নানা সংকটে চামড়া ব্যবসায়ীরা
ত্রিমুখী সংকটে চিন্তিত দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সর্ববৃহৎ চামড়ার মোকাম যশোরের রাজারহাটের চামড়া ব্যবসায়ীরা। ঢাকার ট্যানারি মালিক ও আড়তদারদের কাছে পাওনা বকেয়ার কারণে নগদ অর্থ সংকট, চামড়ার দাম নির্ধারণ ও চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের উপকরণ লবণের অগ্নিমূল্য। এ তিন সংকটকে সঙ্গী করে কোরবানি ঈদ-পরবর্তী চামড়া বাজারের প্রস্তুতি নিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।
যশোরের রাজারহাট দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বৃহত্তম চামড়ার মোকাম। এ হাট ঘিরে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় ১০ হাজার ছোট-বড় ব্যবসায়ী ব্যবসা করেন। ঈদ-পরবর্তী হাটেই অন্তত দশ কোটি টাকার চামড়া বেচাকেনা হয়। খুলনা বিভাগের ১০ জেলার ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, ঝালকাঠি, রাজশাহী, পাবনা, ঈশ্বরদী ও নাটোরের বড় ব্যবসায়ীরা এখানে চামড়া বেচাকেনা করেন। ঢাকার বড় বড় আড়তদার ও ট্যানারি মালিকরাও রাজারহাটের চামড়া বাজারে নজর রাখেন।
লবণের দাম বেড়ে যাওয়ায় চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের ব্যয়ও বাড়ছে। ফলে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের চ্যালেঞ্জে পড়তে হবে- আলাউদ্দিন মুকুল, সাধারণ সম্পাদক, যশোর জেলা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতিবিজ্ঞাপন
সাধারণত কোরবানি-পরবর্তী হাটবার রাজারহাটে লক্ষাধিক চমড়া বেচাকেনা হয়। কিন্তু করোনাভাইরাস ও লকডাউনের প্রভাবের পাশাপাশি গত কয়েক বছর চামড়ার বাজারের দরপতনও ছিল লক্ষণীয়। এরসঙ্গে যোগ হয়েছে ট্যানারি মালিকদের কাছে থাকা বকেয়া টাকা আদায় না হওয়ার চাপও।
রাজারহাটের চামড়া ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, ঢাকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলের ট্যানারি মালিক ও আড়তদারদের কাছে তাদের প্রায় ১০ কোটি টাকা বকেয়া পাওনা। প্রত্যাশা অনুযায়ী বকেয়া আদায় না হলে কোরবানির চামড়া কিনতে নগদ টাকা সংকটে পড়তে হবে। এছাড়া এবার পশুর দামও তুলনামূলক বেশি। বিপরীতে দ্রব্যমূল্য ও বাজার পরিস্থিতির কারণে পশু কোরবানির পরিমাণও কমতে পারে। সেক্ষেত্রে চামড়ার আমদানিও কমবে। এসব বিষয় নিয়ে তারা চিন্তিত। তবে করোনা-পরবর্তী ধকল কাটিয়ে দেশ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরেছে বলে এবার ঈদুল আজহায় চামড়া বাজার ঘুরে দাঁড়াবে বলে প্রত্যাশা তাদের।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, ট্যানারি মালিকদের কাছ থেকে বকেয়া আদায় হয়নি অনেকের। রয়েছে অব্যাহত লোকসানের চাপ। যে কারণে মূলধন সংকট রয়েছে রাজারহাটের অনেক ব্যবসায়ীর।
তাদের দাবি, ট্যানারি মালিকদের কাছে যশোরের ব্যবসায়ীদের অন্তত ১০ কোটি টাকা বকেয়া পাওনা রয়েছে। সরকারের ঋণ সুবিধাও মিলছে না। বড় বড় ব্যবসায়ী ব্যাংক ঋণ পেলেও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা ঋণ পায় না। ফলে কোরবানি পরবর্তী হাটে চামড়া কিনতে নগদ টাকার জন্য ধারদেনা ও এনজিওর ঋণে নির্ভর করতে হয় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের। এবারও ব্যবসায়ীরা যার যার মতো নগদ টাকা জোগাড়ের চেষ্টা করছেন।
আরও পড়ুন: দাবদাহে লবণ শিল্পে বাজিমাত
এছাড়া বকেয়া আদায় না হওয়া ও নগদ অর্থ সংকটের পাশাপাশি রয়েছে চামড়ার মূল্য নির্ধারণ নিয়েও দুর্ভাবনা। ব্যবসায়ীদের ধারণা, প্রতি বছরের মতো এবারও ভালোমানের গরুর চামড়া প্রতি বর্গফুট ৩৫-৪০ টাকা নির্ধারণ হতে পারে। সেই দাম অনুযায়ী মাঠ থেকে চামড়া কেনা না হলে লোকসানের আশঙ্কা রয়েছে।
অনেক সময় দেখা যায়, মৌসুমি ব্যবসায়ীরা বাড়তি দামে চামড়া কিনে বাজার অস্থিতিশীল করে তোলেন। সেজন্য চামড়ার দাম আরেকটু বাড়িয়ে নির্ধারণের দাবি তাদের।
রাজারহাট চামড়া বাজারের সাবেক ইজারাদার চামড়া ব্যবসায়ী হাসানুজ্জামান হাসু বলেন, চামড়ার বাজার এখন মোটামুটি ভালো। মাঝারি আকারের গরুর চামড়া ৮০০-৯০০ টাকা ও বড় আকারের চামড়া ১২০০-১৩০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে কোরবানি পরবর্তী হাটের পরিস্থিতি কেমন হবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। কারণ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কাছে নগদ টাকার সংকট রয়েছে। ট্যানারি মালিক ও আড়তদারদের কাছে তাদের পাওনা প্রায় ১০ কোটি টাকা। এজন্য ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা কীভাবে চামড়া কিনবেন তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন।
চমড়ার দাম নির্ধারণ নিয়েও দুশ্চিন্তা রয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রতি বর্গফুট ৪০-৪৫ টাকা নির্ধারণ করলে ভালো হয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
অপরদিকে এসব সংকটের পাশাপাশি রয়েছে চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের উপকরণ লবণের অগ্নিমূল্য। গত বছর যে লবণ ৯০০ থেকে এক হাজার টাকা বস্তা (৭০ কেজি) কিনেছেন ব্যবসায়ীরা, সেই লবণের দাম এখন ১ হাজার ৩০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকা। এ দাম অনুযায়ী এখন প্রতিটি চামড়া প্রক্রিয়াজাত করতে লবণ ও শ্রমিকের মজুরি দিয়ে ২০০ টাকার বেশি পড়ে যাচ্ছে। লবণের এই বাড়তি মূল্যও শঙ্কা বাড়াচ্ছে ব্যবসায়ীদের।
আরও পড়ুন: ৩০ মণের ‘সাদা সম্রাট’ বিক্রি হবে ৬ লাখে
এ ব্যাপারে বৃহত্তর যশোর জেলা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আলাউদ্দিন মুকুল বলেন, লবণের দাম বেড়ে যাওয়ায় চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের ব্যয়ও বেড়ে যাচ্ছে। ফলে কাঁচা চামড়া কিনে তা প্রক্রিয়াজাত করে বিক্রির ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে। আর ঢাকার আড়তদারদের কাছে টাকা বকেয়া থাকায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা কীভাবে চামড়া কিনবেন তা নিয়ে তাদের দুশ্চিন্তা রয়েছে।
ঈদের এক সপ্তাহ ঢাকায় কোনো চামড়া পাঠানো যাবে না। চামড়ার বাজার স্থিতিশীল রাখতে কেন্দ্রীয়ভাবে এ সিদ্ধান্ত হয়েছে- মো. তমিজুল ইসলাম খান, জেলা প্রশাসক, যশোরউপরন্তু ঈদের এক সপ্তাহের মধ্যে জেলার চামড়া ঢাকায় পাঠানো যাবে না বলে জানিয়েছে প্রশাসন। কেন্দ্রীয়ভাবেই এ সিদ্ধান্ত হয়েছে। ফলে এই সময়ে চামড়া স্থানীয়ভাবে ব্যবসায়ীদের সংরক্ষণ করতে হবে।
এ ব্যাপারে যশোরের জেলা প্রশাসক মো. তমিজুল ইসলাম খান জানান, ঈদের পর এক সপ্তাহ ঢাকায় কোনো চামড়া পাঠানো যাবে না। কেন্দ্রীয়ভাবেই এ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। চামড়া বাজার স্থিতিশীল রাখতে এ সিদ্ধান্ত হয়েছে।
তিনি আরও জানান, যেহেতু রাজারহাট এ অঞ্চলের অন্যতম বড় চামড়ার মোকাম। এখানে ঈদ-পরবর্তী চামড়া বেচাকেনা নির্বিঘ্ন করতে সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে সভা করা হয়েছে। প্রশাসন হাটের নিরাপত্তাসহ সব ধরনের সুযোগ সুবিধা নিশ্চিতে সচেষ্ট।