তৈরি পোশাকে ভর করে সর্বোচ্চ রপ্তানি

স্টাফ রিপোর্টার

করোনা মহামারির ধাক্কা না কাটতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে দেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক শিল্পে তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা। একদিকে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটে উৎপাদন অর্ধেকে নামার কথা জানিয়েছেন শিল্প উদ্যোক্তারা। অন্যদিকে অর্থনৈতিক মন্দার কারণে ক্রয়াদেশ কমিয়ে দিচ্ছেন বিদেশি ক্রেতারা, এমনটা দাবি পোশাক খাতের উদ্যোক্তাদের।

এমন পরিস্থিতিতে শিল্পকারখানায় ৫ শতাংশ গ্যাসে চাপ বাড়ানোর কথা বলছেন তারা। তা না হলে আর্থিক সংকটে পড়ে অনেক কারখানাই শ্রমিকদের ঠিক সময়ে মজুরি দিতে পারবে না। এছাড়া বন্ধ হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে বলেও দাবি তাদের। এমন অবস্থায় সদ্য শেষ হওয়া নভেম্বর মাসে রপ্তানি আয় থেকে রেকর্ড আয় হয়েছে।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, নভেম্বর মাসে ৫০৯ কোটি ২৫ লাখ ডলারের বা ৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছেন রপ্তানিকারকরা। এই আয় গত বছরের নভেম্বরের চেয়ে ২৬ শতাংশ বেশি, আর লক্ষ্য মাত্রার চেয়ে বেশি ১৭ শতাংশ।

গত নভেম্বরে রপ্তানির লক্ষ্য ছিল ৪৩৫ কোটি ডলার। আর গত বছরের নভেম্বরে রপ্তানি আয় ছিল ৪০৪ কোটি ডলার

তৈরি পোশাকে উল্লম্ফন, অন্য খাতে লেজেগোবরে

দেশের ইতিহাসে এর আগে কোনো মাসেই পণ্য রপ্তানি থেকে এত আয় করা সম্ভব হয়নি। সর্বশেষ ২০২১ সালের ডিসেম্বরে ৪৯০ কোটি (৪.৯০ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছিল। রপ্তানি বাণিজ্যে এই রেকর্ডের পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে তৈরি পোশাক খাত।

নভেম্বর মাসে মোট রপ্তানি আয়ের ৮৬ শতাংশই এসেছে তৈরি পোশাক থেকে

ইপিবির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, জুলাই-নভেম্বর এই ৫ মাসে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ১৮ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলার। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১৫ দশমিক ৬১ শতাংশ বেশি। আর লক্ষ্যমাত্রার ৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ বেশি। ওভেন পোশাক থেকে এসেছে ৮ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলার। এখাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৯ দশমিক ৬১ শতাংশ। আর লক্ষ্যের চেয়ে বেশি আয় হয়েছে ৩ দশমিক ২৭ শতাংশ। এদিকে নিট পোশাক থেকে এসেছে ১০ দশমিক ১১ বিলিয়ন ডলার। এখাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১২ দশমিক ৫৫ শতাংশ।।

তৈরি পোশাক ছাড়া অন্য বড় খাতগুলোর মধ্যে শুধু চামড়া ও চামড়াজাতপণ্য রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এই খাত থেকে জুলাই-নভেম্বর এই ৫ মাসে ৫৩ কোটি ৭৫ লাখ ডলার আয় হয়েছে। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ।

অর্থবছরের ৫ মাসে পাট ও পাটজাতপণ্য রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ৪০ কোটি ৬৬ লাখ ডলার। গত বছরের একই সময়ের চেয়ে কমেছে প্রায় ৩ শতাংশ।

হোম টেক্সটাইলে প্রায় ৮ শতাংশ, কৃষিপণ্যে ২৩ শতাংশ, হিমায়িত মাছে ২৭ দশমিক ৩৯ শতাংশ, ওষুধে ১৮ দশমিক, সিরামিকে ৭ দশমিক ৭৩ শতাংশ, গ্লাস ওয়্যারে ৫৯ দশমিক ৩৮ শতাংশ নেতিবাচক রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিবিএল সিরামিকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আব্দুল জাব্বার জাগো নিউজকে বলেন, গ্যাসের এই সমস্যা তো লংটার্ম (দীর্ঘদিন) থাকবে না। রপ্তানিতে প্রভাব পড়ছে ঠিকই। এটা হয়তো সাময়িক।

তিনি বলেন, এটা আমরা কাটিয়ে উঠবো। তবে পরিস্থিতির দিকে নজর রাখছেন অনেক বিনিয়োগকারী। ভালো হলে তারা বিনিয়োগে যাবে। তখন আমাদের রপ্তানিও বাড়বে

ইপিবির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) ২ হাজার ১৯৪ কোটি ৬০ লাখ (২১.৯৪ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছেন দেশের উদ্যোক্তারা। মোট রপ্তানি আয়ের মধ্যে প্রায় সাড়ে ৮৩ শতাংশই এসেছে তৈরি পোশাক থেকে।

আর নভেম্বর মাসে ৪৩৮ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করা হয়েছে। যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৩১ দশমিক ৩৮ শতাংশ বেশি।

বিস্মিত উদ্যোক্তারাও

প্রায় চার মাস ধরে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটের কারণে উৎপাদন ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ব্যাহত হওয়ার কথা জানিয়েছিলেন উদ্যোক্তারা। ইউরোপে যুদ্ধের কারণে পোশাক রপ্তানির সবচেয়ে বড় বাজার ইউরোপে-আমেরিকায় অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেওয়ায় ক্রয়াদেশও কমে আসছিল বলে তাদের পক্ষ থেকে জানানো হচ্ছিল।

সম্প্রতি রপ্তানি ট্রফি প্রদান অনুষ্ঠানে শিল্প উদ্যোক্তা এ কে আজাদ বলেন, ইউরোপে যুদ্ধের কারণে ব্যবসায় মন্দা দেখা দিয়েছে। পোশাক রপ্তানির সময় ১ শতাংশ হারে উৎসে কর কেটে নেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে যুদ্ধের কারণে ইউরোপ থেকে ক্রয়াদেশে কমেছে। আগামী বছর ২০-৩০ শতাংশ ক্রয়াদেশ কমবে। এতে রপ্তানিতে বড় একটা আঘাতের শঙ্কায় রয়েছি আমরা। এ অবস্থায় গ্যাস-বিদ্যুতের সমস্যার কারণে বিদ্যমান ক্রয়াদেশের পণ্য উৎপাদনও ঝুঁকিতে পড়ছে।

জানতে চাইলে বিকেএমইএর সহ-সভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, সরকারের কাজে (ইপিবির তথ্যে) সন্দেহ প্রকাশ করছি না। পোশাক খাতের এই আয় আমাদের কাছে খুব বিস্ময়কর। ৯০ শতাংশ মালিকই বিপদের মধ্যে আছেন। কেউ কেউ হয়তো খুব ভালো করছেন।

পোশাক খাতে সাড়ে ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, হতে পারে বড়রা ভালো করছে। বড় বড় ২০০ ফ্যাক্টরি ভালো করছে। ছোট ফ্যাক্টরি আছে ১ হাজার৮০০টি, আমি তাদের কথা শুনছি। যে ভালো আছে সেতো আর এসে বলবে না। যে ভালো থাকে সে কখনো বলে না, যে খারাপ থাকে সেই কান্নাকাটি করে।

আগামীতে পোশাকের বাজার চাঙা হওয়ার আশাবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, এখনো মার্কেটটা ঘোরেনি। ইনকোয়ারি আসছে। অর্ডার আশা শুরু হয়নি। ইউরোপের মন্দা যতদিন না ঘুরবে ততদিন খুব বেশি বিক্রয়াদেশ বাড়বে না। আগামীতে ওদের ইনভেনট্রিটা কমবে। তখন তাদের পণ্য লাগবে। জিওপলিটিক্যাল কারণে তখন তারা চীনের থেকে বাংলাদেশে বেশি মনোযোগ দেবে। ওই হিসাবে আমরা কিছুটা ভালো অবস্থানে থাকবো।

তিনি বলেন, শিল্পকারখানায় এখন আর বিদ্যুৎ সংকট নেই। গ্যাসের চাপও বাড়ছে। নতুন এলএনজি আসলে কী হবে, সেটা পরে দেখা যাবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *