পণ্য পরিবহনে জাহাজপ্রতি গড় ব্যয় বেড়েছে ১০ লাখ ডলার
লোহিত সাগরে কনটেইনার জাহাজের ওপর হামলা শুরুর কয়েক মাস অতিবাহিত হলেও পরিস্থিতির ততটা উন্নতি ঘটেনি। এ নিয়ে শিপিং জায়ান্ট মায়েরস্ক সম্প্রতি সতর্ক করে বলেছে, সরবরাহ ব্যবস্থায় এ ব্যাঘাত এক বছরের বেশি সময় চলতে পারে। এখন ঘুরপথে পণ্য পরিবহনে বাড়তি সময়ের পাশাপাশি জাহাজপ্রতি খরচ বেড়েছে প্রায় ১০ লাখ ডলার। খবর সিএনএন।
গাজায় ইসরায়েলি হামলার প্রতিশোধ হিসেবে নভেম্বরের শেষ দিকে লোহিত সাগরের বাণিজ্য বহরে হামলা শুরু করে ইরান-সমর্থিত হুথি গোষ্ঠী। এর প্রতিক্রিয়ায় শিপিং জায়ান্টগুলো উত্তমাশা অন্তরীপের সমুদ্র বেছে নেয়। সম্প্রতি হুথি নিয়ন্ত্রিত এলাকায় যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য অভিযান শুরু করলেও পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি হয়নি।
লোহিত সাগর ও ভূমধ্যসাগরকে সংযুক্ত করেছে মিসরের সুয়েজ খাল। এ পথে বিশ্ব বাণিজ্যের ১০-১৫ শতাংশ সম্পন্ন হয়। এতে জ্বালানি তেল রফতানিও অন্তর্ভুক্ত। সব মিলিয়ে বৈশ্বিক কনটেইনার জাহাজের ৩০ শতাংশ এ পথে চলাচল করে।
অবশ্য বিশ্লেষকরা বলছেন, শিপিং খরচ ও সরবরাহ চেইনের সামগ্রিক প্রভাব করোনা মহামারীকালীন উচ্চতার তুলনায় অনেক কম গুরুতর। তবুও বর্তমান সংকটে কিছু চিহ্ন স্পষ্ট। যেমন জার্মানি থেকে যন্ত্রাংশ সময় মতো না পাওয়ায় কিছু গাড়ি নির্মাণ বন্ধ রাখতে হয়েছে টেসলাকে। সুইডিশ ফার্নিচার জায়ান্ট আইকিয়া সম্ভাব্য পণ্যের ঘাটতি সম্পর্কে সতর্ক করেছে সম্প্রতি।
মায়েরস্কের সিইও ভিনসেন্ট ক্লার্কের মতে, এমন কিছুর আভাস নেই, যাতে মনে হয় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় শিগগিরই বাণিজ্য রুটটি পুনরুদ্ধার করতে পারেব। বরং লোহিত সাগরে চলাচল স্বাভাবিক হতে এক বছরের বেশি অপেক্ষা করতে হবে।
সাগর ও আকাশপথে পণ্য পরিবহনবিষয়ক ডেটা সংস্থা জেনেটার প্রধান বিশ্লেষক পিটার স্যান্ড জানান, আগে সুয়েজ খাল ব্যবহার করেছে এমন কনটেইনার জাহাজের ৯০ শতাংশই আফ্রিকার দক্ষিণ প্রান্তের সমুদ্র পথ বেছে নিয়েছে।
এ পথ দিয়ে যাচ্ছে বাল্ক ক্যারিয়ারের প্রায় এক-চতুর্থাংশ, যাতে রয়েছে শস্য বা সিমেন্টের মতো শুকনো পণ্য। জ্বালানি তেল বা প্রাকৃতিক গ্যাস ট্যাঙ্কারের এক-চতুর্থাংশও উত্তমাশা অন্তরীপ হয়ে গন্তব্যে যাচ্ছে। এতে ১৪ থেকে ১৮ দিন বেশি সময় লাগছে। সময়ের বাধা এড়াতে কিছু কোম্পানি আকাশপথও বেছে নিচ্ছেন বলে জানান পিটার স্যান্ড।
তিনি জানান, আকাশপথের ব্যবহার ইউরোপের ফ্যাশন কোম্পানিগুলোর খরচ বাড়িয়ে দিয়েছে। কারণ পোশাকের বিক্রি মৌসুমকেন্দ্রিক হওয়ায় সমুদ্রের চেয়ে আকাশপথই পারে সময় বাঁচাতে। এতে পরিবহন খরচ বেড়েছে ১০ থেকে ২০ গুণ। গত তিন সপ্তাহে ভিয়েতনাম থেকে উত্তর ইউরোপে পোশাকের কার্গো আকাশপথে নেয়ার পরিমাণ বেড়েছে।
অন্যদিকে শিপিং রুটে অতিরিক্ত কয়েক হাজার মাইল যোগ করার ফলে জ্বালানি ও বীমা খরচ বেড়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে চার্টার ফি ও মজুরি বিল। জেনেটার বিশ্লেষণ অনুসারে, মায়েরস্ক ও হ্যাপাগ-লয়েডের মতো শিপিং জায়ান্ট উত্তরমাশা অন্তরীপ হয়ে পরিবহনের জন্য জাহাজপ্রতি অতিরিক্ত ১০ লাখ খরচ করছে। এ খরচের বড় একটি অংশই যায় জ্বালানি বাবদ, যা শেষ পর্যন্ত পণ্যের বিক্রেতার পর যাচ্ছে।
ড্রেউরি ওয়ার্ল্ড কনটেইনার সূচক অনুসারে, একটি সাধারণ ৪০ ফুট কনটেইনারপ্রতি শিপিং খরচ এ সপ্তাহে ৩ হাজার ৭৮৬ ডলার দাঁড়িয়েছে, যা এক বছর আগের একই সময়ের তুলনায় ৯০ শতাংশ বেশি। অন্যদিকে চীনের সাংহাই থেকে নেদারল্যান্ডসের রটারডাম পর্যন্ত একই আকারের কনটেইনারের জন্য খরচ এক বছর আগের তুলনায় ১৫৮ শতাংশ বেড়ে ৪ হাজার ৪২৬ ডলারে পৌঁছেছে।
অবশ্য বর্তমান সংকট এখনো মহামারীকালীন খরচ বৃদ্ধিকে স্পর্শ করতে পারেনি। যেমন ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে ভাড়া ১০ হাজার ৩৮০ ডলারে পৌঁছে। এ বিষয়ে ক্যাপিটাল ইকোনমিকসের অর্থনীতিবিদ সাইমন ম্যাকঅ্যাডাম বলেন, ‘আমরা মহামারীর তুলনায় অনেক ভালো জায়গায় আছি।’
তিনি জানান, ২০২১ সালে পণ্যের বৈশ্বিক চাহিদা ‘অভূতপূর্ব’ গতিতে বাড়ার পর এখন স্বাভাবিক স্তরে ফিরে এসেছে। এছাড়া উচ্চ সুদহারের কারণে বেশি দামের পণ্যের প্রতি গ্রাহকদের আগ্রহ কম।
মায়েরস্কের ক্লার্ক জানান, বর্তমান শিপিং সংকট মহামারী চলাকালে যা ঘটেছিল তার ‘পুনরাবৃত্তি নয়’। এখনকার সংকটের পরিধি অনেক বেশি সীমিত।
এছাড়া কম লাভের বিক্রির ক্ষেত্রে একই চালানে অনেক বেশি পণ্য থাকে বলে অতিরিক্ত খরচ ছোট ছোট ভাগে বিভক্ত হয়। এ কারণে কনটেইনার শিপিং এখনো ‘খুব সাশ্রয়ী’। সম্প্রতি অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বলেছে, পণ্য পরিবহনের অতিরিক্ত খরচের কারণে জোটের ৩৮টি সদস্য দেশে ভোক্তা মূল্যস্ফীতি প্রায় এক বছর পর দশমিক ৪ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়তে পারে।