পুঁজিবাজারে আস্থা ফিরেছে তবে……

বড় ধরনের ধসের পর পুঁজিবাজারের উন্নয়নে সরকারের শীর্ষপর্যায় থেকে বেশকিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়। তাৎক্ষণিক ফলাফলও মেলে। চলতি সপ্তাহের প্রথমদিন গতকাল রোববার দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) এবং অপর বাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) লেনদেনে অংশ নেয়া প্রায় সবকটি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম বাড়ে।

গত সাত বছরের মধ্যে এদিন মূল্য সূচকের সবচেয়ে বড় উত্থান হয়। একদিনেই ১৫ হাজার কোটি টাকার ওপর মূলধন ফিরে পায় ডিএসই। সাড়ে ৫ শতাংশের ওপরে বাড়ে প্রধান মূল্য সূচক। রোববারের ধারাবাহিকতায় সোমবারও লেনদেনের শুরুতে পুঁজিবাজারে বড় ধরনের উত্থানের আভাস পাওয়া যায়। লেনদেনের প্রথম ১০ মিনিটে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান মূল্যসূচক ৮৫ পয়েন্ট বাড়ে। সেই সঙ্গে বাড়ে লেনদেনে অংশ নেয়া বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম।

বাজার-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুঁজিবাজার নিয়ে প্রধানমন্ত্রী উদ্যোগ নেয়ায় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা বেড়েছে। বিনিয়োগকারীরা বিশ্বাস করেন, সরকার বাজার ভালো করতে আন্তরিক। তারই প্রতিফলন এখন দেখা যাচ্ছে। ‘ভালো’ উদ্যোগের অংশ হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে পুঁজিবাজারে তারল্য বাড়াতে সহায়তার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। ঢাকার ব্যবসায়ীদের সংগঠন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই)ও মনে করছে, প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে পুঁজিবাজারের সমস্যার সমাধান হবে।

পুঁজিবাজার-বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রী নিজে হস্তক্ষেপ করেছেন। এখন যেসব উদ্যোগের কথা বলা হচ্ছে তাতে পুঁজিবাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরে আসবে। তবে এর পাশাপাশি ব্যাংক ও আর্থিক খাতের সমস্যা সমাধানেও উদ্যোগ নিতে হবে। পুঁজিবাজারে সুশাসন প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করতে হবে।

গত ৫ জানুয়ারি থেকে ১৪ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশের পুঁজিবাজারে বড় ধরনের দরপতন ঘটে। এ সময়ে লেনদেন হওয়া আট কার্যদিবসের মধ্যে সাতদিনই বড় পতন হয়। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান মূল্য সূচক ৪২৩ পয়েন্ট কমে যায়।

পুঁজিবাজারের এমন ভয়াবহ পতনে গত ১৪ জানুয়ারি অংশীজনদের সঙ্গে জরুরি বৈঠকে বসার ঘোষণা দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। দুদিন পর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার কার্যালয়ে আলোচনা সভা করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) শীর্ষ ব্যক্তিরা।

আলোচনার বিষয়ে বিএসইসি থেকে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানানো হয়, পুঁজিবাজার উন্নয়নে সরকার অত্যন্ত আন্তরিক। বাজার উন্নয়নের জন্য যে ধরনের সাহায্য প্রয়োজন সরকার ধারাবাহিকভাবে তা করে যাবে। সভায় স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। স্বল্পমেয়াদি কিছু পদক্ষেপ অচীরেই কীভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, এমন মতামতও দেয়া হয়েছে।

এর মধ্যে রয়েছে- পুঁজিবাজারে ব্যাংক ও ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করা, মার্চেন্ট ব্যাংকার ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা পর্যালোচনা করা, আইসিবির বিনিয়োগ সক্ষমতা বৃদ্ধি করা, বাজারের ওপর আস্থা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং বাজারে মানসম্পন্ন আইপিও বৃদ্ধির লক্ষ্যে বহুজাতিক ও সরকারি মালিকানাধীন কোম্পানি তালিকাভুক্তের উদ্যোগ গ্রহণ করা। এ বিষয়ে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে।

পাশাপাশি রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকের পক্ষ থেকে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ বাড়ানোর ঘোষণা দেয়া হয়। ফলে গত বৃহস্পতিবার পুঁজিবাজারে মূল্য সূচকের বড় ধরনের উত্থান হয়।

পুঁজিবাজারের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, পুঁজিবাজার নিয়ে যে ধরনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, আশা করা যায় পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হবে। রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংক ছাড়াও অন্য ব্যাংকগুলোকে বাজারে বিনিয়োগের জন্য বলা হয়েছে। কিন্তু ব্যাংকগুলোর তো তারল্য সংকট আছে। সুতরাং তারা কতটুকু বাস্তবায়ন করতে পারে সেটাই দেখার বিষয়।

তিনি বলেন, সরকার ঘোষণা দিয়েছে যে, বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের যে উদ্বৃত্ত অর্থ ব্যাংকে এফডিআর আছে, তা তুলে সরকারি ট্রেজারিতে জমা দিতে। এতে ব্যাংকের ডিপোজিট (আমানত) কমে যাবে। ডিপোজিট কমলে ক্রেডিট (ঋণ বিতরণ) কমে যাবে। ক্রেডিট কমে গেলে তাদের আয় কমে যাবে, যা ব্যাংক খাতসহ অন্যান্য খাতের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

‘সবমিলিয়ে একটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া হতে পারে বলে আমার কাছে মনে হচ্ছে। দেখা যাক কী হয়? তবে এ উদ্যোগের ফলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা কিছুটা ফিরে আসবে বলে আশা করা যায়। সরকার চায় বাজার ভালো হোক- এমন ধারণা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আসবে। যেহেতু অনেক বড় মাত্রার দরপতন হয়েছে, এতে অনেক ভালো কোম্পানির শেয়ারের দাম কমে গেছে। সুতরাং আস্থা ফিরে আসলে বিনিয়োগকারীরা এসব কিনতে শুরু করবেন। সার্বিকভাবে আশা করি, পুঁজিবাজারের সার্বিক পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হবে।’

বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশ্যে তিনি আরও বলেন, যখন কোনো দরপতন হয় তখন বিনিয়োগকারীদের উচিত কেনা। এখন বাজারে অনেক ভালো শেয়ারের বড় দরপতন হয়েছে, কাজেই আমি মনে করি, এখন তাদের কেনা উচিত। তবে তাদের হোল্ডিং পাওয়ার থাকতে হবে। আজ কিনে কালই লাভবান হবো, এ মানসিকতা পরিহার করতে হবে। মৌলভিত্তির শেয়ার কিনে ধরে রাখতে হবে।

ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মুসা বলেন, স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হবে তা বলা হয়নি। এখন নিশ্চিত করা হয়েছে যে, ব্রোকারদের ফান্ডের ব্যবস্থা করা হবে। এখন প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসে কিছুদিন যদি বাজার ধরে রাখা যায় এবং বিনিয়োগকারীরা যদি শেয়ার কেনেন তাহলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে। বিনিয়োগকারীরা শেয়ার ধরে রাখতে না পারলে সমস্যার সমাধান হবে না।

তিনি আরও বলেন, ব্রোকার, মার্চেন্ট ব্যাংক এবং ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান যদি বিনিয়োগ করে তাহলে আস্থা ফিরবে। বাজারে ভালো ও খারাপ উভয় শেয়ার আছে। বিনিয়োগকারীদের উচিত হবে ভালো শেয়ার কেনা। ভালো শেয়ার না কিনে খারাপ শেয়ার কিনলে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড পাবলিক পলিসি বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান জোগো নিউজকে বলেন, পরিস্থিতির উন্নতির জন্য প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) দেখা করেছে এবং তারা একটি প্রজ্ঞাপনও জারি করেছে। কিন্তু দুঃখজনক হলো, যে উদ্যোগগুলো আসছে তার বেশিরভাগ সময়সাপেক্ষ। এগুলো বাজারে তাৎপর্যপূর্ণ সাপোর্ট দেবে বলে আমার মনে হয় না।

তিনি বলেন, মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারদের স্বল্প সুদে ঋণ দেয়ার কথা বলা হয়েছে। আমার মনে হয় এটা কোনো সমস্যা নয়। বাজারের মূল সমস্যা হলো বিনিয়োগকারীদের আস্থার অভাব। তাদের ঝুঁকির মাত্রা অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। ১০ বছর ধরে বিনিয়োগকারীরা তাদের মূলধন হারিয়েছেন। বাজারে সুশাসন যদি ফিরিয়ে আনা না যায়, প্রাইমারি মার্কেটে (আইপিও) ব্যাংক জালিয়াতি কোম্পানি, অস্বচ্ছ ও সুশাসনবিহীন কোম্পানিকে যদি আটকানো না যায়, আইপিও অর্থের অপব্যবহার যদি আটকানো না যায় তাহলে বিনিয়োগকারীদের মার্কেটমুখী করা যাবে না।

তিনি আরও বলেন, এটা স্পষ্ট যে, প্রধানমন্ত্রী পুঁজিবাজারের উন্নয়ন চান। তবে তার কাছে তো সঠিক সমস্যা তুলে ধরতে হবে। এখন সবচেয়ে বড় প্রয়োজন আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা। সেই সঙ্গে স্টক এক্সচেঞ্জ ও বিএসইসির গভর্নেন্স’র ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করা এবং তাদের সক্ষমতা বাড়নো। এসব জায়গায় বড় ধরনের স্খলন হয়ে গেছে, এ স্খলন দূর করা না গেলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরে আসবে না।

ব্যাংক খাতের তারল্য সংকট দূর করতে হবে- এমনটি উল্লেখ করে মিজানুর রহমান বলেন, এ খাতের তারল্য সংকট ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। এ সমস্যার দ্রুত সমাধান প্রয়োজন। সরকার এ সমস্যা যত দ্রুত স্বীকার করবে, তত-ই ব্যাংক খাতের তারল্য এবং পুঁজিবাজারের তারল্য পরিস্থিতির উন্নতি হবে।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালক শাকিল রিজভী বলেন, যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, আশা করা যায় বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়বে। আস্থা বাড়লে বাজারে অবশ্যই ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। এছাড়া অনেক ভালো কোম্পানির শেয়ারের দাম এখন লোভনীয় পর্যায়ে রয়েছে। বাজার যখন ভালো হয় তখন একটা গ্রুপ এর সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করে। বিনিয়োগকারীদের উচিত এ বিষয়ে সতর্ক থাকা। তাদের উচিত ভালো কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করা।

বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক  বলন, আমরা দীর্ঘদিন ধরেই পুঁজিবাজারে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছিলাম। এখন প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে কিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আমরা আশা করি, এখন বাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরে আসবে এবং বাজার ভালো হবে।

তিনি বলেন, মার্চেন্ট ব্যাংকার ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা দেয়ার কথা বলা হয়েছে। আমরা দীর্ঘদিন ধরে বিনিয়োগকারীদের জন্য ১০ হাজার কোটি টাকার ফান্ডের দাবি করে আসছি। আমরা চাই মার্চেন্ট ব্যাংক ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের মতো ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের জন্যও স্বল্প সুদে ও সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করা হোক।

তিনি আরও বলেন, আমরা বিএসইসিরও সংস্কার চাচ্ছি। আমাদের এ দাবি মেনে নিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে দ্রুত সংস্কার করতে হবে। সেই সঙ্গে যারা ২০১০ সালের ধসের সঙ্গে জড়িত তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ইব্রাহিম খালেদের নেতৃত্ব গঠিত তদন্ত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *