দেশের সর্ববৃহৎ কোম্পানি বিএটিবিসি
দেশে তামাকের ব্যবহার নিরুৎসাহিত করতে আছে নানা উদ্যোগ। এর অংশ হিসেবে চলছে তামাকবিরোধী সচেতনতামূলক বিভিন্ন কর্মকাণ্ড। এ-সংক্রান্ত আইন পরিপালনে রয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালতও। তামাকজাত পণ্য ব্যবহার থেকে যাতে মানুষ সরে আসে, সেজন্য প্রতি বছরই এসব পণ্যে কর বাড়ানো হচ্ছে। তার পরও অপ্রতিরোধ্য গতিতে বড় হচ্ছে তামাক খাতের বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ কোম্পানি (বিএটিবিসি)। গত পাঁচ বছরে কোম্পানিটির বিক্রি বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। বিক্রয় বিবেচনায় বিএটিবিসি এখন দেশের সর্ববৃহৎ কোম্পানি।
বহুজাতিক কোম্পানিটির আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৪ সালে কোম্পানিটি সিগারেট ও তামাক বিক্রি করে ১২ হাজার ৬৭৩ কোটি টাকার। সর্বশেষ ২০১৮ সালে বিক্রির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৩ হাজার ৩১২ কোটি টাকায়। গত পাঁচ বছরে বার্ষিক গড়ে ১৬ শতাংশের বেশি বিক্রয় প্রবৃদ্ধি হয়েছে দেশের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিটির।
কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৫ সালে বিএটিবিসির বিক্রি দাঁড়ায় ১৪ হাজার ৩৭১ কোটি টাকায়। ২০১৬ সালে ১৫ দশমিক ২৫ শতাংশ বেড়ে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ১৬ হাজার ৫৬৩ কোটি টাকায়। ২০১৭ সালে পাঁচ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ২৩ দশমিক ২৫ শতাংশ বিক্রয় প্রবৃদ্ধি অর্জন করে বিএটিবিসি। ওই বছর কোম্পানিটির সিগারেট ও তামাক বিক্রি হয় ২০ হাজার ৪১৪ কোটি টাকার।
বিক্রি বাড়ার সুবাদে কোম্পানিটির কর-পরবর্তী মুনাফাও স্ফীত হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৪ সালে কোম্পানিটির মুনাফা ছিল ৬২৮ কোটি টাকা। ২০১৫ সালে এসে এর পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৭৮৩ কোটি টাকায়। তবে ২০১৬ সালে কোম্পানিটির মুনাফা কিছুটা কমে ৭৫৮ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। এর পরের বছর ২০১৭ সালে কোম্পানিটির মুনাফা বেড়ে ৭৮৩ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। আর সর্বশেষ ২০১৮ সালে বিএটিবিসির মুনাফা হয়েছে ১ হাজার ১ কোটি টাকা।
ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো ১৯৭৭ সালে দেশের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। বর্তমানে এর পরিশোধিত মূলধন ১৮০ কোটি টাকা। রিজার্ভে আছে ২ হাজার ৮৯২ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও শিল্প মন্ত্রণালয়সহ সরকারের কাছে বিএটিবিসির ১০ দশমিক ৮৪ শতাংশ শেয়ারের মালিকানা রয়েছে। এর মধ্যে ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) কাছে রয়েছে ৭ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ শেয়ার। যদিও আইসিবি গঠন হওয়ার পর সরকারি অংশের বেশির ভাগ শেয়ার প্রতিষ্ঠানটিতে স্থানান্তর করা হয়। ২০১০ সালে আইসিবির হাতে বিএটিবিসির ১৭ দশমিক ৪১ শতাংশ শেয়ার ছিল। পরবর্তী সময়ে ১০ শতাংশের বেশি শেয়ার বিএটিবিসির মূল উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান রেলিহ ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানির কাছে বিক্রি করে দেয় আইসিবি। সরকারের উল্লেখযোগ্য শেয়ারের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সাধারণ বীমা করপোরেশনের কাছে রয়েছে ২ দশমিক ৮২ শতাংশ, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেডের কাছে দশমিক ৩৩ ও সরাসরি বাংলাদেশ সরকারের কাছে রয়েছে দশমিক ৬৪ শতাংশ শেয়ার; যা নিয়ন্ত্রণ করছে শিল্প মন্ত্রণালয়। এর বাইরে বিদেশীদের কাছে ১৪ দশমিক ৬০ ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে ২ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ শেয়ার রয়েছে।
তামাকজাত পণ্য নিরুৎসাহিত করার কর্মসূচির মধ্যেও বিএটিবিসির বিক্রয় বাড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আবদুল হালিম বলেন, উচ্চহারে করারোপের কারণে টাকার অংকে বিএটিবিসির বিক্রি বেড়েছে। তবে আপনি যদি সিগারেট বিক্রির সংখ্যা হিসাব করেন, তাহলে দেখবেন সেটি কিন্তু কমছে। তাই সরকার তামাক নিরুৎসাহিত করতে যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, সেগুলো ঠিক আছে। আর মুনাফা বাড়ার বিষয়টি টাকার মূল্যমানের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে।
সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত তামাকজাত দ্রব্য উৎপাদন ও ব্যবহার বন্ধের জন্য ২০ বছর মেয়াদি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিলেন। এজন্য তিনি শিল্পমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী, কৃষিমন্ত্রী, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী, বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদ সচিব এবং প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের কাছে চিঠিও পাঠিয়েছিলেন। এ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে একটি নির্দিষ্ট সময়ে বিএটি বাংলাদেশ থেকে সরকারি শেয়ার তুলে নেয়া দরকারের কথা জানান তিনি। তার বক্তব্য ছিল, ২০৪১ সালে আমাদের দেশে তামাক উৎপাদন ও ব্যবহার হবে না। এটা খুবই কঠোর ও উচ্চাভিলাষী সিদ্ধান্ত। তবে জনস্বার্থে এটি অত্যন্ত মূল্যবান সিদ্ধান্ত। এ লক্ষ্যে বাজেটেও সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা থাকার কথাও জানিয়েছিলেন তিনি।
উল্লেখ্য, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) ‘ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল’-এ স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে তামাকজাত দ্রব্যের উৎপাদন, ব্যবহার, ক্রয়-বিক্রয় ও বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে ২০০৫ সালে আইন করে সরকার। যদিও এর প্রয়োগ সীমিত। তামাক উৎপাদন ও এর ব্যবহার নিরুৎসাহিত করার প্রক্রিয়াটি শুধু প্রচারণায়ই সীমাবদ্ধ। এর প্রমাণ পাওয়া যায় এ খাতের সবচেয়ে বড় কোম্পানি বিএটিবিসির তামাকজাত পণ্যের বিক্রয় পরিসংখ্যানে। কারণ দেশে সিগারেট বিক্রির প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই করে বিএটিবিসি।