদিও খুচরা বাজারে এর চেয়ে বেশি দামে বিক্রি হতে দেখা যায়। শাহজাদপুর, বাড্ডা, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, তেজগাঁওসহ রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেশী পেঁয়াজ ২২০-২৪০ টাকা কেজি বিক্রি হতে দেখা যায়। আর আমদানি হওয়া ভারতীয় পেঁয়াজ মানভেদে বিক্রি হয়েছে ১৮০-২০০ টাকায়। যদিও শুক্রবার সকালে দেশী পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ১২০-১৪০ টাকায় এবং আমদানি হওয়া পেঁয়াজ ১০০-১২০ টাকা কেজি।

টিসিবির হিসাব অনুযায়ী, গত বছরের এ সময়ে দেশী ও আমদানি করা পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি ৪০ ও ৫০ টাকায়। সে হিসাবে গত বছরের তুলনায় দেশী পেঁয়াজ ৩১১ শতাংশ ও আমদানি করা পেঁয়াজের দাম ২৬৬ শতাংশ বেড়েছে।

তেজগাঁওয়ের উত্তর বেগুনবাড়ী এলাকার কাশেম জেনারেল স্টোরে গতকাল সন্ধ্যায় গিয়ে দেখা যায়, দেশী পেঁয়াজের দাম হাঁকানো হচ্ছে ২৫০ টাকা কেজি। তবে দামাদামি করলে ২৩৫ টাকায় দিতে রাজি হন বিক্রেতা। তিনি বলেন, ‘দাম বেড়ে যাওয়ায় মানুষ আরো বেশি নিচ্ছে। ২৫০ টাকায়ও নিয়েছে অনেকে। ভারতীয় পেঁয়াজ ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পাইকারিতেই বেশি দামে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে।’

এদিকে বাজার অস্থিতিশীল হয়ে ওঠায় গত ১৪ সেপ্টেম্বর পেঁয়াজের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য বেঁধে দেয় সরকার। প্রতি কেজি দেশী পেঁয়াজ ৬৪-৬৫ টাকায় বিক্রির জন্য বলা হয়। যদিও এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়নি। বর্তমানে সরকার নির্ধারিত দামের তিন গুণেরও বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে নিত্যপণ্যটি।

পেঁয়াজ রফতানিতে ভারতের নিষেধাজ্ঞা আগামী বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত কার্যকর থাকবে। তবে এরই মধ্যে রফতানির জন্য যেগুলোর লোডিং শুরু হয়েছে, সেগুলোর জন্য এ সিদ্ধান্ত প্রযোজ্য হবে না। আবার অন্যান্য দেশের সরকারের অনুরোধের ভিত্তিতে ভারত সরকারের অনুমতির মাধ্যমে পেঁয়াজ রফতানির অনুমতি দেয়া হবে বলেও ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্য অধিদপ্তরের (ডিজিএফটি) এক প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়েছে। এর আগে গত আগস্টে অভ্যন্তরীণ বাজারে মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেঁয়াজ রফতানিতে ৪০ শতাংশ শুল্কারোপ করে প্রতিবেশী দেশটি। এরপর রফতানি কমাতে ও দেশের বাজারে সরবরাহ বাড়াতে গত ২৮ অক্টোবর পণ্যটির ন্যূনতম রফতানি মূল্য প্রতি টন ৮০০ ডলার নির্ধারণ করেছিল ভারত।

পেঁয়াজ রফতানিতে ভারতের নিষেধাজ্ঞা ছড়িয়ে পড়ার একদিনের ব্যবধানে চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ ও হিলি স্থলবন্দরে আমদানি হওয়া পেঁয়াজের দাম দ্বিগুণ হয়েছে। কোথাও কোথাও ব্যবসায়ীরা পেঁয়াজ বিক্রি বন্ধও রেখেছেন। মূলত পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের চাপে এবং বাজারে পণ্যটির সরবরাহ কমে আসায় ভবিষ্যতের মজুদের কারণে পেঁয়াজের দামে এমন উল্লম্ফন হয়েছে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।

দেশের অন্যতম ভোগ্যপণ্যের পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে একদিনের ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। গতকাল সরজমিনে দেখা যায়, ভোর থেকেই পাইকারিতে ক্রেতারা পেঁয়াজ কেনার জন্য কাড়াকাড়ি শুরু করেন। ক্রেতাদের চাপে ঘণ্টায় ঘণ্টায় শেয়ারবাজারের মতো বেড়েছে পণ্যটির দাম। শুক্রবার ৯০-১১০ টাকা কেজি পাইকারিতে বিক্রি হওয়া পেঁয়াজ গতকাল সকাল ১০টার দিকে ১৮০-১৯০ টাকায় গিয়ে চড়ে। দুপুরে সেই দাম গিয়ে উঠে সর্বোচ্চ ২৩০-২৩৫ টাকা। ভবিষ্যতে পেঁয়াজের দাম আরো বাড়তে পারে সে কারণে অনেক পাইকারি দোকানে ‘পেঁয়াজ নেই’ বলে সাইনবোর্ডে টানিয়ে রেখেছেন। ভারতীয় পেঁয়াজের দাম বাড়ার কারণে চড়ছে চীনা, বার্মিজ ও পাকিস্তানি পেঁয়াজের দামও। গতকাল এসব পেঁয়াজ ১৫০ টাকা কেজি বিক্রি হয়েছে।

খাতুনগঞ্জের মেসার্স ইরা ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী মো. ওমর ফারুক বলেন, ‘শুক্রবার সন্ধ্যা থেকেই পেঁয়াজের দাম বেড়েছে। শনিবার ভোর থেকেই পাইকারি ক্রেতারা ভিড় করেন। তবে স্বাভাবিক সময়ের থেকে শনিবার পেঁয়াজের গাড়ি অর্ধেকের কম আসায় বাজারে এর প্রভাব পড়ে। যেটা সরাসরি ভোক্তার ওপর গিয়ে পড়ছে। তাছাড়া বাজারে দেশী পেঁয়াজ না থাকায় এখন আমরা সম্পূর্ণ ভারতের পেঁয়াজের ওপর নির্ভরশীল। ভারত যদি পেঁয়াজ একেবারেই রফতানি না করে তাহলে বিকল্প উৎস থেকে পেঁয়াজ আমদানির দিকে যেতে হবে সরকারকে। না হলে এর দাম শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে ঠেকবে সেটা বলা মুশকিল।’

এদিকে চট্টগ্রামের চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে শনিবার পেঁয়াজ পাওয়া যাচ্ছে না এ খবর ছড়িয়ে পড়লে বাজার তদারকিতে অভিযান চালায় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। এ সময় পেঁয়াজের বাজার কারসাজির জন্য খাতুনগঞ্জের বরকত ভাণ্ডারকে ২০ হাজার টাকা, এএইচ ট্রেডার্সকে ১০ হাজার টাকা, একে ট্রেডার্সকে ২০ হাজার টাকাসহ আরো দুই প্রতিষ্ঠানকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। ভোক্তা অধিকারের উপপরিচালক ফয়েজ উল্লাহ বলেন, ‘পেঁয়াজের দাম কেনা দামের চেয়ে বেশি রাখায় জরিমানা করা হয়েছে। খাতুনগঞ্জের আড়তে পেঁয়াজ নেই বলা হলেও বাস্তবে ছিল উল্টো। শুক্রবার যে পেঁয়াজ ১০০-১২০ টাকা বিক্রি হয়েছে শনিবার তার দাম হাঁকানো হয় ১৮০-২০০ টাকার বেশি। আমরা পুরনো দামে বিক্রি করতে বলেছি। ভারতীয় ও চীনা পেঁয়াজ কেনার রসিদ দেখাতে পারেননি আড়তদাররা।’

দিনাজপুরের হিলি বন্দর দিয়ে গতকাল দুই ট্রাকে ৫৯ টন পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে। ফলে বাজারের দু-একটি দোকানে পেঁয়াজ থাকলেও দাম দ্বিগুণের বেশি। গত শুক্রবার আমদানীকৃত পেঁয়াজ ৯০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হলেও গতকাল দাম বেড়ে ১৮০ টাকায় বিক্রি হয়।

হিলি বাজারের পেঁয়াজ বিক্রেতা মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘ভারত পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দেয়ার পর থেকেই বাজারে আমদানীকৃত পেঁয়াজের সরবরাহ অনেকটা কম। এর ওপর অনেকেই বাজারে আসছেন শুধু পেঁয়াজ কিনতে, যে যেমন পারছেন কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। মূলত ক্রেতাদের পেঁয়াজ কিনতে হুমড়ি খেয়ে পড়া ও তাদের বাড়তি চাহিদার কারণেই দাম বাড়ছে। তবে দেশীয় নতুন পেঁয়াজ উঠতে শুরু করায় এক সপ্তাহের মধ্যেই দাম অনেকটা কমে আসবে।’

কোনো রকম পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই ভারত সরকার হঠাৎ করেই পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দিয়েছে বলে জানান আমদানিকারকরা। এ বিষয়ে হিলি স্থলবন্দরের পেঁয়াজ আমদানিকারক শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘যেদিন রফতানি বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে তার আগেই ভারতীয় রফতানিকারকদের অনেক পেঁয়াজের এলসি দেয়া হয়েছে। কিন্তু তারা হঠাৎ করেই পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দিল এমনকি পুরনো এলসির বিপরীতেও পেঁয়াজ রফতানি করবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। শুধু রফতানি বন্ধের খবরেই দেশের কিছু অসাধু ব্যবসায়ী এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। যে পেঁয়াজ আমরা বৃহস্পতিবার বন্দরে ৯৩-৯৪ টাকা কেজি বিক্রি করেছি, সেটি তারা এখন ১৮০-২০০ টাকা দরে বিক্রি করছে। এসব ব্যবসায়ীকে আইনের আওতায় এনে জেল-জরিমানা করা উচিত।’

কনজিউমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এসএম নাজের হোসেন বলেন, ‘দেশের বাজারে পেঁয়াজ একদিনে কীভাবে শেষ হয়ে যায় যে বাজারে সংকট দেখা যাবে। এগুলো ব্যবসায়ীদের একটা দাম বাড়ানোর পলিসি। ভারত থেকে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ ঘোষণা করেছে। কিন্তু রাতের ব্যবধানে পাইকারি বাজারে পেঁয়াজ হাওয়া হয়ে গেছে। অতিরিক্ত মুনাফার লোভে ব্যবসায়ীরা পেঁয়াজ বাজারে বিক্রি না করে মজুদ করছেন, যাতে দাম আরো বাড়ানো যায়। বর্তমান পরিস্থিতি উত্তরণে সরকারকে ভারতের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাওয়াসহ বিকল্প দেশ থেকেও আমদানি করতে হবে। তবে দেশীয় পেঁয়াজ যতদিন বাজারে না আসবে, ততদিন সরকারকে পেঁয়াজের মূল্য নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত মনিটর করতে হবে। ভোক্তার ওপর দাম বাড়িয়ে অর্থ আদায়ের ফাঁদ বন্ধ করতে হবে।

দেশে পেঁয়াজের চাহিদা প্রায় ৩০ লাখ টন। সর্বশেষ অর্থবছরে ৩৪ লাখ টনের বেশি পেঁয়াজ উৎপাদন হয়। তবে মাঠপর্যায় থেকে ভোক্তা পর্যন্ত যেতে এক-চতুর্থাংশ পেঁয়াজ নষ্ট হয় কিংবা শুকিয়ে কমে যায়। চলতি বছরের মার্চে প্রতি কেজি পেঁয়াজ ৩০-৩৫ টাকায় বিক্রি হয়েছিল। তবে গত এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকেই নিত্যপণ্যটির দাম বাড়তে শুরু করে। এরপর জুনের শুরুতে প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম প্রায় ১০০ টাকায় ঠেকলে গত ৫ জুন থেকে আমদানির অনুমতি দেয় কৃষি মন্ত্রণালয়। এরপর থেকে গত ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ১৯ লাখ ৯৩ হাজার ২৯১ টন পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দেয়া হয়। তবে এর বিপরীতে পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে ৭ লাখ ৫ হাজার ৪৩৭ টন।

এদিকে শিগগিরই দেশে মুড়িকাটা পেঁয়াজ উঠতে শুরু করবে। এরপর বাজারে পেঁয়াজের সরবরাহ বাড়লে দাম কমে আসবে বলে মনে করেছেন কৃষি খাতসংশ্লিষ্টরা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা অনৈতিকভাবে পেঁয়াজের দাম বাড়িয়েছেন। বাজারে পর্যাপ্ত পেঁয়াজ আছে। প্রতি বছরই ছয়-সাত লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়। এবারো প্রায় ২০ লাখ টন আমদানির অনুমতি দেয়া হলেও মাত্র সাত লাখ টন পেঁয়াজ দেশে এসেছে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *