চীনা বিনিয়োগের কোনো প্রকল্পেই কাঙ্ক্ষিত সুফল মিলছে না

স্টাফ রিপোর্টার

চীনের অর্থায়নে দেশে বাস্তবায়িত মেগা প্রকল্পগুলোর সিংহভাগই নির্মাণ হয়েছে গত দেড় দশকে। বাস্তবায়নাধীন আছে আরো বেশকিছু। এসব প্রকল্প নেয়ার সময় নানাভাবে এগুলোর আর্থিক মুনাফাযোগ্যতার তথ্য উপস্থাপন করেছিল বিগত সরকার। যদিও বাস্তবায়ন শেষে প্রকল্পগুলো চালু হওয়ার পর দেখা যাচ্ছে পুরোপুরি ভিন্ন চিত্র। চালু হওয়ার পর থেকে প্রকল্পগুলোর আয় দিয়ে পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ই উঠছে না। যদিও এগুলোর সুদসহ ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে গিয়ে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে বিপুল পরিমাণ অর্থ।

বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক স্থাপন হয় ১৯৭৫ সালে। সরকারের আর্থিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্য অনুযায়ী, ওই সময় থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশকে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ঋণ ও বাজেট সহায়তা হিসেবে মোট প্রায় ১ হাজার ১০৫ কোটি ডলার দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে চীন। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত ছাড় হয়েছে প্রায় ৭৭৫ কোটি ডলার। ছাড় হওয়া এ অর্থে এখন পর্যন্ত বেশকিছু মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে। বাস্তবায়ন শেষ হওয়ার পথে আছে আরো বেশ কয়েকটি।

বাস্তবায়ন শেষ হওয়া প্রকল্পগুলো থেকে এখন পর্যন্ত প্রতিশ্রুত বা কাঙ্ক্ষিত আর্থিক ফলাফল পায়নি বাংলাদেশ। এর মধ্যে সবচেয়ে ব্যয়বহুল প্রকল্পটি হলো পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প। বারবার সংশোধন করে কলেবর বাড়ানোয় প্রকল্পটি এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়ন না হলেও এর ঋণ পরিশোধ এরই মধ্যে শুরু হয়েছে।

মেগা প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় হচ্ছে ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে ঋণের পরিমাণ ২১ হাজার ৩৬ কোটি টাকা। ইআরডির তথ্য বলছে, ডলারের অংকে প্রকল্পে চীনা ঋণ দাঁড়ায় ২৬৬ কোটি ৭৯ লাখে। ছয় বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ মোট ২০ বছরে এ ঋণ পরিশোধ করতে হবে। অর্থাৎ ঋণের আসল পরিশোধে বাংলাদেশ সময় পাচ্ছে ১৪ বছর। এ হিসাবে বার্ষিক গড় ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ হাজার ৫০২ কোটি টাকা। ঋণের সুদহার ২ শতাংশ। সার্ভিস চার্জ আরো দশমিক ২৫ শতাংশ।

পদ্মা সেতু সংযোগ রেলপথ দিয়ে ২০২৩ সালের ১ নভেম্বর থেকে আংশিকভাবে ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ রেলওয়ের তথ্য বলছে, বর্তমানে তিনটি আন্তঃনগর ও দুটি মেইল ট্রেন চলছে এ পথে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসে তিনটি আন্তঃনগর ট্রেন থেকে রাজস্ব আয় হয়েছে ৩৬ কোটি ৭১ লাখ টাকা। ঋণ চুক্তি অনুযায়ী, গ্রেস পিরিয়ড শেষ করে চলতি বছরের এপ্রিল থেকে এ প্রকল্পের ঋণ পরিশোধ শুরু হয়েছে। আয় দিয়ে প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান না হওয়ায় প্রকল্পের ঋণ পরিশোধে ভর্তুকি দিতে হবে।

বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক সরদার সাহাদাত আলী বলেন, ‘পদ্মা রেল লিংক মাত্র চালু হয়েছে। এতে যা ব্যয় হয়েছে, তা তুলতে সময় লাগবে। ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে চালু বা আন্তঃদেশীয় দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য যদি আরো বেশি হতো এবং কক্সবাজার লাইনটি যদি চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত করা যেত তাহলে এখান দিয়ে আমাদের পণ্য পরিবহন করে আর্থিকভাবে লাভজনক হওয়ার একটা সুযোগ ছিল। এরই মধ্যে অর্থ ব্যয় যা হয়েছে তা তুলতে সময় লাগবে।’

এ ধরনের প্রকল্প অলাভজনক হওয়ার জন্য বিনিয়োগকারী নয়, বাস্তবায়নকারীদের সক্ষমতার অভাবই বেশি দায়ী বলে মনে করছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল হক।  তিনি বলেন, প্রকল্পগুলো জনসুযোগ তৈরি করবে, দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখবে, এ ধরনের কথা ব্যাপকভাবে বলা হয়। বলা হয়েছে পদ্মা সেতু অর্থনৈতিক কর্মচাঞ্চল্য তৈরি করবে। কিন্তু কোথায়? পদ্মা সেতু হয়েছে, কিন্তু ওখানে শিল্পায়নের কোনো পরিকল্পনা হয়েছে? শিল্পায়নের পরিকল্পনাটি আগে করতে হয়। কারণ অবকাঠামো দুই-তিন বছরে হয়ে যায়। কিন্তু পরিকল্পনা করতে সময় লাগে, অধিগ্রহণ লাগে। কিন্তু সম্ভাব্যতার সময় ওই কথাগুলোই সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা হয়। বলা হয়েছিল মানুষের আনাগোনা বেড়ে যাবে, শিল্প গড়ে উঠবে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, ঢাকার বিকেন্দ্রীকরণ হয়ে চাপ কমে যাবে, অর্থনীতিতে জিডিপির অবদান হবে ২ থেকে ৩ শতাংশ। এখন পারফরম্যান্স মূল্যায়ন করতে বসলে দেখা যাবে অর্থনৈতিক কর্মচাঞ্চল্য তৈরি করতে গেলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হতে হবে, কিন্তু সেটা হয়নি। এতে করে যেটা হলো ঢাকার বিকেন্দ্রীকরণ না হয়ে চাপ আরো বেড়ে গেছে; কারণ খুব তাড়াতাড়ি এখন মানুষ ঢাকায় চলে আসতে পারে। এভাবে লক্ষ্যের পুরো বিপরীত অসুবিধায় পড়তে হচ্ছে আমাদের। প্রকল্পগুলো যখন প্রণয়ন করা হয় তখন ব্যাপকতা দেখায় অনেক। কিন্তু কাজ হয় অন্যটা। এখানে দোষটা অর্থায়নের বা অর্থায়নকারীর নয়। দোষ হলো কর্তাব্যক্তিদের যারা প্রকল্প করেন তাদের। তারা লাগামছাড়া কথা বলেন। বিগত সরকারও লাগামছাড়া কথাগুলো বেছে নিয়ে অবাধে প্রচার করেছে। এতে করে জনগণের মধ্যে বিভ্রম তৈরি হয়েছে। আমাদের সমস্যা ফান্ডিং এজেন্সি না; বরং যারা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে তারা। তাদের যথেষ্ট পরিমাণ সক্ষমতার অভাব আছে এবং তাদের দেউলিয়াপনাই এ পরিস্থিতির জন্য দায়ী।’

পটুয়াখালি জেলার পায়রায় আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণ হয়েছে বাংলাদেশ ও চীনের যৌথ বিনিয়োগে। চালুর পর থেকেই নানামুখী সংকট মোকাবেলা করতে হয়েছে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিকে। বিগত সরকারের আমলে প্রকল্পটির ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে গিয়ে বাংলাদেশের বিপাকে পড়ার নজিরও রয়েছে। ডলার সংকটে জ্বালানি সংস্থান বন্ধ হয়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি অলস বসিয়ে রাখার ঘটনাও ঘটেছে। তবে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির চ্যালেঞ্জগুলোকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে এর অবস্থান।

পায়রা নদীর তীরবর্তী বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি পরিচালনার জন্য জ্বালানি আমদানি করতে হয় রাবনাবাদ চ্যানেল দিয়ে। কিন্তু নাব্য সংকটের কারণে এ চ্যানেল দিয়ে বড় নৌযান চলাচল করতে পারছে না। ফলে কয়লাবাহী জাহাজও এখন পায়রা বন্দরের জেটিতে নোঙর করতে পারছে না। লাইটারেজে করে মাদার ভেসেল থেকে কয়লা আনতে গিয়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির পরিচালন ও উৎপাদন ব্যয় আরো বেড়ে যাচ্ছে। শীতে উজানি প্রবাহ কমে গিয়ে চ্যানেলের গভীরতা আরো কমে গেলে বিদ্যুৎ কেন্দ্রে নিরবচ্ছিন্ন কয়লা সরবরাহ নিয়ে আশঙ্কা রয়েছে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ কেন্দ্রসংশ্লিষ্টরা।

তাদের ভাষ্যমতে, গত বছরই বিপুল পরিমাণ অর্থব্যয়ে চ্যানেলটির ড্রেজিং শেষ হয়েছে। কিন্তু এরই মধ্যে পলি পড়ে চ্যানেলের গভীরতা আবার কমে যাওয়ায় সামনের দিনগুলোয় পায়রার তীরে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালানো নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হতে পারে। সে ক্ষেত্রে বড় জাহাজ থেকে লাইটারে করে বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কয়লা নিতে খরচ বেড়ে যাবে। আর খরচ বৃদ্ধির প্রভাব পড়বে বিদ্যুতের দামেও।

পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি পরিচালনা করছে বাংলাদেশ চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিসিপিসিএল)। সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, মেগা প্রকল্প হিসেবে বাস্তবায়িত পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মূল অর্থায়নকারী দেশ চীন। প্রকল্পের মোট ব্যয় ২৪১ কোটি ডলার। এর মধ্যে চীনের এক্সিম ব্যাংকের ঋণ আছে প্রায় ২ বিলিয়ন বা ২০০ কোটি ডলারের কাছাকাছি।

ভূরাজনীতির পর্যবেক্ষকরাও বলছেন, এ ধরনের প্রকল্পের ক্ষেত্রে লাভক্ষতির দায় গ্রহীতা দেশেরই। সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বলেন, ‘একটা প্রক্ষেপণ হয় অর্থনৈতিক রিটার্ন কতটা আসবে তার ভিত্তিতে। আরেকটা প্রক্ষেপণ হতে পারে রাজনৈতিক কারণে, এসব ক্ষেত্রে সাধারণত ভোট বাড়ার কথা ভাবা হয়ে থাকতে পারে। যে প্রকল্পগুলোর ফলাফল নিয়ে আলোচনা, সেগুলোর ক্ষেত্রে আমার ধারণা রাজনৈতিক কারণ প্রাধান্য পেয়ে থাকতে পারে। অর্থনৈতিকভাবে এগুলো কতটা উপকারে আসবে তার চেয়েও হয়তো রাজনৈতিক বিবেচনা প্রধান হয়ে থাকতে পারে। এসব ক্ষেত্রে দুই পক্ষ যখন আলাপ-আলোচনায় বসে সাধারণভাবে আমাদের পক্ষ থেকে বলা হয় আমরা এ প্রকল্প করতে চাই, তোমরা এখানে অর্থায়ন করো। এ সময় প্রকল্পের জাস্টিফিকেশনও দেয়া হয়। যার মাধ্যমে গুরুত্ব বোঝানো গেলে অর্থায়নকারী বিনিয়োগের আস্থা পায়। এ ধরনের প্রকল্পের ক্ষেত্রে দায়িত্বটা মূলত আমাদের। কারণ অর্থায়নকারী এসেছে আমাদের প্রয়োজনের নিরিখেই। যদি প্রয়োজন না দেখানো হয়, তাহলে তো তাদের এসব প্রকল্পে আসারই কথা থাকে না। তবে অর্থায়নকারীরা যে মূল্যায়ন করে না তা না, তারা করে কিন্তু যেসব ক্ষেত্রে প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা জানিয়ে অর্থায়ন চাওয়া হয়; তখন তারা বিনিয়োগের আগ্রহ থেকেই অর্থায়ন করে। আর যখন রাষ্ট্রীয় গ্যারান্টি থাকে তখন তারা দুশ্চিন্তামুক্তভাবেই অর্থায়ন করে।’

কর্ণফুলী টানেল প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় হয়েছে ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৬ হাজার ৭০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে চীন। ইআরডির হিসাবে, ডলারের অংকে এর পরিমাণ ৭০ কোটি ৫৮ লাখ। চুক্তি অনুযায়ী ঋণ পরিশোধে ১৫ বছর সময় পাবে বাংলাদেশ। এ হিসাবে সুদ ব্যতীত বার্ষিক গড় ঋণের পরিমাণ ৪০৫ কোটি টাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ।

সংস্থাটির হিসাব বলছে, চালুর পর এক বছরে (অক্টোবর ২০২৩ থেকে অক্টোবর ২০২৪) টানেল থেকে আয় হয়েছে প্রায় ৩৭ কোটি টাকা। বিপরীতে অবকাঠামোটি পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ ব্যয় হচ্ছে বছরে ১৩৬ কোটি টাকার বেশি। লাভের বদলে প্রকল্পটিতে প্রতি বছর বিপুল অংকের লোকসান গুনতে হচ্ছে।

বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চলতি ২০২৪ সাল থেকে টানেলের জন্য নেয়া চীনা ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হওয়ার কথা। আয় কম হওয়ায় রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় মেটাতে হবে অন্যান্য সেতুর আয় থেকে। আর ঋণ পরিশোধে রাজস্ব খাত থেকে ভর্তুকি দিতে হবে সরকারকে। তবে সেতু কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা আশা করছেন, ‌যত দিন যাবে টানেলের আয় ও ব্যয়ের পার্থক্য ধীরে ধীরে কমে আসবে এবং এক সময় লাভজনক অবস্থায় চলে যাবে।

প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা টানেলটি লাভজনক না হওয়ার পেছনে দায়ী করছেন দক্ষিণ চট্টগ্রামকে ঘিরে নেয়া উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন না হওয়াকে। জানতে চাইলে কর্ণফুলী টানেলের সাবেক উপপ্রকল্প পরিচালক ও বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (অপারেশন অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স) আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘টানেল দিয়ে যানবাহন চলাচলের প্রক্ষেপণ দৃশ্যমান হচ্ছে না এটা সত্য। কারণ দক্ষিণ চট্টগ্রামকে ঘিরে উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলোর কিছুই বাস্তবায়ন হয়নি। এমনকি অনেক প্রকল্পের চুক্তি কিংবা কাজও শুরু হয়নি, যার প্রভাব পড়েছে টানেল থেকে রিটার্নের ক্ষেত্রে। সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের সময় দক্ষিণ চট্টগ্রামকে ঘিরে একগুচ্ছ বিনিয়োগ পরিকল্পনাকে বিবেচ্য হিসেবে ধরা হয়েছিল। বিশেষত চায়না ইকোনমিক জোন পরিকল্পনাও চীনা অর্থায়নে টানেল নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়নে বড় ভূমিকা রেখেছিল। কিন্তু ওই প্রকল্পটির এখনো কোনো চুক্তি হয়নি। ইকোনমিক জোনটি বাস্তবায়ন হলে টানেল নিয়ে চলাচলরত যানবাহনের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যাবে। আবার টানেলকে সংযুক্ত করতে স্থানীয় সরকার বিভাগ, সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর, সিডিএসহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থা যথাসময়ে সংযোগকারী প্রকল্প হাতে নিতে পারেনি। মোট কথা অন্যান্য সংস্থার কার্যক্রমে ধীরগতির কারণেই টানেলের ব্যবহার ও আয় লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছতে পারছে না।’

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এসব প্রকল্প নেয়ার সময় জাতীয় প্রয়োজনের চেয়ে রাজনৈতিক ও অন্যান্য বিষয়কেই বিবেচনায় নেয়া হয়েছে সবচেয়ে বেশি। যথাযথভাবে সম্ভাব্যতা যাচাই না করে শুধু বিপুল পরিমাণ অর্থ লুটের উদ্দেশ্যকে প্রাধান্য দিয়ে নেয়া এসব প্রকল্প এখন বাংলাদেশের জন্য বড় বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, ‘চীনাদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। প্রত্যেকটি বড় বড় প্রকল্প থেকে আমাদের স্বৈরশাসক হাসিনা হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করার জন্য প্রকল্পগুলো নিয়েছিল। এ প্রকল্পগুলোর যথাযথ সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়নি। যার জন্য এগুলো যখন শেষ হয়ে গেছে, প্রকল্পগুলোর আয় থেকে এর ঋণের কিস্তি কিছুই শোধ করা যাবে না। কর্ণফুলী টানেলে দেখা যাচ্ছে যে রক্ষণাবেক্ষণ খরচের চার ভাগের এক ভাগও টোল থেকে আসছে না। একই অবস্থা হবে পদ্মা সেতু দিয়ে যাওয়া রেললাইনের। সেখানে ৪০ হাজার কোটি টাকার মতো খরচ হয়েছে কিন্তু দেখা যাবে যে দিনে দুই-তিনটা ট্রেনের বেশি এখনো চালানো যাচ্ছে না। অতএব, এটাও একটা বিশাল বোঝা হিসেবে বাংলাদেশের ওপর চেপে বসবে। এ প্রকল্পগুলো গ্রহণের কোনো যৌক্তিকতা বা অর্থনৈতিক সম্ভাব্যতার জায়গা থেকে ছিল না। তারপরও প্রকল্প নেয়া হয়েছে এখান থেকে পুঁজি লুটে নেয়ার জন্য, যার মধ্য থেকে প্রচুর অর্থ দেশ থেকে বিদেশে পাচার করে দেয়া হয়েছে।’

বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) অধীনে বাস্তবায়িত শাহজালাল ফার্টিলাইজার প্রকল্পটির অবস্থান সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জে। সাম্প্রতিক সময়ে গ্যাস সংকটের কারণে দেশের অন্যান্য সার কারখানার মতো এটিকেও ভুগতে হয়েছে। প্রকল্পটিতে চীনের ঋণের পরিমাণ ৫৬ কোটি ডলার।

দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার উদ্বোধন হয় ২০২৩ সালের ৩ জুলাই। শুরুতে প্রকল্পের খরচ ধরা হয়েছিল ৩ হাজার ৩১৭ কোটি টাকা। নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না হওয়ায় প্রকল্পের মেয়াদ ও খরচ বেড়ে দাঁড়ায় ৩ হাজার ৭১২ কোটি টাকায়। ডলারের অংকে এ প্রকল্পে চীনা ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ২৭ কোটি ৩৪ লাখ ডলারে। উদ্বোধন হলেও নির্ধারিত এলাকা থেকে পয়ঃবর্জ্য শোধনাগারে পৌঁছানোর পাইপলাইন বা নেটওয়ার্ক এখনো তৈরি হয়নি। ফলে এত টাকা ব্যয়ে নির্মিত প্রকল্পের সুফল শিগগির সংশ্লিষ্ট নগরবাসী পাবে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সংশ্লিষ্টরা জনস্বার্থের পরিবর্তে নিজস্ব স্বার্থ বিবেচনায়ই এসব প্রকল্প হাতে নিয়েছিল বলে মনে করছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘চীন যুক্ত হওয়ার আগে প্রকল্পগুলোর উদ্যোগ কাদের ছিল, সম্ভাব্যতা কারা করেছে, রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্ট কারা প্রক্ষেপণ করেছে? এগুলো করেছে আওয়ামী লীগ সরকার। যারা প্রকল্প অর্থায়ন করে তারা, যেমন চীন তো চাইবেই প্রকল্প করতে। এতে যদি বাংলাদেশের ক্ষতি হয়, তা নিয়ে চীনের ভাবার কথা না। এটা আমাদের দায়িত্ব। এ ধরনের প্রকল্প সম্পর্কে অনেক কথা বলা হয়েছে। এগুলোর পরিবর্তে অন্য প্রকল্প অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করলে দেশের রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্ট কী হতো, দেশের অর্থনীতিতে কী অবদান রাখা যেত; এসব বিষয় নিয়ে অনেক আলাপ হয়েছে। কিন্তু তারা কোনো কিছুই কেয়ার করেনি। অবশ্যই তাদের নিজস্ব স্বার্থ ছিল। এটা তো বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আমরা ডেট ট্র্যাপে পড়ছি। কারণ এসব বিনিয়োগের কোনো রিটার্ন নেই। রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্ট না থাকার কারণে আমরা আমাদের সময় অনেক প্রকল্প প্রত্যাখ্যান করেছি। ডেট ট্র্যাপ এড়ানোর কোনো বিষয়ও এখন নেই। কারণ ডেট ট্র্যাপ এরই মধ্যে হয়ে গেছে। যথেষ্ট রাজস্ব আহরণ না হওয়ায় ও অর্থনৈতিক রিটার্ন না থাকায় ভবিষ্যতে এসব প্রকল্প সংকটে পরিণত হবে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *