চামড়ার বাজার পুরোনো ধারায়

স্টাফ রিপোর্টার

করোনা মহামারির বছর ২০২০ সালে ধস নেমেছিল চামড়ার বাজারে। কোরবানির চামড়ার দাম কিংবা ক্রেতা না পেয়ে নদী-খাল বা ভাগাড়ে অনেক চামড়া ফেলে দেওয়ার ঘটনা ঘটে। পরের বছরও ওই অবস্থার খুব বেশি উন্নতি হয়নি। তবে ২০২২ সাল থেকে একটু একটু করে বেড়েছে দাম। ইঙ্গিত ছিল ঈদকেন্দ্রিক মৌসুমি চামড়ার বাজার ঘুরে দাঁড়ানোর। তবে হতাশ হতে হয়েছে বিক্রেতাদের। সরকার নির্ধারিত দর অনুযায়ী লবণযুক্ত ছোট গরুর চামড়ার ন্যূনতম দাম ঢাকায় ১ হাজার ২০০ এবং ঢাকার বাইরে এক হাজার টাকা হওয়ার কথা থাকলেও ঢাকাতেই লবণ ছাড়া বেশ বড় আকারের গরুর চামড়ার দাম ১ হাজার ২০০ টাকা ছোঁয়নি।

চামড়ার বাজারের মৌসুমি ব্যবসায়ীসহ মসজিদ, মাদ্রাসা ও এতিমখানার চামড়া বিক্রেতাদের অভিযোগ, ১ হাজার ২০০ টাকা ন্যূনতম দরের ধারণা দেওয়া ঠিক হয়নি। এ দরকেই সর্বোচ্চ প্রচার করে ফায়দা লুটেছে আড়তদার ও ট্যানারি মালিকরা। বড় গরুর চামড়াই কেনাবেচা হয়েছে ৭০০ থেকে ৯০০ টাকায়; ছোট গরুর চামড়া কেউ কিনতে চায়নি; যারা কিনেছে দর দিয়েছে মাত্র দেড়শ-দুইশ টাকা। ফলে এ বছরও চামড়ার ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয়েছেন মাদ্রাসা ও এতিমখানার দরিদ্র শিক্ষার্থীরা। রাজধানীসহ দেশজুড়ে হতাশার এ চিত্র পাওয়া গেছে।

ঢাকার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, কোরবানিদাতাদের কেউই এখন আর নিজেরা পশুর চামড়া বিক্রির কথা চিন্তা করেন না। দেড় থেকে দুই যুগ আগে যে চামড়া তিন-সাড়ে তিন হাজার টাকায় বিক্রি করেছিলেন, তার দাম মৌসুমি ব্যবসায়ীরা ৩০০ থেকে ৪০০ টাকার বেশি দিতে চায় না। ফলে ক্রেতা না খুঁজে কসাই বা মাদ্রাসা ও এতিমখানা থেকে আসা ছাত্র-শিক্ষকদের দিয়ে জবাই করে তাদেরই ‘আল্লাহর ওয়াস্তে’ দান করে দেন।

খুঁড়িয়ে চলা চামড়ার বাজারের এ হতাশার চিত্র প্রায় দুই দশকের। পরিবেশ সচেতন ইউরোপের ক্রেতাগোষ্ঠী ২০০৫ সালে লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ (এলডব্লিউজি) প্রতিষ্ঠা করে চামড়া সংগ্রহ থেকে প্রক্রিয়াজাত ব্যবস্থায় তাদের নির্ধারণ করা পরিবেশ ও শ্রমমান নিশ্চিত করার তাগিদ দেয়। নিতে বলে এলডব্লিউজি সনদ। এ সনদ নিতে না পারায় অনেকে বাংলাদেশ থেকে চামড়া কেনা বন্ধ করে দেয় । এতে রপ্তানি বাজার হারিয়ে ধসে পড়ে চামড়ার বাজার। চলতি অর্থবছরের হিসাবেও গত বছরের তুলনায় চামড়া ও চামড়া পণ্যের রপ্তানি ২০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। বৈশ্বিক বাজার ৫০০ বিলিয়ন ডলারের হলেও উৎকৃষ্টমানের নিজস্ব চামড়া থাকার পরও এ বাজারে বাংলাদেশের হিস্যা এক বিলিয়ন ডলারও নয়।

সকালটা যেমন-তেমন, বিকেলটা করুণ

সোমবার ঈদের দিন সকালে পুরান ঢাকার পোস্তায় গত বছরের তুলনায় ২০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত বেশি দরে ৮০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকায় গরুর চামড়া কেনাবেচা শুরু হয়। তবে বিকেল হতেই দাম পড়ে যায়। গত বছরের তুলনায় ১০০ থেকে ২০০ টাকা কমে কেনাবেচা হয়। মাঝারি আকারের গরুর চামড়ার দাম আড়তদাররা ৫০০ থেকে ৭০০ টাকার বেশি দিতে চাননি। কিনতে চাননি ছোট চামড়া।

লালবাগের পোস্তার আড়তদার বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আফতাব খানের দাবি, গত বছরের তুলনায় সমান বা কিছুটা বেশি দরে চামড়া কিনেছেন। মৌসুমি ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হলে পুরো বাজার নষ্ট হবে বলে জানান তিনি। আফতাব খান বলেন, শুধু আড়তদাররা নন, বাজারে মৌসুমি ব্যবসায়ী, ফড়িয়া, ট্যানারি মালিকদের এজেন্ট সবাই চামড়া কিনছেন। প্রতিযোগিতামূলক বাজার থাকায় কম দামে চামড়া কেনার সুযোগ নেই।

বাস্তবে তাঁর বক্তব্যের সত্যতা মেলেনি। পাড়া-মহল্লার মৌসুমি ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, সরকার প্রতি বর্গফুটে ৫ টাকা দর বাড়িয়ে ঢাকায় ৫৫ থেকে ৬০ টাকা নির্ধারণ করে দিলেও ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে দাম দিচ্ছেন না। ছোট গরুর চামড়ার ন্যূনতম দাম ১ হাজার ২০০ টাকা হওয়ার ধারণা দিয়েছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ব্যবসায়ীরা একে সর্বোচ্চ দর ধরে চামড়া কিনছেন।

ঈদের দিন বিকেল ৪টায় ঢাকার খিলগাঁওয়ের জামিয়া মাদানিয়া মাদ্রাসার ভাইস প্রিন্সিপাল মুফতি তাসরিফুল ইসলাম জানান, কোরবানিদাতাদের দান থেকে পাওয়া ৪৫০টি ছোট-বড় গরুর চামড়া গড়ে ৯১০ টাকা দরে কিনেছে আনাস ট্যানার্স। খিলগাঁওয়ের মাখযানুল উলুম মাদ্রাসার শিক্ষকরা জানান, ট্যানারি থেকে ৯০০ টাকা পর্যন্ত দর বলেছে। আশায় ছিলেন, আরও কিছুটা বেশি দর দেবে অন্য কেউ।

তবে ঈদের দিন বিকেলে পুরান ঢাকার লালবাগের পোস্তায় চিত্রটা ছিল ভিন্ন। ঢাকা ও আশপাশের মাদ্রাসা এবং এতিমখানা থেকে বেশি দাম পাওয়ার আশায় বিক্রির উদ্দেশ্যে পোস্তায় চামড়া এনে ধাক্কা খেয়েছেন। পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে কেনা চামড়ার যে দর পোস্তার আড়তদাররা হেঁকেছেন, তাতে কেউ পুঁজি হারানোর কথা বলেছেন; কেউ বলেছেন, পুঁজি উঠলেও পরিশ্রমটা পণ্ড হয়েছে।

ঢাকার হজক্যাম্প এলাকার নুরুল কোরআন মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল আব্দুল কাদের জানান, গত বছর প্রতিটি চামড়া গড়ে ৮৫০ টাকা দরে বিক্রি করেছিলেন। এ বছর পেয়েছেন ৮৩০ টাকা। নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের রশিদীয়া মাদ্রাসার সহকারী প্রিন্সিপাল আবদুল গফফার জানান, ঈদের দিন বিকেল ৩টা পর্যন্ত ৯০০ টাকার ওপরে চামড়া কেনাবেচা হয়েছে। ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে চামড়া সংগ্রহকারী ফড়িয়া মোবারক হোসেন, জসিম, দেলোয়ারসহ অনেকের একই অভিযোগ। মোবারক হোসেন বলেন, ‘আড়তদার জানে, চামড়া বাসাত নিয়া যাওয়ার সুযোগ নাই। যে দাম কইবো, হে দামেই দিতে হইবো।‘

আফতাব খানের প্রতিষ্ঠান মাহবুব অ্যান্ড কোং ঈদের দিন রাত সাড়ে ৮টায় চামড়া কেনা বন্ধ করে দেয়। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষে চামড়া কিনছিলেন মো. কামাল। তিনি জানান, ঈদের দিন সকালে বেশি দামে চামড়া কিনেছিলেন। এখন লাভ করতে হলে ৭০০ টাকার মধ্যে চামড়া কিনতে হবে। পোস্তার আড়তদার হাজি মো. শাহাবুদ্দিন বলেন, সরকারই তো লবণ দেওয়া কাঁচা চামড়ার দাম ১ হাজার ২০০ টাকা বেঁধে দিয়েছে। লবণ দিতে ৩৫০ টাকা খরচ আছে। এর বাইরে শ্রমিক ও পরিবহন খরচ আছে। আবার অনেকে দেরি করে চামড়া আনায় গরমে কিছু চামড়া নষ্ট হবে। সরকারের বেঁধে দেওয়া দর বিষয়ে তিনি বলেন, সরকার তো নিজে এসে ব্যবসা করে না। সব সামলে আমাদেরই ব্যবসা করতে হয়।

ঈদের পরদিন মঙ্গলবার সাভারের হেমায়েতপুরের আড়তে গিয়েও প্রায় একই চিত্র মিলেছে। সততা ট্রেডার্সের মালিক মো. জাবেদ জানান, ঈদের প্রথম দুই দিনে ছোট থেকে মাঝারিগুলো ৩০০ থেকে ৮০০ টাকায়, বড় চামড়া কিনেছেন ৯০০ থেকে হাজার টাকায়। হেমায়েতপুরের ট্যানারি মালিকরাও প্রায় একই দরে কিনেছেন চামড়া। তবে যাদের কাছ থেকে বাকিতে কিনেছেন, তাদের কিছুটা বেশি দর দিয়েছেন।

ট্যানারি মালিকদের সংগঠন বিটিএ জানায়, সাভারে ঈদের প্রথম দুই দিনে প্রায় পাঁচ লাখ চামড়া কিনেছে ট্যানারিগুলো। প্রতিবছরের মতো এবারও ঈদের এক সপ্তাহ পর থেকে লবণযুক্ত চামড়া কিনবেন তারা। এ বছর ১ কোটি ১০ লাখ পিস চামড়া কেনার লক্ষ্য তাদের। পোস্তার চামড়া ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, এ বছর ঢাকার বিক্রেতাদের থেকে এক লাখ চামড়া কিনেছেন তারা।

এদিকে গতকাল সংবাদ সম্মেলনে চামড়ার বাজারদর কমার কারণ ব্যাখ্যায় বিটিএ সভাপতি শাহীন আহমেদ বলেন, গত কয়েক বছর চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের চাহিদা কমেছে। কারণ চামড়ার বিকল্প পণ্য পাওয়া যাচ্ছে। এর প্রভাব বাংলাদেশের বাজারেও পড়েছে।

ঢাকার বাইরের চিত্র আরও খারাপ

দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, কেউ চামড়ার ন্যায্য দাম পাননি। যেমন চট্টগ্রামে বড় গরুর চামড়ার দামও কোরবানিদাতা পেয়েছেন ৪০০ টাকা। দাম না পেয়ে জেলায় রাস্তায় রেখে যাওয়া ১০ হাজারের বেশি কাঁচা চামড়া নষ্ট হয়েছে। খুলনা কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, প্রতিবছর আড়তদার ও ট্যানারিগুলো আগে থেকে আগাম চাহিদার কথা জানালেও এ বছর চাহিদা দেয়নি। তারপরও ঝুঁকি নিয়ে কিছু চামড়া ৩০০-৪০০ টাকা দরে কিনেছেন।

তাই ঢাকার বাইরে বিক্রি করে কিছু দাম পেতে বৃহত্তর কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম থেকে ঈদের দিন দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত চামড়া নিয়ে ঢাকায় ঢোকার চেষ্টা করেছিল। তবে পুলিশ ও প্রশাসন তা আটকে দিয়েছে। এতেও কিছু চামড়া নষ্ট হয়েছে বলে জানা গেছে।

সংকটের মূলে রপ্তানি বাজার

দেশের চামড়া বাজারের দুরবস্থার প্রধান কারণ ইউরোপের রপ্তানি বাজার হারানো। চামড়া পণ্যের বৈশ্বিক বড় ক্রেতাগোষ্ঠী এক হয়ে ২০০৫ সালে লেদার ওয়ার্কি গ্রুপ গঠনের পর চামড়া সংগ্রহ পর্যায় থেকে চামড়া পণ্য প্রস্তুত পর্যন্ত পরিবেশ ও শ্রমে ন্যূনতম মান নির্ধারণ করে দেয়। এ মান নিশ্চিত করে যারা ‘ফিনিশড’ চামড়া প্রস্তুত করার সক্ষমতা রাখে, সেসব ট্যানারিকে সনদ দিচ্ছে এবং এদের থেকেই চামড়া কিনছে তারা।

সংকট জিইয়ে রাখা হয়েছে

ট্যানারি মালিকদের দাবি, ট্যানারিগুলোর ব্যবসা না থাকায় নতুন করে বিনিয়োগ সক্ষমতা হারিয়েছে। ট্যানারির অভ্যন্তরের কমপ্লায়েন্স ঠিক করার পরও যদি সিইটিপি ঠিক না থাকে, তাহলে সনদ মিলবে না। নিজস্ব সিইটিপি বা ক্রোম রিকভারি প্লান্ট করার সক্ষমতা ২/৪টি ছাড়া বাকি ট্যানারিগুলোর নেই।

তারা বলেন, বাংলাদেশের চামড়া শিল্পের ইতিহাস বেশ পুরোনো। সেই ব্রিটিশ আমলে নারায়ণগঞ্জে গড়ে ওঠা চামড়া শিল্পকে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় আনতে পঞ্চাশের দশকে ঢাকার হাজারীবাগে স্থানান্তর করা হয়। পরের সাত দশকে তিলে তিলে গড়া শিল্প যখন পরিবেশের জন্য ভয়াবহ হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়, ২০০৩ সালে সরকার ফের উদ্যোগী হয় সরিয়ে নেওয়ার। হাজার কোটি টাকারও বেশি ব্যয়ে সাভারের হেমায়েতপুরে চামড়া শিল্পনগরী স্থাপন করে। পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা তৈরি না হওয়ায় ২০১৬ পর্যন্ত ট্যানারিগুলোকে সেখানে নেওয়া যায়নি। শেষ পর্যন্ত উচ্চ আদালতের আদেশে বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে সাভারে যেতে বাধ্য করা হয় ট্যানারিগুলোকে।

বুধবার সংবাদ সম্মেলনে ট্যানারি অ্যাসোসিয়েশন বলেছে, পরিবেশবান্ধব চামড়া শিল্পনগরী গড়ে তুলতে সিইটিপি, সিসিআরইউ এবং কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিকল্প নেই। অথচ এগুলো এখনও কার্যকর হয়নি। বেশ কিছু ট্যানারি নিজস্ব ব্যবস্থাপনা মানে এগিয়ে থাকলেও এসব ছাড়া এলডব্লিউজি সনদ নিতে পারছে না।

হাজারীবাগের ট্যানারি মালিকরা সংকটে

২০১৭ সালে হাজারীবাগ থেকে ট্যানারিগুলো সরিয়ে নেওয়া হয়। ফলে পুরো হাজারীবাগের ট্যানারি এলাকা এখন সুনসান। হাইড অ্যান্ড স্কিন ট্যানারির পরিচালক শামসুদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, হাজারীবাগের পুরো সম্পত্তি অব্যবহৃত। রাজউক বলছে, এগুলো নিয়ে আবাসন করবে। তারা যদি নিত, আমরা ব্যাংকের আগের দায় শোধ করে নতুন ঋণ বা নিজস্ব বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বিনিয়োগ করার সুযোগ পেতাম। এভাবে এত বড় একটা এলাকা ফেলে রেখে কার কী লাভ হচ্ছে, জানি না। রাজউক না নিলে আমরা বিক্রি করে দিতে পারি।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব জাকিয়া সুলতানা জানান, এ বিষয়টিও সুরাহার কাজ চলছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *