দেশবন্ধু সুগারকে ১৩২ কোটি টাকা পরিশোধের নির্দেশ
বন্ড সুবিধা নিয়ে আমদানিকৃত অপরিশোধিত চিনি অবৈধভাবে ওয়্যারহাউজ থেকে অপসারণের মাধ্যমে রাজস্ব ফাঁকি দেয়ার একটি অভিযোগে দেশবন্ধু সুগার মিলস লিমিটেডের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছে এনবিআরের বন্ড কমিশনারেটের আপিল বিভাগ।
রায়ে কোম্পানিটিকে ১১২ কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে কাস্টমস আইন লঙ্ঘন করার অপরাধে ২০ কোটি টাকা জরিমানাসহ মোট ১৩২ কোটি টাকা পরিশোধের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
এনবিআর কর্মকর্তারা বলছেন, স্থানীয় শিল্প বিকাশে প্রণোদনা হিসেবে কাঁচামাল আমদানিতে বন্ড সুবিধা দেয় সরকার। এর আওতায় একসঙ্গে বেশি পরিমাণ কাঁচামাল শুল্কমুক্তভাবে আমদানি করতে পারেন শিল্প মালিকরা। পরবর্তী সময়ে শুল্ক, ভ্যাট ও অন্যান্য কর পরিশোধ করে এনবিআরের তত্ত্বাবধানে ওই কাঁচামাল ব্যবহারের সুযোগ পায় কোম্পানিগুলো।
তবে দেশবন্ধু সুগার বারবার এ নিয়ম লঙ্ঘন করে বন্ডেড ওয়্যারহাউজ থেকে অপরিশোধিত চিনি অপসারণ করে রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে। সবশেষ চলতি বছরের আগস্ট মাসে কোম্পানিটির বিরুদ্ধে ২৪১ কোটি টাকার অপরিশোধিত চিনি অবৈধভাবে অপসারণের অভিযোগে দুটি মামলা হয়।
মামলায় কোম্পানির বিরুদ্ধে ১১০ কোটি টাকা শুল্ক ফাঁকির অভিযোগ আনে বন্ড কমিশনারেটের প্রিভেন্টিভ টিম। পরবর্তী সময়ে শুনানি শেষে ২০ কোটি টাকা জরিমানাসহ কোম্পানিটিকে মোট ১৩২ কোটি টাকা পরিশোধে নির্দেশনা দিয়েছে বন্ড কমিশনারেটের আপিল বিভাগ।
এনবিআরের ঢাকা বন্ড কমিশনারেটের কমিশনার ড. আল আমিন প্রামাণিক বলেন, দেশবন্ধু সুগারের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি অভিযোগে প্রায় ৪৫০ কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকির অভিযোগ রয়েছে। দুটি অভিযোগ কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট আপিলাত ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন রয়েছে।
সম্প্রতি বন্ড কমিশনারেটের আপিল বিভাগে শুনানি শেষে ১১০ কোটি টাকা ফাঁকির একটি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। শুনানিতে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ নিজেদের অনিয়ম মেনে নিয়েছে।
ফলে তাদের বিরুদ্ধে সুদ ও জরিমানাসহ মোট ১৩২ কোটি টাকা পরিশোধে ১৫ কার্যদিবস সময় দিয়ে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। তবে দেশবন্ধু সুগার চাইলে তিন মাসের মধ্যে এ আদেশের বিরুদ্ধে কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট আপিলাত ট্রাইব্যুনালে পুনরায় আবেদন করতে পারবে।
এনবিআর সূত্র জানায়, কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট ঢাকা কার্যালয়ের প্রিভেন্টিভ টিম গত ১৩ আগস্ট দেশবন্ধু সুগারের বিরুদ্ধে দুটি মামলা করে। এর মধ্যে একটিতে ৪৬ হাজার ২৭৫ টন চিনি বন্ডেড ওয়্যারহাউজে কম পাওয়ায় ৬২ কোটি ৭৩ লাখ টাকা রাজস্ব ফাঁকির অভিযোগ আনা হয়েছে।
অন্য মামলায় বলা হয়, দেশবন্ধু সুগার মিলস ২১টি বিল অব এন্ট্রির মাধ্যমে ৩৫ হাজার ৬৫ টন চিনি আমদানি করলেও তা বন্ড রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ না করে রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে কোম্পানিটি ৪৮ কোটি ৪৫ লাখ টাকার রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে বলে অভিযোগ করেছে বন্ড কমিশনারেটের প্রিভেন্টিভ টিম। সব মিলিয়ে দুটি মামলায় ২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা সুদসহ মোট ১১২ কোটি ৯৮ লাখ টাকা দাবিনামা জারি করা হয়েছিল।
এনবিআর মামলা করলেও এটিকে হিসাবের গরমিল বলে দাবি করছে দেশবন্ধু সুগার। কোম্পানির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, বন্ড কমিশনারেট থেকে প্রায়ই কারখানায় তদন্ত টিম আসে। তারা তদন্ত করে প্রতিবারই দাবিনামা জারি করে।
পরবর্তী সময়ে আমরা শুনানিতেও অংশগ্রহণ করি। প্রায় সব শুনানিতেই আমরা বলে আসছি, অপরিশোধিত চিনি বন্ডেড ওয়্যারহাউজে রেখে ব্যবহারের ক্ষেত্রে টাইমিংয়ের সমস্যা হচ্ছে। আমরা নিয়ম অনুযায়ী রাজস্ব পরিশোধে আগ্রহী। এনবিআরের তদন্ত নিয়ে আমাদের আপত্তি রয়েছে। তবে এখন আমাদের অবশ্যই কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট আপিলাত ট্রাইব্যুনালে আপিল করতে হবে।
নরসিংদীর পলাশ উপজেলার চরসিন্দুরে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে অবস্থিত মেসার্স দেশবন্ধু সুগার মিলস লিমিটেডকে ২০০৯ সালে বন্ড লাইন্সেস দেয় এনবিআর। এর আওতায় কাঁচামাল হিসেবে বিদেশ থেকে অপরিশোধিত চিনি এনে পরিশোধনের পর বাজারজাত করছে প্রতিষ্ঠানটি।
তবে দীর্ঘদিন ধরেই কোম্পানিটির বিরুদ্ধে বন্ড সুবিধা অপব্যবহারের অভিযোগ করে আসছে এনবিআর। গত দুই বছরে কোম্পানিটির কারখানায় বেশ কয়েকটি অভিযান চালিয়ে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকির অভিযোগে মামলা করা হয়েছে।
এর মধ্যে ২০১৭ সালের দুটি মামলায় কোম্পানিটির বিরুদ্ধে ১৫৭ কোটি ৩৩ লাখ টাকা ও চলতি বছরের শুরুতে একটি মামলায় ৭২ কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকির অভিযোগ তোলা হয়। মামলা দুটি বর্তমানে আপিলাত ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন রয়েছে।
১৯৩২ সালে প্রতিষ্ঠিত দেশবন্ধু সুগার মিলস ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে নেয়া হয়। এরপর কারখানাটি ব্যক্তিমালিকানায় আসে ২০০৮ সালে। দেশের প্রথম রিফাইন্ড সুগার কারখানা হলেও এখনো লোকসান থেকে বের হতে পারেনি দেশবন্ধু সুগার মিলস। ব্যক্তিমালিকানায় আসার পর চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত ১০ লাখ ২৩ হাজার টন পরিশোধিত চিনি বিক্রি করেছে তারা। উৎপাদন সক্ষমতার শতভাগ ব্যবহার করতে না পারা ও উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় গত ১০ বছরে ৭৬৩ কোটি টাকা লোকসানে রয়েছে বলে দাবি করছে কোম্পানিটি।