ক্রেতাদের বিরূপ শর্ত নিয়ে তৎপর বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ
বাংলাদেশ থেকে পোশাক নেয়ার ক্ষেত্রে ঋণপত্রে (এলসি) নতুন ধারা যুক্ত করছে ক্রেতারা, যেখানে উঠে এসেছে বিভিন্ন দেশের নিষেধাজ্ঞার প্রসঙ্গটি। আর এটিকে অশনিসংকেত হিসেবে দেখছেন পোশাক খাতসংশ্লিষ্ট সংগঠনের নেতারা। সতর্কতামূলক অবস্থান নিয়েছে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোও। এ বিষয়ে সচেতনতা ও সতর্কতার অংশ হিসেবে ঋণপত্রে ‘স্যাংশন ক্লজ’ যুক্তকারী ক্রেতাদের তালিকা প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ। পাশাপাশি এসব শর্ত না দেয়ার জন্য ক্রেতাদের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে সংগঠন দুটি।
পোশাকপণ্য প্রস্তুত ও রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর পক্ষ থেকে জানানো হয়, সম্প্রতি বিদেশী ক্রেতার পাঠানো এক লেটার অব ক্রেডিটের (এলসি) ধারায় ‘স্যাংশন ক্লজ’ যুক্ত করা হয়েছিল। তাতে উল্লেখ করা হয়, ‘আমরা জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ, যুক্তরাজ্যের নিষেধাজ্ঞা আরোপিত কোনো দেশ, অঞ্চল বা দলের সঙ্গে লেনদেন প্রক্রিয়া করব না। নিষেধাজ্ঞার কারণগুলোর জন্য আমরা কোনো বিলম্ব, নন-পারফরম্যান্স বা তথ্য প্রকাশের জন্য দায়ী নই।’
ঋণপত্রের ওই ধারা আলোচনায় আসতেই দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তা যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ায় বিশেষ মনোযোগ দিয়েছে। ব্যাংকগুলোর প্রধান কার্যালয় থেকেও ধারাটির খুঁটিনাটি বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা সাপেক্ষে ঋণপত্র গ্রহণের দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আর এসব প্রক্রিয়ায় বিপাকে পড়তে হচ্ছে রফতানিসংশ্লিষ্টদের। ব্যাংকের সতর্কতামূলক এ পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়ে যাচাই-বাছাই যতটা সম্ভব দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন করার অনুরোধ জানিয়েছে বিজিএমইএ।
পোশাক খাতের সংশ্লিষ্টরা অবশ্য বলছেন, বাংলাদেশের ওপর স্যাংশন আসার কোনো কারণ ও সম্ভাবনা নেই। এর পরও যদি স্যাংশন সম্পর্কিত কোনো ক্লজ বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়, সে ঋণপত্রের মাধ্যমে ক্রয়াদেশ না নেয়ার জন্য বিজিএমইএ তার সদস্যদের সতর্ক করেছে।
বিকেএমইএ সূত্র জানিয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে ঋণপত্রে ক্রেতাদের পক্ষ থেকে স্যাংশন ক্লজ যুক্ত হওয়ার প্রেক্ষাপটে তাদের তালিকা তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পাশাপাশি ওই ক্রেতাদের বলা হবে এ ধরনের ক্লজযুক্ত ঋণপত্র ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে। মূলত লেনদেনের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে ব্যাংকই ঋণপত্রে ক্লজ যুক্ত করে। তাই তালিকা দেখে ক্রেতাদের অনুরোধ জানানো হবে, তারা যেন তাদের সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকে ঋণপত্রে স্যাংশন ক্লজ যুক্ত না করার বিষয়ে উৎসাহিত করে।
স্যাংশন সম্পর্কিত ক্লজযুক্ত এলসি গ্রহণ করা হবে না বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম। সে কারণেই তালিকা করা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘অযাচিত ক্লজ দিয়ে যারা ঋণপত্র পাঠাবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। স্যাংশন সম্পর্কিত ক্লজযুক্ত এলসি গ্রহণ করা হবে না।’
বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি আরো বলেন, ‘ঋণপত্রে ক্লজ যুক্ত করে ব্যাংক। তবে ক্রেতা বললেই সেটা করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে আবার ব্যাংক নিজ উদ্যোগেও স্যাংশন সম্পর্কিত ক্লজ যুক্ত করে ফেলে। সেক্ষেত্রে ক্রেতা নিষেধ করলে ব্যাংক সেটা পাঠায় না। বিজিএমইএ সভাপতির সঙ্গে আলোচনা করেছি যে এ ধরনের ক্লজ-সংবলিত ঋণপত্র যারা পাঠাবে তাদের বিষয়ে আমরা ব্যবস্থা নেব।’
সতর্ক ব্যবস্থা হিসেবেই স্যাংশন ক্লজ যুক্ত করা ক্রেতাদের তালিকা তৈরির চিন্তা ভাবনা চলছে জানিয়ে বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, ‘ক্রেতাদেরকে বলা হচ্ছে এ ধরনের ক্লজ না দিতে। আমাদের সংগঠনের সদস্যদেরও বলা হয়েছে, কোনো ক্রেতা এ ধরনের ক্লজ দিলে সে ঋণপত্র না নিতে। প্রয়োজনে অর্ডারের বিষয়টিও পুনর্বিবেচনা করতে বলা হয়েছে।’
ঋণপত্রে স্যাংশন ক্লজ যুক্ত করার বিষয়টি এবারই প্রথম নয় উল্লেখ করে বিজিএমইএর সভাপতি ১৬ ডিসেম্বর বলেছিলেন, ‘আগেও এ ধরনের ক্লজ ব্যবহার হতো, যেমন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সম্পর্কিত স্যাংশন ক্লজ ব্যবহার হচ্ছিল। তবে এখন অনেক সুনির্দিষ্ট ক্লজ দেয়া হচ্ছে। এ ধরনের ক্লজ যদি আগেও ব্যবহার হয়ে থাকে সেটা নিয়ে আমাদের কাজ করতে হবে। চুপচাপ মেনে নেয়া যাবে না। তার পরও যদি কেউ এ ধরনের ক্লজযুক্ত ঋণপত্র গ্রহণ করে সেটা সংশ্লিষ্ট রফতানিকারক ও ব্যাংকের বিষয়।’
ঋণপত্রে স্যাংশন ক্লজ নিয়ে সতর্কতার জন্য ক্রয়াদেশ কম হতে পারে কিন্তু ঝুঁকিমুক্ত থাকা যায় বলে জানান ব্যবসায়ীদের এ শীর্ষ নেতা। তিনি বলেন, ‘এ ধরনের অ্যাডভার্স ক্লজযুক্ত ঋণপত্র যাচাই-বাছাইয়ের ক্ষেত্রে যদি সময় কিছুটা বেশিও লাগে, তাতেও আমাদের সচেতন ও সতর্কতা অবলম্বনের প্রয়োজন রয়েছে। আমাদের সাবধান থাকা দরকার, কারণ আন্তর্জাতিক ব্যবসা করতে গেলে যদি অর্থ পরিশোধ না হয় তার প্রভাব অনেক বেশি নেতিবাচক। ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতিও তৈরি হয়। সব মিলিয়ে অ্যাডভার্স ক্লজগুলো নিয়ে সচেতন ও সতর্ক হতেই হবে।’
ঋণপত্রে কেবল স্যাংশন ক্লজই নয়, পণ্যে ক্রেতাদের পক্ষ থেকে অযাচিতভাবে দাবি করা ডিসকাউন্টের বিষয়েও সতর্ক হতে তালিকা প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ১১ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিসকাউন্ট কমিটির ৭৭তম সভায় আলোচনা হয় বলে জানা গেছে। পরে ২১ ডিসেম্বর এ-সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি জারি করে বিজিএমইএ। নানা অযৌক্তিক উপায়ে অসাধু বিদেশী ক্রেতারা রফতানিকারকদের কাছে ডিসকাউন্ট দাবি করে বলে বিজ্ঞপ্তিতে তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে চুক্তি বা এলসি অনুযায়ী রফতানির জন্য প্রস্তুতের পর পণ্য না নেয়া, পোর্ট থেকে পণ্য খালাসের পর স্বেচ্ছায় দেউলিয়া ঘোষণা করতে আদালতের শরণাপন্ন হওয়া, বিদেশী পোর্টে পণ্য পৌঁছানোর পর ডিসকাউন্ট দাবি করে তারা। ব্যাংকের ঋণ ও সুদ রফতানিকারককেই পরিশোধ করতে হয় এবং রফতানির ঘোষণা (ইএক্সপি) ওভারডিউ হলে তারই কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাসহ বিভিন্ন ধরনের জটিলতা তৈরি হয়। তাই দীর্ঘ দেন-দরবারের একপর্যায়ে বাধ্য হয়ে ক্রেতার ডিসকাউন্ট দাবি মেনে নেয় রফতানিকারকরা।
বিজ্ঞপ্তিতে বিজিএমইএ তার সদস্যদের জানায়, ১১ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় ব্যাংকে অনুষ্ঠিত ডিসকাউন্ট কমিটিকে বিজিএমইএ বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে বিদেশী ক্রেতাকে রফতানিকারকরা স্বেচ্ছায় ডিসকাউন্ট দেয় না। প্রতারক ক্রেতা, বায়িং হাউজ এবং ফ্রেইট ফরোয়ার্ডারের ফাঁদে পড়ে তারা বাধ্য হয়ে ডিসকাউন্ট দিতে রাজি হয়। বিজিএমইএর জোর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি প্রথমবারের মতো কার্যবিবরণীতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ডিসকাউন্ট কমিটির কার্যপদ্ধতি সম্পর্কে কোনো তথ্যের বা সহযোগিতার প্রয়োজন হলে বিজিএমইএর পক্ষ থেকে যোগাযোগের বিস্তারিত তথ্যও উল্লেখ করা হয়েছে ওই বিজ্ঞপ্তিতে।
জানতে চাইলে বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘বেশকিছু ক্রেতা বা বায়িং হাউজ অন্যায়ভাবে ডিসকাউন্ট অথবা পণ্য নিয়ে অর্থ পরিশোধে গড়িমসি করছে বলে ডিসকাউন্ট কমিটির নজরে এসেছে। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিসকাউন্ট কমিটিতে সিদ্ধান্ত হয়েছে। বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ যৌথভাবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। তাদেরকে কালো তালিকাভুক্ত করা বা এদের বিরুদ্ধে আরো কী কী পদক্ষেপ নেয়া যায়, তা নিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিসকাউন্ট কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে।’