কালো টাকা বনাম অপ্রদর্শিত অর্থ

স্টাফ রিপোর্টার

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিভিন্ন অর্থবছরে একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের কর দেওয়ার মাধ্যমে বিনা প্রশ্নে অপ্রদর্শিত অর্থ বা কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়। তবে কেউ যদি আগে কর না দেন বা সম্পদ প্রদর্শন না করেন, তাহলে জরিমানা দিয়ে সব সময়ের জন্য তা প্রদর্শনের বিধান রয়েছে। এ বিষয়ে বিতর্ক তৈরি হয় মূলত প্রশ্ন করা বা না করা নিয়ে। আগামী বাজেটেও কালো টাকা বিনা প্রশ্নে সাদা করার সুযোগ দেওয়া হতে পারে বলে জানা গেছে।

কালো টাকা সাদা করার নৈতিকতা এবং অর্থনীতিতে এর প্রভাব নিয়ে বিতর্ক চলে আসছে। কালো টাকা সাদা করার বিষয়ে এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের ওয়েবসাইটে তাদের এক আলোচনার ব্রিফিং নোট রয়েছে। সেখানে বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ স্থান পেয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ মনে করেন, যে টাকার আয় এবং আয়ের উৎস ঘোষণা না দিয়ে রাষ্ট্রের প্রাপ্য কর ফাঁকি দেওয়া হয় বা যায়, যে টাকা অবৈধভাবে অর্জিত, সে টাকাই কালো টাকা।

তাঁর মতে, কর দেওয়ার সময় কালো টাকাকে ‘অপ্রদর্শিত অর্থ’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে গুরুতর অপরাধকে হালকা করে দেখা হয়। সংবিধানের ২০(২) ধারায় বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র এমন অবস্থা সৃষ্টির চেষ্টা করবে, যেখানে সাধারণ নীতি হিসাবে কোনো ব্যক্তি অনুপার্জিত আয় ভোগ করিতে সমর্থ হবেন না।’ সংবিধানের বিধানমতে, ‘অনুপার্জিত আয়’ যদি কালো টাকা হয় তাহলে কালো টাকাকে ‘অপ্রদর্শিত অর্থ’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করলে দুর্নীতির সঙ্গে কালো টাকার যে ওতপ্রোত সম্পর্ক রয়েছে, তাকে অনেকটাই গৌন বা লঘু করে দিচ্ছে কিনা পর্যালোচনা প্রয়োজন।

কোন ধরনের টাকা ‘কালো’ এবং কোন ধরনের টাকা ‘অপ্রদর্শিত’ হিসেবে চিহ্নিত হওয়া উচিত তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। ড. মোহাম্মদ আব্দুল মজিদের মতে, অনেক সময় বৈধভাবে অর্জিত অর্থের ওপর যেমন– জমিজমা, অ্যাপার্টমেন্ট, প্লট, দোকান ইত্যাদি রিয়েল এস্টেট ক্রয়-বিক্রয়ে প্রকৃত দাম না দেখিয়ে কম দাম দেখালে রেজিস্ট্রেশন খরচ, স্ট্যাম্প খরচ, সম্পদ কর ও ক্যাপিটাল গেইন ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়া যায়। এসব ক্ষেত্রে কালো টাকাকে ‘অপ্রদর্শিত অর্থ’ বলাই সংগত এবং তা প্রদর্শনের সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। তবে কোনো অবস্থাতেই বিদ্যমান করহার কমিয়ে নয়, উপরন্তু জরিমানা দিয়ে তা প্রদর্শনের সুযোগ দিতে হবে।

এনবিআরের সাবেক সদস্য (আয়কর নীতি) মো. আলমগীর হোসেন মনে করেন, শুধু অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থ নয়, অর্থনীতির ভাষায় সব অপ্রদর্শিত অর্থই কালো টাকা। আইনে বলা হয়, নির্দিষ্ট হারে কর দিলে অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ প্রশ্ন করবে না। তবে অবৈধ পথে যারা সম্পদ অর্জন করেছেন, তাদের জিজ্ঞাসা করার কিন্তু অন্য কর্তৃপক্ষ আছে। অবৈধ পথ যদি এসব সংস্থা চিহ্নিত করতে পারে, প্রমাণ করতে পারে–তাহলে তাদের কার্যক্রমে কোনো বাধা নেই। এ ছাড়া যাদের বিরুদ্ধে কর ফাঁকির মামলা আছে তারা অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করার এ সুযোগ পায় না।

এনবিআরের সাবেক সদস্য মো. ফরিদ উদ্দিন মনে করেন, বাংলাদেশে কালো টাকা সৃষ্টির ক্ষেত্র হচ্ছে–ঘুষ-দুর্নীতি, জুয়া, নারী ও শিশু পাচার, অর্থ আত্মসাৎ, সন্ত্রাস, নিষিদ্ধ পণ্য, মাদকদ্রব্য, অস্ত্র আমদানি ও ব্যবসা, হুন্ডি, চোরাচালান, জমি ও ফ্ল্যাট কেনাবেচায় মিথ্যা ঘোষণা, আমদানি-রপ্তানিতে মিথ্যা ঘোষণা, কর না দেওয়া, জমি দখল ইত্যাদি। কালো টাকা অনেক ক্ষেত্রে হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পাচার হয়। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমেও পাচার হয়। বাণিজ্যভিত্তিক মানি লন্ডারিং এখন বেশ আলোচিত বিষয়। এটি প্রতিরোধে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো হচ্ছে–এনবিআর, বাংলাদেশ ব্যাংক, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও দুদক। এসব সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাব আছে বলে তাঁর মনে হয়।

অনেকে মনে করেন, অবৈধ আয়ের দুষ্টচক্র না ভেঙে শুধু কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া অর্থনীতির জন্য সুফল আনবে না। অবশ্য কেউ কেউ একে মন্দের ভালো বলেন। তাদের যুক্তি, দেশে সুযোগ না দিলে টাকা বাইরে পাচার হয়ে যাবে, যার ক্ষতি আরও বেশি। তারা অবশ্য অবৈধভাবে ও অপরাধমূলক কাজের মাধ্যমে অর্জিত কালো টাকার মালিকদের ছাড় দেওয়ার বিপক্ষে। নানা কারণে যারা বৈধ আয় প্রদর্শন করেননি, তাদের সুযোগ দেওয়ার পক্ষে।

অধ্যাপক রেহমান সোবহান মনে করেন, কালো টাকা সাদা করার বর্তমান বিধান অর্থনীতিতে ভুল বার্তা দিচ্ছে। এটি কালো টাকার মালিকদের জন্য প্রণোদনা হলেও যারা কঠিন সময়েও নিয়মিত কর দেন তাদের সৎ থাকার প্রতি এক ধরনের অ-প্রণোদনা। তাদের মধ্যে এমন ভাবনাকে জাগিয়ে দেওয়া যে, সৎ থাকার কোনো সুবিধা নেই।

ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য মনে করেন, কালো টাকা সাদা করার সুযোগ নীতির দিক থেকে সংবিধান ও সাম্যের পরিপন্থি। এটি টেকসই উন্নয়ন ও টেকসই কর আদায়ের পরিপন্থি, যা সমাজের মধ্যে এক ধরনের অন্যায্যবোধকে প্রশ্রয় দেয়। কোনো অবস্থাতেই এ ধরনের সুযোগ ধারাবাহিকভাবে থাকতে পারে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *