খাসোগির দেহাবশেষ পাওয়া গেছে
ইস্তাম্বুলের সৌদি কনসাল জেনারেলের বাসভবনের বাগানে জামাল খাসোগির দেহাবশেষ পাওয়া গেছে বলে সংশ্লিষ্ট দুই সূত্রের বরাত দিয়ে দাবি করেছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম স্কাই নিউজ। সৌদি দূতাবাস থেকে কনসাল জেনারেলের বাসভবনের দূরত্ব প্রায় ৫০০ মিটার। সূত্র জানায়, নিহত সাংবাদিকের দেহ কেটে খণ্ড খণ্ড করে ফেলা হয়েছে। এছাড়া তার চেহারাও বিকৃত করে দিয়েছে খুনিরা। এদিকে জামাল খাসোগিকে হত্যার ঘটনাটি পূর্বপরিকল্পিত ছিল বলে দাবি করেছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান।
জামাল খাসোগির দেহাবশেষ উদ্ধার নিয়ে স্কাই নিউজের দাবিটি এ বিষয়ে সৌদি আরবের সর্বশেষ বক্তব্যের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ। খাসোগিকে হত্যার পর তার মরদেহ কম্বলে মুড়ে তা গায়েব করার জন্য স্থানীয় এক সহযোগীর হাতে তুলে দেয়া হয়েছিল বলে এক সৌদি কর্মকর্তা জানিয়েছিলেন।
এ বিষয়ে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টেরিসা মের এক মুখপাত্র বলেন, জামাল খাসোগির দেহাবশেষের সন্ধান পাওয়ার তথ্যটি অত্যন্ত দুঃখজনক। যেসব প্রশ্নের উত্তর আমাদের প্রয়োজন তার অন্যতম হলো, জামাল খাসোগির দেহাবশেষ কোথায় এবং আমরা এখনো এ বিষয়ে তুরস্ক পরিচালিত তদন্তের পূর্ণ প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছি।
জামাল খাসোগির দেহাবশেষ নিয়ে এ তথ্য এমন এক সময় পাওয়া গেল, যখন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোয় তার ছেলে সালাহ খাসোগির সঙ্গে সৌদি বাদশা সালমান ও যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সাক্ষাতের খবর বেশ ফলাও করে প্রচার হচ্ছে। সালাহ খাসোগি গতকালই রিয়াদের ইয়ামামা প্রাসাদে সৌদি বাদশা ও যুবরাজের সঙ্গে দেখা করেন। এ সময় তার সঙ্গে জামাল খাসোগির ভাই সাহেল খাসোগিও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সৌদি রাজসিংহাসনের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কর্ণধার এ সময় নিহত সাংবাদিকের ছেলে ও ভাইকে তাদের পক্ষ থেকে সান্ত্বনা দেন।
নিহত সাংবাদিকের পরিবারসংশ্লিষ্ট আরেক সূত্রের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা এপি জানায়, সৌদি রাজতন্ত্রের প্রতি জামাল খাসোগির কঠোর সমালোচনামূলক অবস্থানের কারণে তার ছেলে সালাহ খাসোগির দেশত্যাগের ওপর গত বছরই এক নিষেধাজ্ঞা জারি করে রিয়াদ। তবে বিষয়টি নিয়ে সৌদি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে এখনো কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
জামাল খাসোগির মরদেহ বিকৃত করা হয়নি বলে সৌদি কর্তৃপক্ষ যে বক্তব্য দিয়েছে, তা থেকে তারা সরে আসবে না বলে ধারণা করছেন তুর্কি রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। কারণ এর অন্যথায় এ নিয়ে তাদের নতুন কিছু অস্বস্তিকর প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
খাসোগিকে হত্যার পরিকল্পনা আগেই করা হয়েছিল: এরদোগান সৌদি কনস্যুলেট ভবনের মধ্যে পূর্বপরিকল্পিত ও বর্বরোচিতভাবে সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে হত্যা করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান। এ বিষয়ে তুরস্কের কাছে শক্ত প্রমাণ রয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি। একই সঙ্গে এ ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে সৌদি আরবে গ্রেফতার ব্যক্তিদের ইস্তাম্বুলে এনে বিচারের মুখোমুখি করার দাবিও জানিয়েছেন তিনি। তুরস্কে গতকাল ক্ষমতাসীন নিজ দলের এমপিদের উদ্দেশে এক ভাষণে এরদোগান এ কথা বলেন।
জামাল খাসোগির দেহাবশেষ কোথায় লুকিয়ে রাখা হয়েছে এবং কে এ হত্যাকাণ্ডে পরিচালিত অভিযানের আদেশ দিয়েছে, সে বিষয়েও সৌদি আরবের কাছ থেকে স্পষ্ট জবাব দাবি করেছেন এরদোগান। ওয়াশিংটন পোস্টের প্রদায়ক জামাল খাসোগিকে নিয়ে এখন পর্যন্ত পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিয়ে এসেছে রিয়াদ। দুই সপ্তাহ ধরে এ হত্যাকাণ্ডের কথা অস্বীকার করলেও সৌদি আরবের বর্তমান বক্তব্য হচ্ছে, ৫৯ বছর বয়সী এ সাংবাদিককে অবৈধ এক অভিযানে (রোগ অপারেশন) হত্যা করা হয়েছে।
অন্যদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়েছেন, এ ঘটনায় সৌদি আরবের ব্যাখ্যা তাকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। আবার মার্কিন মিত্র হিসেবে সৌদি আরবের গুরুত্বের কথাও বেশ জোরের সঙ্গে উল্লেখ করেছেন তিনি।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান তার গতকালের ভাষণে বলেন, হত্যাকাণ্ডের আগে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন ফ্লাইটে করে ১৫ সৌদি নাগরিক ইস্তাম্বুলে এসে পৌঁছেন। হত্যাকাণ্ডের আগের দিন খুনিদের কয়েকজন দূতাবাসের কাছাকাছি স্থানীয় বেলগ্রাদ জঙ্গল পরিদর্শন করে আসেন। গত সপ্তাহেই খাসোগির মরদেহ উদ্ধারের জন্য জঙ্গলটিতে তল্লাশি চালিয়েছে তুর্কি পুলিশ।
তিনি জানান, খাসোগি দূতাবাস ভবনে প্রবেশ করার আগে খুনিরা দূতাবাসের সার্ভিল্যান্স ক্যামেরা ব্যবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হার্ড ড্রাইভগুলো সরিয়ে ফেলে। নিখোঁজ হওয়ার দিন বিয়ের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ করতে দূতাবাস ভবনে প্রবেশ করেন জামাল খাসোগি।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট আরো বলেন, হত্যাকাণ্ডের দিন খাসোগির পোশাক পরে তার মতো দেখতে এবং চশমা ও নকল দাড়ি-গোঁফ লাগানো আরেক ব্যক্তিকে দূতাবাস ভবন থেকে বেরিয়ে আসতে দেখা যায়।
হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে সৌদি আরবে ১৮ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেন এরদোগান। তবে এ বিষয়ে সংগৃহীত প্রমাণাদি সম্পর্কে বিস্তারিত কোনো তথ্য প্রকাশ করেননি তিনি। এমনকি তুরস্কের কাছে খাসোগি হত্যার অডিও ও ভিডিও ক্লিপ রয়েছে বলে সে দেশের সংবাদমাধ্যমে যে তথ্য প্রকাশ হয়েছে, সে বিষয়েও কোনো বক্তব্য দেননি এরদোগান।
হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশে ইস্তাম্বুলে আসা ১৫ জনসহ এর সঙ্গে জড়িত সৌদি দূতাবাসের তিন কর্মকর্তাকে শনাক্ত করা হয়েছে বলে জানান এরদোগান। ক্ষমতাসীন এ কে পার্টির এমপিদের উপস্থিতিতে ভাষণ দেয়ার সময় তিনি বলেন, ‘আমার দাবি হলো, এ ১৮ জনের প্রত্যেকের বিচার ইস্তাম্বুলেই করা হোক।’
একই সঙ্গে এ হত্যাকাণ্ডে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা রাখা প্রত্যেকেরই শাস্তির দাবি করেন তিনি। এছাড়া অভিযুক্তরা তুরস্কে কোনো ধরনের কূটনৈতিক দায়মুক্তি (ডিপ্লোমেটিক ইমিউনিটি) পাবে না বলেও ঘোষণা দিয়েছেন এরদোগান।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এ সময় জামাল খাসোগি হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি নিয়ে তদন্তের জন্য একটি স্বাধীন কমিশন গঠনের দাবি তোলেন। একই সঙ্গে সৌদি আরবের বাদশাহ সালমান এ বিষয়ে পূর্ণ সহযোগিতা দেবেন বলেও নিজ বিশ্বাসের কথা ব্যক্ত করেন তিনি।
ভাষণে যুবরাজ মোহাম্মাদ বিন সালমান প্রসঙ্গে কোনো মন্তব্য করেননি এরদোগান। অনেকেরই ধারণা, সৌদি যুবরাজের নির্দেশেই খাসোগিকে হত্যা করা হয়েছে।
এরদোগানের মতো একজন রাষ্ট্রনেতার পক্ষে এ ধরনের রক্ষণাত্মক অবস্থানকে সৌদি আরবের সঙ্গে তুরস্কের কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখার প্রয়াস বলেই মনে করছেন অনেকে। আবার রিয়াদ ও ওয়াশিংটনের চাপের মুখে তিনি এ ধরনের অবস্থান নিয়েছেন বলেও ধারণা করা হচ্ছে। এ বিষয়ে ইস্তাম্বুলে নিয়োজিত বিবিসি প্রতিনিধি মার্ক লোয়েন বলেন, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট কথা দিয়েছিলেন, তিনি এ হত্যাকাণ্ডের পেছনের ‘নগ্ন সত্য’ উন্মোচন করবেন। কিন্তু তার ভাষণে তিনি যা বলেছেন, সেটিকে আমরা যতটুকু জানতাম, তার চেয়ে বিস্তারিত বলা চলে না কোনোভাবেই।
বেনামি এক সৌদি কর্মকর্তার বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছিল, জোর করে সৌদি আরবে ধরে নিয়ে যাওয়ার এক ব্যর্থ প্রয়াস চালাতে গিয়ে খাসোগিকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়। পরে তার মরদেহ গায়েব করার জন্য কম্বলে মুড়িয়ে ‘স্থানীয় এক সহযোগীর’ হাতে তুলে দেয়া হয়। ভাষণে ওই ব্যক্তির পরিচয় প্রকাশের দাবি জানান প্রেসিডেন্ট এরদোগান।
জামাল খাসোগি হত্যাকাণ্ডে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ১৮ জনকে গ্রেফতার করা ছাড়াও যুবরাজ মোহাম্মাদ বিন সালমানের দুই ঘনিষ্ঠ সহযোগীকে বরখাস্ত করেছে সৌদি আরব। এছাড়া এ হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে সৌদি গোয়েন্দা সংস্থাকে পুনর্গঠনেরও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এজন্য মোহাম্মাদ বিন সালমানের নেতৃত্বেই একটি দলও গঠন করা হয়েছে।
এদিকে তুর্কি ও আরব গোয়েন্দা সূত্রের বরাত দিয়ে রয়টার্স জানিয়েছে, দূতাবাস ভবনে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার আগে যুবরাজের বরখাস্ত দুই সহযোগীর একজন সাউদ আল-কাহতানি স্কাইপের মাধ্যমে খাসোগির জিজ্ঞাসাবাদ কার্যক্রমে যুক্ত হন। এ সময় খাসোগির সঙ্গে তার উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়। একপর্যায়ে সেখানে উপস্থিত সহযোগীদের উদ্দেশে আল-কাহতানি বলেন, ‘আমাকে কুকুরটার মাথা এনে দাও।’
ওই সূত্র আরো জানায়, ওই স্কাইপে কথোপকথনের একটি অডিও রেকর্ডিং রিসেপ তাইয়েপ এরদোগানের কাছে রয়েছে। এটি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে হস্তান্তরে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন তিনি।