দেশবন্ধু গ্রুপে নতুন বিনিয়োগ আসছে ১০ হাজার কোটি টাকা

স্টাফ রিপোর্টার

প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা নতুন বিনিয়োগের পরিকল্পনা নিয়েছে দেশবন্ধু গ্রুপ। এই বিনিয়োগের ফলে প্রায় ১৫ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান বাড়বে। নতুন করে চিনি কারখানা স্থাপন, ওয়েস্টার্ন ফুটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রি, এফআইবিসি কারখানা স্থাপন, পিএসএফ অ্যান্ড পিইটি ইন্ডাস্ট্রিজ, স্টিল মিলস, কনজুমার গুডস, ইলেকট্রিক ভেহিকেলস অ্যাসেম্বলি প্ল্যান্ট, ইকো ব্রিক্স ইন্ডাস্ট্রি ও লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি প্ল্যান্টে এই বিনিয়োগ করা হবে।

নতুন বিনিয়োগের পাশাপাশি দেশবন্ধু সুগার মিলস, দেশবন্ধু বেভারেজ, দেশবন্ধু পলিমার, দেশবন্ধু কনজুমার, দেশবন্ধু প্যাকেজিং, দেশবন্ধু সিমেন্ট মিলস, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও দেশবন্ধু টেক্সটাইল মিলসসহ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন ও উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়েছে গ্রুপটি। বর্তমানে দেশবন্ধু গ্রুপের জনবল প্রায় ২৫ হাজার। নতুন বিনিয়োগে তা বেড়ে ৪০ হাজার হয়ে যাবে। দেশবন্ধু গ্রুপের সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

দেশবন্ধু গ্রুপের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, দেশের বর্তমান চিনির চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি রপ্তানির লক্ষ্যে বর্তমান মিলের পাশাপাশি ইউরোপীয় স্ট্যান্ডার্ড ১৫০০ টন ক্যাপাসিটি নতুন আরও একটি মিলস্ স্থাপনের জন্য মেশিনারিজ সিলেকশন প্ল্যান্ট পরিকল্পনা ও সার্বিক ফিজিবিলিটি স্টাডি করে দরপত্র সংগ্রহ করা হয়েছে। এক হাজার ৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগে আগামী ২০২৬ সালের মধ্যে বাস্তবায়নের কাজ চলছে।

দেশবন্ধু গ্রুপের ব্যবসায়িক পরিধি সম্প্রসারণের অংশ হিসেবে আরও ৫০০ কোটি টাকা নতুন বিনিয়োগের মাধ্যমে ১০০ ভাগ রপ্তানি উপযোগী এফআইবিসি ব্যাগ উৎপাদনের জন্য এরই মধ্যে অবকাঠামোগত নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে। সম্পূর্ণ ইউরোপীয় স্ট্যান্ডার্ড অটোমেটেট মেশিনারি দিয়ে ২০২৪ সালের জুনে উৎপাদন শুরুর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এতে দুই হাজার স্থানীয় লোকের নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে।

নরসিংদীর পলাশ থানার অন্তর্গত তালতলীতে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের মাধ্যমে ওয়েস্টার্ন ফুটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রি স্থাপন করে উৎপাদন চলছে, যা গ্রামীণ অর্থনীতি উন্নয়ন, বেকার সমস্যা সমাধান ও নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে অবদান রাখছে। নরসিংদীর মালিতায় আরও ৫০০ টন ক্ষমতাসম্পন্ন অপরিশোধিত তেল শোধনাগার স্থাপন ও উৎপাদন পরিকল্পনা বাস্তবায়নাধীন।

সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুলে প্রায় ৫০ একর জায়গাজুড়ে দেশবন্ধু স্টিল রি-রোলিং মিলস, কনজুমার গুডস, ইলেকট্রিক ভেহিকেলস্ অ্যাসেম্বলি প্ল্যান্ট, ইকো ব্রিক্স ইন্ডাস্ট্রি, লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি প্ল্যান্টের জন্য দুই হাজার ৫০০ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে, যেখানে ২০২৮ সালের মধ্যে পুরোদমে উৎপাদন চালুর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এতে আরও প্রায় পাঁচ হাজার লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।

গ্রুপের বাস্তবায়নাধীন আরও যেসব প্রকল্প রয়েছে, এর মধ্যে মোংলা বন্দরের পাশেই পাওয়ার প্যাক ইকোনমিক জোন, মোংলায় ৩৩ একর জায়গাজুড়ে পিএসএফ অ্যান্ড পিইটি ইন্ডাস্ট্রিজ স্থাপনের কার্যক্রমের অংশ হিসেবে টেকনিক্যাল পাটনার ক্যামট্যাক্স সাংহাই (চায়না) ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড এবং চায়না ন্যাশনাল কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেডের (সি অ্যান্ড সিইসি) সঙ্গে ৫০০ মিলিয়ন ইউএসডি ডলার বিনিয়োগ চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে। এখানে প্রায় দুই হাজার লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।

এছাড়া অন্যান্য ব্যবসায়িক কলেবর বৃদ্ধির পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ডেভেলপমেন্ট অব প্রাইভেট ইকোনমিক জোন (পিপিপি), দেশবন্ধু ফার্মাসিউটিক্যালস, সোলার প্যানেল ম্যানুফ্যাকচারিং প্ল্যান্ট, অ্যানিমেল ফিড ইন্ডাস্ট্রি ছাড়াও দেশের ৬৪টি মেডিকেল সেন্টার প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা রয়েছে গ্রুপটির।

দেশবন্ধু গ্রুপের সিনিয়র জেনারেল ম্যানেজার মোহাম্মদ আরিফ হোসেন বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভিশন-২০৪১ বাস্তবায়নে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতে শীর্ষ বিনিয়োগকারীদের অন্যতম দেশবন্ধু গ্রুপ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও নতুন উৎপাদনমুখী নানা প্রকল্পে বিনিয়োগ অব্যাহত রেখেছে। করোনা মহামারির শুরু থেকে বর্তমান পর্যন্ত কোনো কর্মীর কাজ হারাতে হয়নি। উল্টো শত শত নতুন কর্মীর কর্মসংস্থান হয়েছে দেশবন্ধু গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে।

সম্প্রতি দেশবন্ধু গ্রুপের কয়েকটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশবন্ধু গ্রুপের নরসিংদীর চরসিন্দুর পলাশ শিল্প এলাকায় অবস্থিত সব কারখানায় চলছে কর্মযজ্ঞ।

দেশবন্ধু গ্রুপের পলাশ এরিয়ার আবাসিক পরিচালক প্রকৌশলী এবিএম আরশাদ হোসেন বলেন, করোনায় বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রতিটি দেশই বিপর্যস্ত। এমন বাস্তবতায় অভ্যন্তরীণ উৎপাদন অব্যাহত রেখে দেশ ও দেশের মানুষের সেবায় কাজ করে যাচ্ছে দেশবন্ধু গ্রুপ।

তিনি বলেন, শুধু ব্যবসায়িক লাভের জন্য নয়, দেশের মানুষের পাশে থাকার জন্য চিনি, কনজুমার ফুড, বেভারেজসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্য উৎপাদন করে যাচ্ছে। শুধু অভ্যন্তরীণ নয়, রপ্তানিকৃত সব ধরনের পণ্য উৎপাদন ও সরবরাহ প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছে দেশবন্ধু গ্রুপ। দেশবন্ধু চিনিকলটি পুরনো এবং দেশের একটি ঐতিহ্যবাহী চিনিকল। এটি ১৯৩২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে মিলটির দৈনিক উৎপাদন ক্ষমতা এক হাজার ৫০০ টন। অর্থাৎ বছরে সাড়ে চার লাখ টন চিনি উৎপাদিত হচ্ছে কারখানায়।

তিনি আরও জানান, দেশের একমাত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেশবন্ধু চিনিকল ইউরোপীয় কমিশনের ইবিএ-এর আওতায় ইউরোপে সর্বপ্রথম দেশি চিনি রপ্তানি শুরু করে এবং তা অব্যাহত রয়েছে। দেশবন্ধু ফুড অ্যান্ড বেভারেজের উৎপাদিত দেশবন্ধু মিনারেল ওয়াটার সারাদেশে ব্যাপক চাহিদা তৈরি করেছে। ফলে দেশবন্ধু বেভারেজ কারখানার নতুন সেকশনসহ সার্বিক উন্নয়নে করোনার মধ্যেই ৫০০ কোটি টাকার বেশি নতুন বিনিয়োগ করেছে। কারখানায় উন্নত প্রযুক্তির ইটালিয়ান মেশিনারিজ স্থাপন করা হয়েছে। এতে উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।

দেশবন্ধু গ্রুপের সিনিয়র জিএম মোহাম্মদ আরিফ হোসেন বলেন, উন্নতমানের রিফাইন্ড সুগার, বেভারেজ তৈরিতে যেসব কাঁচামাল ব্যবহৃত হয়, তার সবই আমরা অস্ট্রেলিয়া, ইতালি ও ব্রাজিলসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করে থাকি। দেশবন্ধু বেভারেজের নিজস্ব কারখানায় উৎপাদিত পণ্যের মধ্যে রয়েছে দেশবন্ধু মিনারেল ওয়াটার, দেশবন্ধু কোলা, ফ্রেন্ডস আপ, দেশবন্ধু লিচি, দেশবন্ধু জিরা, দেশবন্ধু অরেঞ্জ, দেশবন্ধু ম্যাংগো জুস, গুরু ও নিয়নসহ মোট ১৮টি ফ্লেভার।

তিনি আরও বলেন, দেশবন্ধু বেভারেজে উৎপাদিত পণ্য দেশে বিক্রি ছাড়াও মধ্য এশিয়ার উন্নত দেশ দুবাই, থাইল্যান্ড, শ্রীলংকা, মালয়েশিয়া, গ্রিসেও রপ্তানি হচ্ছে। এছাড়া নুডলস তৈরির প্ল্যান্টও বাস্তবায়নের পরিকল্পনা ছিল, যা করোনা মহামারির কারণে হয়নি। অচিরেই তা বাস্তবায়িত হবে আশা করা যায়।

এদিকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত গ্রুপের একমাত্র শিল্পপ্রতিষ্ঠান দেশবন্ধু পলিমার লিমিটেড। দেশবন্ধু পলিমারের মহাব্যবস্থাপক ইঞ্জিনিয়ার সাখাওয়াত হোসেন জানান, দেশবন্ধু সুগার মিলস চালু হওয়ার পর মোড়কের জন্য প্রতি বছর প্রায় ৫০ থেকে ৬৫ লাখ চিনির ব্যাগ প্রয়োজন হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৬ সালে দেশবন্ধু পলিমার লিমিটেড কারখানা স্থাপন করা হয়।

তিনি বলেন, অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হচ্ছে দেশবন্ধু পলিমার ও দেশবন্ধু প্যাকেজিংয়ের ডব্লিউপিপি ব্যাগ সিঙ্গেল এবং ডাবল প্লাই সিমেন্ট ব্যাগ, বিওপিপি (সুইং এবং পেস্টিং) এবং এফআইবিসি ব্যাগ।

দেশবন্ধু গ্রুপের চেয়ারম্যান শিল্পপতি গোলাম মোস্তফা বলেন, এক সময়ের তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে আজকের বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত, যা দেশের বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও উদ্যোক্তাদের হাত ধরেই হয়েছে। দেশবন্ধু গ্রুপ চেষ্টা করছে দেশ ও জনগণের জন্য কিছু করার। দেশবন্ধু গ্রুপের বিনিয়োগে বর্তমানে ২৫ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। নতুন পরিসরে আরও ব্যাপক বিনিয়োগের চেষ্টা চলছে। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী ২০২৮ সালে কর্মসংস্থান ৪০ হাজার ছাড়িয়ে যাবে।

তিনি বলেন, দেশবন্ধু গ্রুপ বেশিরভাগ পণ্য রপ্তানি করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। আগামী চার বছর পর বছরে এক বিলিয়নের বেশি টাকার পণ্য রপ্তানি করবে দেশবন্ধু গ্রুপ।

তিনি আরও বলেন, ঢালাওভাবে দেশের সব ব্যবসায়ী খারাপ না, আবার ভালোও নয়। দেশবন্ধু গ্রুপ সরকারের রুগ্ন শিল্প বেসরকারিকরণের মাধ্যমে নিয়ে তা চালু করে এক অনন্য নিদর্শন সৃষ্টি করেছে। তার উজ্জ্বল উদাহরণ হলো দেশবন্ধু সুগার মিল। ক্রমাগত লোকসানে ১৯৯৫ সালে মিলটি বন্ধ হওয়ার পর সরকারের বেসরকারিকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ২০০১ সালে দেশবন্ধু গ্রুপ মিলটি ক্রয় করে চালু করে। বর্তমানে একই ধরনের আরও একটি মিল প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম চলছে।

বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঋণ প্রসঙ্গে গোলাম মোস্তফা বলেন, দুর্বল অবকাঠামো ও সেবাখাতের ধীরগতির কারণে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে অতিরিক্ত সুদে ঋণ নিয়ে কারখানাগুলো বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করে, তা থেকে আয় করে, ব্যাংকে ফেরত দেওয়া সময়সাপেক্ষ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। স্বল্প সময়ে ফেরত দেওয়া কঠিন হয়ে যায়। এরই মধ্যে আবার নতুন সংযোজিত আন্তর্জাতিক ক্রেতা আরোপিত অ্যাকর্ড অ্যালায়েন্সসহ অন্যান্য কমপ্লায়েন্স সনদ দিতে প্রায় দুই বছর নিয়ে নেয়। এখানে দেখা যাচ্ছে, অধিকাংশ শিল্প মালিক বা উদ্যোক্তা ব্যাংকের কর্মচারীর মতো কাজ করেই যাচ্ছেন। বাস্তবে যেভাবে এগিয়ে যাওয়ার কথা, সেভাবে এগোতে পারছে না।

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে শিল্পায়নের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো স্বল্প সময়ের জন্য এফডিআর নিয়ে কয়েক বছরের জন্য প্রকল্প ঋণ দিয়ে থাকে, যা একটি ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ। কারণ, বাংলাদেশ এখন আর একেবারেই ছোট অর্থনীতির দেশ নয়। একেকটি কারখানার কয়েকশ থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ করতে হয়। ইকোনমিক স্কেলে ছোট কারখানাগুলো সারা পৃথিবীতে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *