ডিম-মুরগির দাম ‘কমে যাওয়ায়’ প্রান্তিক খামারিদের ৬ প্রস্তাব

স্টাফ রিপোর্টার

চলতি মাসে ডিমের দাম অস্বাভাবিক কমে যাওয়ায় অনেক খামারি মুরগি বিক্রি করে দিচ্ছেন। প্রতি বছর তিন থেকে চারবার ডিম-মুরগির দামের দরপতন হচ্ছে, অনেকে সর্বস্ব হারিয়ে পথে বসছেন। খামারির সুরক্ষা, উৎপাদন বৃদ্ধি ও বাজারমূল্য স্থিতিশীল রাখার স্বার্থে এ পরিস্থিতির ইতিবাচক পরিবর্তন প্রয়োজন।

সোমবার (২৪ মার্চ) রাজধানীর একটি হোটেলে পোল্ট্রি ও প্রাণিসম্পদ বিটের সাংবাদিকদের সঙ্গে এক মতবিনিময় অনুষ্ঠানে পোল্ট্রি নেতারা এ কথা বলেন। বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি) ও ওয়ার্ল্ডস পোল্ট্রি সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন-বাংলাদেশ শাখা (ওয়াপসা-বিবি) এ মতবিনিময় সভার আয়োজন করে।

এ সময় তৃণমূল খামারিদের ঝরে পড়া রোধে ৬টি প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়। প্রস্তাবগুলো হচ্ছে

১. স্বল্পসুদে ঋণপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে
২. সরকারিভাবে ডিম-মুরগির ‘সর্বোচ্চ বিক্রয়মূল্য” নির্ধারণের পাশাপাশি ‘সর্বনিম্ন মূল্য’ নির্ধারণ করতে হবে
৩. কোল্ডস্টোরে ডিম সংরক্ষণের সরকারি বাধা প্রত্যাহার করতে হবে
৪. অফ-সিজনে তৃণমূল খামারিদের জন্য ভর্তুকির ব্যবস্থা করতে হবে
৫. ফিডের দাম কমাতে এআইটি, টিডিএস, ভিডিএস হার শূন্য করতে হবে এবং
৬. ডিম-মুরগির উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিপণনবিষয়ক কৌশলপত্র প্রণয়ন করতে হবে।

ওয়াপসা-বাংলাদেশ শাখার সভাপতি মসিউর রহমান বলেন, রাজধানীর খুচরা বাজারে প্রতিটি ডিম ১০ টাকা থেকে সাড়ে ১০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। ঢাকা, ময়মনসিংহসহ পার্শ্ববর্তী এলাকায় খামার পর্যায়ে প্রতিটি ডিম বিক্রি হয়েছে গড়ে ৮ টাকা ৫০ পয়সায়। অন্যদিকে টাঙ্গাইল ও নরসিংদীসহ অন্যান্য জেলায় বিক্রি হয়েছে গড়ে প্রায় ৮ টাকায়। কৃষি বিপণন অধিদপ্তর প্রতিটি ডিমের মূল্য নির্ধারণ করেছে- খামার পর্যায়ে ১০ টাকা ৫৮ পয়সা, পাইকারিতে ১১ টাকা ১ পয়সা ও খুচরা পর্যায়ে ১১ টাকা ৮৭ পয়সা (সংযুক্তি)। প্রতিটি ডিমের উৎপাদন খরচ ধরা হয়েছে ১০ টাকা ১৯ পয়সা। সে হিসাবে প্রতিটি ডিম বিক্রি করে খামারির লোকসান হচ্ছে গড়ে প্রায় ১ টাকা ৬৯ পয়সা থেকে ২ টাকা ১৯ পয়সা।

তিনি বলেন, ডিমের দৈনিক উৎপাদন সাড়ে চর কোটি পিস ধরলে, গত ২১ দিনে খামারির লোকসান দাঁড়িয়েছে ১৫৯ থেকে ২০৬ কোটি টাকা। লোকসান সামাল দিতে না পেরে অনেক খামারি মুরগি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন- যা অত্যন্ত আশঙ্কাজনক কারণ রমজান শেষে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত খুললে চাহিদা বাড়বে আর তখন সরবরাহে ঘাটতি তৈরি হলে দাম বাড়বে।

মসিউর বলেন, বিশ্বের বেশিরভাগ দেশের তুলনায় বাংলাদেশে ডিমের দাম কম। পার্শ্ববর্তী দেশে ডিমের দাম কম বলা হলেও প্রকৃত বিচারে কম নয়, কারণ তাদের ডিমের দাম ১০ শতাংশ কম হলে ডিমের ওজনও ১৩ শতাংশ কম। তাছাড়া তারা যে মানের ফিড খাইয়ে ডিম উৎপাদন করে সে তুলনায় বাংলাদেশের ফিডের মান অনেক ভালো।

ওয়াপসা-বিবির সাধারণ সম্পাদক বিপ্লব কুমার প্রামাণিক বলেন, পার্শ্ববর্তী দেশের তুলনায় বাংলাদেশে উৎপাদিত ডিম অনেক নিরাপদ কারণ তাদের ফিডে অ্যান্টিবায়োটিক গ্রোথ প্রোমোটার ও মিট অ্যান্ড বোনমিল ব্যবহার করা হয় কিন্তু আমাদের দেশে এগুলোর ব্যবহার নিষিদ্ধ।

ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের (ফিআব) সাধারণ সম্পাদক মো. নজরুল ইসলাম বলেন, প্রতিবেশী দেশে খামার থেকে ভোক্তার হাত পর্যন্ত পৌঁছাতে দামের ব্যবধান থাকে মাত্র এক টাকা; সেখানে আমাদের দেশে তিন থেকে চার টাকা। তাই ডিমের দাম কমাতে হলে মধ্যস্বত্বভোগীর সংখ্যা কমাতে হবে।

ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (বিএবি) সাধারণ সম্পাদক শাহ্ ফাহাদ হাবীব বলেন, চলতি মাসে একদিন বয়সী মুরগির বাচ্চার দামেও পতন হয়েছে। সারাবছর ভারসাম্যপূর্ণ বাজার ধরে রাখা সম্ভব হলে খামারি ও ভোক্তা উভয়ই লাভবান হবেন।

অ্যানিমেল হেলথ কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (আহকাব) সাধারণ সম্পাদক আফতাব আলম বলেন, ডিম আমদানির অনুমতি দেওয়া হলেও এসেছে যতসামান্যই। এখন তো ডিমের চাহিদা কম তাহলে সরকারের উচিত হবে ডিম রপ্তানি করে খামারিদের লোকসানের হাত থেকে রক্ষা করা।

গাজীপুর মাওনার খামারি তোফাজ্জল হোসেন বলেন, ৭ টাকা ৩০ পয়সায়ও ডিম বিক্রি করতে হয়েছে; ডিম সংরক্ষণ করতে পারিনি কারণ সংরক্ষণ করলে অভিযান চালানো হয়, জরিমানা আদায় করা হয়। সরকার খামার পর্যায়ে ডিমের দাম নির্ধারণ করেছে কিন্তু আমরা সে দামে বিক্রি করতে পারছি না।

তিনি বলেন, ডিমের দাম বাড়লে আমাদের সঙ্গে এমন আচরণ করা হয় যেন আমরা কোনো দাগী আসামি। যৌক্তিক লাভ করার অধিকার আমাদেরও আছে। আমরা নিজের জন্য উৎপাদন করি না বরং ভোক্তার জন্যই উৎপাদন করি।

ডায়মন্ড এগসের সিইও কৃষিবিদ আসাদুজ্জামান মেজবাহ বলেন, বছরের তিন-চার মাস লোকসানে ডিম বিক্রি করতে হয়। শত শত কোটি টাকা ব্যাংক ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে ব্যবসা করতে হয়। খামারিদের ভয় না দেখিয়ে বরং প্রশংসা করা উচিত তাহলেই ডিমের উৎপাদন বাড়বে।

মতবিনিময় সভায় উপস্থিত পোল্ট্রি খামারি ও উদ্যোক্তারা বলেন, আগামী কয়েক বছরে ডিমের চাহিদা আরও বাড়বে। আশা করা হচ্ছে মাথাপিছু ডিমের চাহিদা ১৩৫ থেকে বেড়ে ৩০০ হবে। সেক্ষেত্রে উৎপাদন আড়াইগুণ বাড়াতে হবে। দেশীয় উৎপাদন বাড়াতে না পারলে আমদানি করে চাহিদা পূরণ সম্ভব হবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *