জ্বালানির উচ্চমূল্য সত্ত্বেও লোকসানে নেই পদ্মা অয়েল

স্টাফ রিপোর্টার

জ্বালানির উচ্চমূল্য ও এর ধারাবাহিকতায় লাগামহীন হয়ে ওঠা মূল্যস্ফীতি দেশে ব্যবসা পরিচালনার ব্যয় বাড়িয়েছে। গত প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) বড় ধরনের আর্থিক চাপ সামলাতে হয়েছে সরকারি-বেসরকারি প্রায় সব প্রতিষ্ঠানকেই। যদিও এ সময় বেশ ভালো ব্যবসা করেছে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম জ্বালানি তেল বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান পদ্মা অয়েল।

মূলত পেট্রোলিয়াম পণ্য আহরণ, সংরক্ষণ ও কমিশনভিত্তিক বিপণনের মাধ্যমে ব্যবসা করে পদ্মা অয়েল। পেট্রোলিয়াম পণ্যের ব্যবসা থেকে কমিশন আয়ের পাশাপাশি কৃষি খাতে ব্যবহূত রাসায়নিক বিক্রি থেকেও কিছু আয় হয় কোম্পানিটির। আগের হিসাব বছরের (জুলাই-জুন) প্রথম প্রান্তিকে লোকসানে থাকলেও এবার মুনাফা করেছে প্রতিষ্ঠানটি। পেট্রোলিয়াম পণ্যের বিতরণ বাড়ার পাশাপাশি জ্বালানি তেলের উচ্চমূল্য কোম্পানিটির মুনাফা অর্জনে বড় ভূমিকা রেখেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত পদ্মা অয়েল গতকাল চলতি ২০২২-২৩ হিসাব বছরের প্রথম প্রান্তিকের (জুলাই-সেপ্টেম্বর) অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, এ সময়ে কোম্পানিটি ৬ লাখ ৭৯ হাজার ৩৬৫ টন পেট্রোলিয়াম পণ্য বিতরণের মাধ্যমে কমিশন বাবদ ৭০ কোটি ৬৩ লাখ ৯২ হাজার টাকা আয় করেছে, যেখানে আগের হিসাব বছরের একই সময়ে ৫ লাখ ২৬ হাজার ৪০০ টন পণ্য বিতরণের বিপরীতে কমিশন বাবদ আয় ছিল ৬০ কোটি ২১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। পণ্য বিতরণের পরিমাণে ২০২১ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বরের তুলনায় এ বছরের একই সময়ে ২৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও টাকার অংকে এ প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ১৭ শতাংশে।

দুই হিসাব বছর ধরে পেট্রোলিয়াম পণ্যের ব্যবসায় পরিচালন লোকসান দিয়েছে পদ্মা অয়েল। যদিও চলতি হিসাব বছরের প্রথম প্রান্তিকেই কোম্পানিটির পরিচালন মুনাফা হয়েছে ৪ কোটি ৪৮ লাখ ৪৭ হাজার টাকা। আগের হিসাব বছরের প্রথম প্রান্তিকে কোম্পানিটির পরিচালন লোকসান হয়েছিল ৩৩ লাখ ৬৭ হাজার টাকা।

কমিশনের বাইরে পরিচালন-অপরিচালন খাতের অন্যান্য উৎস থেকেও বড় অংকের অর্থ আয় করে পদ্মা অয়েল। চলতি ২০২২-২৩ হিসাব বছরের প্রথম প্রান্তিকেও এ বাবদ ভালো আয় করেছে কোম্পানিটি। এর মধ্যে অন্যান্য উৎস থেকে পরিচালন আয় হয়েছে ১৪ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। গত হিসাব বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে এ আয়ের পরিমাণ ছিল ১৩ কোটি টাকা। অন্যান্য উৎসের অপরিচালন আয় গত প্রান্তিকে হয়েছে ৭৫ কোটি ৯৬ লাখ ৪৪ হাজার টাকা। গত হিসাব বছরের প্রথম প্রান্তিকে তা ছিল ৬৬ কোটি ৩৯ লাখ ২৫ হাজার টাকা।

গত প্রান্তিকে পদ্মা অয়েল ৭০ কোটি ৭৫ লাখ ১৬ হাজার টাকা কর-পরবর্তী নিট মুনাফা করেছে, যেখানে আগের হিসাব বছরের একই সময়ে কোম্পানির নিট মুনাফা ছিল ৫৬ কোটি ৪৮ লাখ ৪০ হাজার টাকা। এক বছরের ব্যবধানে কোম্পানিটির নিট মুনাফা বেড়েছে ২৫ শতাংশ।

চলতি হিসাব বছরের প্রথম প্রান্তিকের পাশাপাশি গতকাল সর্বশেষ সমাপ্ত ২০২১-২২ হিসাব বছরের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুমোদন ও লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে পদ্মা অয়েলের পর্ষদ। গত হিসাব বছরে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) হয়েছে ২৪ টাকা ৪৭ পয়সা, যা আগের হিসাব বছরে ছিল ২৩ টাকা ২৭ পয়সা। সর্বশেষ সমাপ্ত হিসাব বছরে বিনিয়োগকারীদের জন্য ১২৫ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ প্রদানের ঘোষণা দিয়েছে কোম্পানিটি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পদ্মা অয়েলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবু সালেহ ইকবাল বলেন, কোম্পানির আর্থিক পারফরম্যান্স বাড়াতে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। এতে প্রথম প্রান্তিকে কোম্পানিটির বিক্রি বেড়েছে। বিক্রি বাড়ার কারণে মুনাফাও ভালো হয়েছে। পাশাপাশি জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণেও আমাদের মুনাফা কিছুটা বেড়েছে। সামনে কোম্পানির পারফরম্যান্স আরো ভালো হবে বলে আশাবাদী আমি।

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) সাবসিডিয়ারি হিসেবে দেশে জ্বালানি তেলের বিপণন ও বিতরণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে মেঘনা পেট্রোলিয়াম, পদ্মা অয়েল ও যমুনা অয়েল। ২০২০-২১ হিসাব বছরে এ তিন কোম্পানির মোট ৬৩ লাখ টন পেট্রোলিয়াম পণ্য বিতরণ করেছে।

জ্বালানি বিভাগের পক্ষ থেকে গত ৫ আগস্ট প্রকাশিত এক প্রজ্ঞাপনে ভোক্তা পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের পরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম সাড়ে ৪২ থেকে ৫২ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়। এ সময় ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে ৩৪ টাকা বাড়িয়ে ১১৪ টাকা করার ঘোষণা দেয়া হয়। সে হিসেবে পণ্য দুটির দাম বাড়ানো হয় সাড়ে ৪২ শতাংশ। অকটেনের দাম ৪৬ টাকা বাড়িয়ে প্রতি লিটার নির্ধারণ করা হয় ১৩৫ টাকা। পণ্যটির দাম বেড়েছে প্রায় ৫২ শতাংশ। ৪৪ টাকা বাড়িয়ে পেট্রলের প্রতি লিটারের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১৩০ টাকা। সরকারের সর্বশেষ সিদ্ধান্তে পণ্যটির দাম বেড়েছে ৫১ শতাংশের কিছু বেশি। এর আগে গত বছরের নভেম্বরে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারপ্রতি ১৫ টাকা বাড়িয়ে ৮০ টাকা নির্ধারণ করেছিল সরকার। ওই সময় অকটেন ও পেট্রলের দাম নির্ধারণ করা হয় লিটারপ্রতি যথাক্রমে ৮৯ ও ৮৬ টাকা।

দাম বাড়ানোর কারণ হিসেবে সে সময় জ্বালানি বিভাগের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, বিশ্ববাজারে ঊর্ধ্বগতির কারণে প্রতিবেশী দেশসহ বিভিন্ন দেশ নিয়মিত জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করছে। ভারত ২২ মে থেকে কলকাতায় ডিজেলের দাম প্রতি লিটার ৯২ রুপি ৭৬ পয়সা ও পেট্রল লিটারপ্রতি ১০৬ রুপি ৩ পয়সা নির্ধারণ করেছে, যা তখনো বিদ্যমান ছিল। বাংলাদেশী মুদ্রায় এ দাম দাঁড়ায় যথাক্রমে ১১৪ টাকা ৯ ও ১৩০ টাকা ৪২ পয়সা (রুপির বিনিময় হার ১ টাকা ২৩ পয়সা ধরে)। অর্থাৎ সে সময় বাংলাদেশে কলকাতার তুলনায় ৩৪ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ কম দামে ডিজেল বিক্রি হচ্ছিল। পেট্রল বিক্রি হচ্ছিল ৪৪ দশমিক ৪২ শতাংশ কম দামে। ভারতে দরবৃদ্ধিজনিত জ্বালানি তেল পাচারের যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, সেটি নিরসন করতেই এ মূল্যবৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়, বিপিসি চলতি পঞ্জিকাবর্ষের ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ছয় মাসে সব ধরনের জ্বালানি তেল বিক্রয়ে ৮ হাজার ১৪ কোটি ৫১ লাখ টাকা লোকসান দিয়েছে। জ্বালানি তেলের আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতির কারণে বিপিসির আমদানি কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখতে মূল্য সমন্বয় করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।

এরপর গত ২৯ আগস্ট জারীকৃত আরেকটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ভোক্তা পর্যায়ে জ্বালানি তেলের দাম কিছুটা সমন্বয় করে জ্বালানি বিভাগ। এ সময় লিটারপ্রতি ৫ টাকা কমিয়ে ভোক্তা পর্যায়ে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ১০৯, অকটেন ১৩০ ও পেট্রলের দাম ১২৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়। মূলত ডিজেলের ওপর আরোপিত যাবতীয় আগাম করে অব্যাহতি এবং আমদানি শুল্ক ১০ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ নির্ধারণের পর এ দাম সমন্বয় করা হয়।

বিপিসির তথ্য অনুযায়ী, দেশের সার্বিক জ্বালানি চাহিদার প্রায় ৮ শতাংশের জোগান আসে স্থানীয় উৎস থেকে। অবশিষ্ট প্রায় ৯২ শতাংশ চাহিদা মেটানো হয় আমদানির মাধ্যমে। জ্বালানি তেলের প্রায় ৬৩ শতাংশ পরিবহন ও যোগাযোগ, কৃষিতে সাড়ে ১৫ শতাংশ, শিল্পে ৭ দশমিক ১৫, বিদ্যুতে ১০ দশমিক ৩৫, গৃহস্থালিতে ১ দশমিক ৫৫ ও অন্যান্য খাতে ২ দশমিক ৫৪ শতাংশ ব্যবহার হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *