গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি সত্ত্বেও রাজস্ব কমেছে তিতাসের
চলতি বছরের আগে ২০১৭ সালের মার্চেও এক দফা বেড়েছে গ্যাসের দাম। সে দফায় গ্যাসের দাম বাড়ানো হয় গড়ে ২২ দশমিক ৭ শতাংশ। স্বাভাবিকভাবেই গ্যাসের বর্ধিত মূল্যের প্রভাব পড়ার কথা বিতরণ কোম্পানিগুলোর রাজস্বে। যদিও দেশের সবচেয়ে বড় গ্যাস বিতরণ কোম্পানি তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের রাজস্ব ২০১৮-১৯ হিসাব বছরে কমেছে। ২০১৭-১৮ হিসাব বছরে বিতরণ কোম্পানিটি ১৪ হাজার ২১৬ কোটি টাকা রাজস্ব আয় করলেও গত হিসাব বছরে তা ১৪ হাজার ১৬৪ কোটি টাকায় নেমে এসেছে।
তিতাসের কর্মকর্তারা বলছেন, গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব কোম্পানির ওপর সেভাবে পড়েনি। গ্যাস বিক্রি হ্রাস পাওয়ায় রাজস্ব আয় কিছুটা কম হয়েছে।
তিতাস গ্যাসের পরিচালক (অর্থ) মো. শরীফুর রহমান বলেন, মূলত গ্যাসের বিক্রির পরিমাণ কমে যাওয়ার প্রভাবেই রাজস্ব কমে গেছে। তাছাড়া বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে গ্যাস বিক্রি করে তিতাস মাত্র দশমিক ২৫ শতাংশ হারে কমিশন পায়। ফলে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব কোম্পানির ওপর সেভাবে পড়েনি। গ্যাসের দাম বাড়লেও তিতাসের কমিশনের পরিমাণ বাড়েনি।
দেশে মোট বিতরণকৃত গ্যাসের ৫৬ দশমিক ১৭ শতাংশই হয় তিতাসের মাধ্যমে। তিতাসের গ্যাস বিক্রির পরিমাণ পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৮-১৯ হিসাব বছরে ১ হাজার ৭৫৭ কোটি ২৮ লাখ ঘনমিটার গ্যাস ক্রয়ের বিপরীতে ১ হাজার ৬৫৬ কোটি ৭৬ লাখ ঘনমিটার বিক্রি করেছে কোম্পানিটি। এর আগে ২০১৭-১৮ হিসাব বছরে কোম্পানিটি ১ হাজার ৭১৫ কোটি ৪৫ লাখ ঘনমিটার গ্যাস কিনে ১ হাজার ৬৯৬ কোটি ১৭ লাখ ঘনমিটার বিক্রি করেছিল। এ হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে তিতাসের গ্যাস বিক্রি কমেছে ৩৯ কোটি ৪১ লাখ ঘনমিটার।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) নতুন নির্দেশনার কারণে গ্যাস বিক্রির পরিমাণ কম দেখাচ্ছে বলে জানিয়েছেন তিতাস গ্যাসের কর্মকর্তারা। তাদের মতে, গত বছরের অক্টোবরে তিতাস গ্যাসের ন্যূনতম চার্জ আদায় ও হায়ার হিটিং ভ্যালু সমন্বয়সংক্রান্ত বিদ্যমান পদ্ধতিতে বেশকিছু পরিবর্তন আনে বিইআরসি। এ পরিবর্তন অনুযায়ী, গ্রাহকের অনুমোদিত মাসিক ন্যূনতম লোড এবং প্রকৃত গ্যাস ব্যবহারের মধ্যে পার্থক্যজনিত রাজস্ব তিতাস গ্যাসকে ন্যূনতম চার্জ হিসেবে পরিচালন আয়ে অন্তর্ভুক্ত করতে হচ্ছে। পরিচালন আয় হিসেবে দেখাতে হচ্ছে হায়ার হিটিং চার্জকেও। যদিও দীর্ঘদিন ধরে গ্রাহকের প্রকৃত গ্যাস ব্যবহারের পরিমাণ কম হলেও ন্যূনতম চার্জের মাধ্যমে বেশি বিল আদায় এবং হায়ার হিটিং ভ্যালু (এইচএইচভি) বা গ্যাসের তাপন মূল্য সমন্বয় থেকে প্রাপ্ত আয়কে গ্যাস বিক্রির রাজস্বে অন্তর্ভুক্ত করে আসছিল তিতাস গ্যাস। পরিশোধনের মাধ্যমে গ্যাসের বিশুদ্ধতার হার বাড়ানোর প্রক্রিয়া হচ্ছে হায়ার হিটিং ভ্যালু।
জানতে চাইলে তিতাস গ্যাসের পরিচালক (অপারেশন) প্রকৌশলী রানা আকবর হায়দারী বলেন, মূলত ন্যূনতম চার্জ ও হাই হিটিং ভ্যালুর বিষয়ে বিইআরসি আদেশের কারণে বিক্রির পরিমাণ কমে গেছে। তবে প্রকৃতপক্ষে বিক্রি কমেনি। কারণ আগে ন্যূনতম চার্জ ও হাই হিটিং ভ্যালুসহ বিক্রি হিসাব করা হতো। সর্বশেষ সমাপ্ত হিসাব বছরে তা করা হয়নি।
তিতাসের গ্যাস বিক্রি কমলেও চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে। অনেক শিল্প-কারখানা এখনো গ্যাস সংযোগের অপেক্ষায় বসে আছে। উৎপাদনে যেতে পারছে না তারা। গত মাসেও গ্যাস সংযোগ দেয়ার অনুরোধ জানিয়েছে বস্ত্র খাতের সংগঠন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ)। যেসব শিল্পে বেশি গ্যাস ব্যবহার হয়, বস্ত্র খাত সেগুলোর অন্যতম।
জানতে চাইলে বিটিএমএ সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, এখনো বেশকিছু কারখানা আছে যেগুলো বিনিয়োগ করে বসে আছে, কিন্তু গ্যাস সংযোগ পায়নি। সংগঠন থেকে কিছুদিন আগেও তিতাসকে চিঠি দেয়া হয়েছে। তবে গ্যাসের চাপ আগের চেয়ে কিছুটা ভালো হয়েছে।
ন্যূনতম চার্জের বিপরীতে প্রদর্শিত এবং হাই হিটিং ভ্যালু সমন্বয় বাবদ অতিরিক্ত গ্যাসের পরিমাণ বাদ দিয়ে তিতাস গ্যাসের সিস্টেম লসের পরিমাণ নিরূপণ করে বিইআরসির কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি (টিইসি)। এতে দেখা যায় ২০১৪-১৫, ২০১৫-১৬ ও ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তিতাস গ্যাসের প্রকৃত সিস্টেম লস ছিল যথাক্রমে ৮ দশমিক ২৬, ৭ ও ৫ দশমিক ৭৬ শতাংশ। অথচ ন্যূনতম চার্জ ও হাই হিটিং ভ্যালুসহ হিসাব করলে ২০১৪-১৫, ২০১৫-১৬ ও ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তিতাস গ্যাসের সিস্টেম লসের পরিমাণ দাঁড়ায় যথাক্রমে ৩ দশমিক ৯০, ২ দশমিক ৮১ ও ১ দশমিক ৩৫ শতাংশ। সর্বশেষ ২০১৮-১৯ অর্থবছরে কোম্পানিটির সিস্টেম লসের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৭১ শতাংশ, যা গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
তিতাসের বড় ধরনের সিস্টেম লস হয়েছে বলে ২০১৮-১৯ হিসাব বছরের আর্থিক প্রতিবেদনে মতামত দিয়েছে নিরীক্ষক একনাবিন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস। নিরীক্ষকের মতামত অনুসারে, গেল বছর কোম্পানির ৭৬৯ কোটি ৮৫ লাখ টাকার সমপরিমাণ ১০০ কোটি ৩৮ লাখ ঘনমিটার গ্যাস সিস্টেম লস হয়েছে। কিন্তু বিইআরসির ১৬ অক্টোবর ২০১৮ সালের আদেশ অনুসারে বিতরণযোগ্য গ্যাসের জন্য তিতাস গ্যাসের নিজস্ব লাইন ও জিপিসিএলের লাইন দিয়ে সঞ্চালিত গ্যাসের ওপর গ্রহণযোগ্য সিস্টেম লস যথাক্রমে ২ ও ২ দশমিক ২৫ শতাংশ। সে হিসেবে সিস্টেম লস ২৩৮ কোটি ৩৮ লাখ টাকার সমপরিমাণ ৩১ কোটি ৮ লাখ ঘনমিটার হওয়া উচিত ছিল। ফলে ৩০ জুন ২০১৯ সমাপ্ত হিসাব বছরে কোম্পানিটির অতিরিক্ত সিস্টেম লসের কারণে ৫৩১ কোটি ৪৭ লাখ টাকা রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে। অতিরিক্ত এ ক্ষতি অবৈধ সংযোগের কারণে হয়েছে বলে মনে করছেন নিরীক্ষক।
নিরীক্ষকের মতামতের জবাবে কোম্পানিটি বলছে, অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণ ও বিতরণ লাইন অপসারণের জন্য তারা ২০১৮-১৯ হিসাব বছরে ১৩৮টি অভিযান পরিচালনা করেছে। এসব অভিযানে ২৯৯ কিলোমিটার পাইপলাইনের অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে, যেখানে আনুমানিক ১ লাখ ১২ হাজার ৪৫৪টি বার্নারের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। তাছাড়া অবৈধ গ্যাস সংযোগের সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে কোম্পানিটির ১৪ জন কর্মকর্তা ও সাতজন কর্মচারীকে বরখাস্ত করা হয়েছে।
অবৈধ গ্যাস সংযোগের কারণে এ সিস্টেম লস বলে জানিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গত এপ্রিলে জমা দেয় দুদকের পর্যবেক্ষণ অনুসারে, তিতাস গ্যাসের ৬ শতাংশ সিস্টেম লসের কারণ অবৈধ সংযোগ। আর একেকটি অবৈধ সংযোগে তিতাসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ঘুষ নেন ৪৫ হাজার টাকা। এ কারণে অবৈধ সংযোগকে বৈধ করতে যারপরনাই অনীহা তাদের। এখানেই শেষ নয়। মিটার টেম্পারিং, কম গ্যাস সরবরাহ করে সিস্টেম লস দেখানো, বাণিজ্যিক গ্রাহককে শিল্পশ্রেণীর গ্রাহক হিসেবে সংযোগ দেয়ার হাজারো অভিযোগ তিতাসের বিরুদ্ধে। দুদকের প্রতিবেদনে তিতাসে দুর্নীতির ২২টি উৎস চিহ্নিত করা হয়েছে। দুর্নীতি প্রতিরোধের জন্য ১২ দফা সুপারিশও করেছে সংস্থাটি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তিতাসের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মরত নয়, এমন কিছু ব্যক্তির যোগসাজশে ঘুষের বিনিময়ে স্বাভাবিক সংযোগের পাশাপাশি অবৈধ লাইনে গ্যাস সংযোগ দেন। তিতাসে কেউ নতুন সংযোগের জন্য আবেদন করলে বা অবৈধ সংযোগ বৈধ করার জন্য আবেদন করলে সেটি সহজে অনুমোদন পায় না।